X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

একুশে আগস্ট: যখন সহিংসতাই ছিল শাসকপ্রথার শ্রেষ্ঠত্ব

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৯ আগস্ট ২০২০, ১৩:৪৭আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২০, ১৩:৪৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা একুশে আগস্ট আমাদের সামনে আবার। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল, এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন করে দেওয়ার এক নৃশংস ঘটনার দিন একুশে আগস্ট।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলবার আগে ২০০১-এর নির্বাচনের পর থেকে যা যা ঘটেছে তার কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। এই নির্বাচনে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি বিজয়ী হলে সরকার গঠনের আগেই শুরু হয় এক ‘ভয়ংকর উল্লাস’। এই উল্লাস ছিল ধর্ষণের। নির্বাচন শেষ না হতেই শুরু হয় সারাদেশে একাত্তরের মতো ধর্ষণের উল্লাস। সংখ্যালঘু মেয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউ বাদ যায়নি। উল্লাস ছিল সংখ্যালঘুসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া, এলাকা ছাড়া করা। উল্লাস ছিল মামলা, খুন আর দখলের।
যে শাসনব্যবস্থা তখন কায়েম হয়েছিল তার অভিনব দিক ছিল। সমাজে হিংসা জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেওয়া। এক শাসন কৌশলের মাধ্যমে রাজশাহীর বাগমারায় জঙ্গি বাংলা ভাই আর শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী সংগঠন জেএমবি’র মাধ্যমে যে তালেবানী শাসন শুরু হয়েছিল তাকে মদত দিয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিচালিত সরকার। বারবার এ নিয়ে শঙ্কা উচ্চারিত হলে জামায়াত-বিএনপির মন্ত্রীরা বলতেন, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। আরও কয়েকজন মন্ত্রীর সরাসরি সম্পর্ক ছিল এই সহিংস গোষ্ঠীর সঙ্গে। ময়মনসসিংহে সিনেমা হলে বোমা মেরে মানুষ মারে জঙ্গিরা, আর সরকার আটক করে ঢাকার পরিবাগে ঘুমিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীকে। এভাবে একের পর এক জনপদে কখনও জেএমবি, কখনও হরকাতুল জিহাদকে আদর আপ্যায়ন করেই ২১ আগস্ট আর ১৭ আগস্টের জন্ম দেওয়া হয়। 

এই হিংসাত্মক শাসনপ্রথা এমন এক ব্যবস্থা কায়েম করলো যে, অন্যায় কর্মে যুক্ত হলো আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী। এক নতুন দেওয়া-নেওয়ার প্রথায় সম্পদ ভাগাভাগি করে খাওয়ার সংস্কৃতি চালু হলো। এই নতুন শাসনরীতির দর্শন ছিল শাসন মেনে নাও, কোনও প্রতিবাদ নয়। প্রতিবাদ মানেই খুন, ধর্ষণের শিকার হওয়া। 

তাই প্রতি বছর একুশে আগস্ট এলে একটা কথাই উপলব্ধি হয়, হত্যা, নির্বিচার নিপীড়ন আর সর্বব্যাপী সহিংসতাই ছিল ২০০১-এ ক্ষমতায় আসা শাসক গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে অনেক কথা আছে, কিন্তু দেশব্যাপী ধর্ষণ আর খুনের উৎসব করা, জঙ্গি গোষ্ঠীকে মদত দেওয়া আর বিরোধী রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল আধিপত্যকামিতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করা। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনও সরকারের আমলে কোনও ঘটনা ঘটলে তার দায় দায়িত্ব সরকারি দলের থাকলেও তাকে কি পুরো দায় দেওয়া যায়? সবসময় দেওয়া যায় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দিতে হয়। একুশে আগস্ট তেমনি এক ঘটনা যার দায় বিএনপি নিজেই নিয়েছিল ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে, জজ মিয়া নাটক সৃষ্টি করে। 

২০০৪ সালের এই দিনে যা ঘটেছে তা এক কথায় ভয়ংকর। হামলার পর রক্তে ভেজা সড়ক, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়ানো চারদিকে। আশপাশের দোকানদার, সাধারণ মানুষ সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু পুলিশ? তারা কাঁদানো গ্যাস ছুঁড়েছে, সাধারণ মানুষকে লাঠিপেটা করেছে যেন আহত নিহতদের হাসপাতালে নেওয়া না যায়। হাসপাতালে দায়িত্বরত জাতীয়তাবাদী চিকিৎসকরা আহতদের চিকিৎসা না দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফায়ার সার্ভিস ডেকে পানি ছিটিয়ে দ্রুত রক্তের দাগ মুছে ফেলতে চেয়েছে সরকার। আর পুলিশের উপস্থিতিতেই শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার সময় তার গাড়িতে গুলি করা হয়েছে। এই সবকিছু প্রমাণ করে একটি রাষ্ট্রীয় ও দলীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছিল পুলিশ ও প্রশাসন।  

নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে যে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ বা হুজি নামের জঙ্গি সংগঠনের নেতা মুফতি হান্নান এই হামলার মূল কারিগর। আর তিনি এসব করতে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতা ও সে সময়ের উপমন্ত্রী আবদুস সালামের সরকারি বাসায়। হান্নানকে মদত দিয়েছে বিএনপি’র সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। খালেদা জিয়ার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনএসআই, সিআইডি ও পুলিশের প্রতিটি বিভাগ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। কোথা থেকে একজন নিরীহ জজ মিয়াকে হাজির করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ তার পেছেনে খরচ করে নতুন গল্প বানাবার চেষ্টা করেছে পুলিশ।

রাজনীতির খুনি চরিত্র স্বাধীন বাংলাদেশে দু’বার দেখা গেছে। একবার ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেদিন একাত্তরের পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নস্যাৎ করে দিয়েছিল। আরেকবার এই একুশে আগস্টে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে তার পুরো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বসহ হত্যা করার শাসক দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি। 

একুশে আগস্টের মতো ঘটনা যারা ঘটাতে পারে তাদের সঙ্গে আর কোনও রাজনৈতিক সমঝোতা চলে না–আওয়ামী লীগের ভেতর এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। এই ধারণা অবিবেচিত নয়। যারা ঘটনা দেখেছেন, যারা ঘটনার ভিকটিম হয়েছেন, তারা জানেন কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে এই ঘটনা। বিচার করেনি, তদন্তের নামে নাটক করেছে বিএনপি সরকার আর তার দলের নেতারা হাস্যরস করেছেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে, আহত নিহতদের নিয়ে। সত্যিকারভাবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর ২১ আগস্ট এমন ঘটনা যা বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরস্থায়ীভাবে বিভাজিত করেছে।  

২০০১-২০০৭ পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, অর্থনীতির কোনও গতি ছিল না, শিল্প বলতে কিছু হতে পারেনি। কিন্তু যার ফলন ভালো হয়েছিল তা হলো সহিংস রাজনীতি। ক্ষমতাসীনরা ভেবেছিল সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জঙ্গি মতাদর্শের আগ্রাসন চলছে, চলবে এবং আন্তর্জাতিক তালেবান গোষ্ঠীর সমর্থনও থাকবে। কিন্তু সেটা হয়নি। একুশে আগস্টের হামলা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, কোন একক ঘটনা নয়, একাত্তরের পরাজিত শক্তি যেভাবে ১৯৭৫-এ  ১৫ আগস্ট ঘটিয়েছে তারই ধারাবাহিকতা। প্রকৃতির বিচার এই যে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন যারা দেখেছিলেন তারা এখন নিজেদের সৃষ্ট হিংসার বিষপানে জ্বালা জুড়াচ্ছেন। 

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ