X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাথার চেয়ে টুপি বড়

বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী
২০ আগস্ট ২০২০, ১৪:৩৮আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২০, ১৫:৪২

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ভারতের ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনে সম্প্রতি একটি দীর্ঘ জরিপ ছাপানো হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে ৬৬ শতাংশ লোক মনে করে আগামী নির্বাচনেও মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আশেপাশে কেউ নেই। সেই জরিপে চীন ইস্যুতে ৬৯ শতাংশ লোক রায় দিয়েছে চীনের সঙ্গে ভারতের যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা সেখানে মোদি চীনকে যথার্থ জবাব দিয়েছেন। চীনের সঙ্গে ভারতের মিলিটারি সামর্থ্য যা আছে সেটা যুদ্ধে যাওয়ার সমতুল্য কিনা জানতে চাইলে ৭২ শতাংশ মনে করে ঠিক আছে, মাত্র ৯ শতাংশ মনে করে চীনকে পরাজিত করা যাবে না। চীনের সঙ্গে ভারতের কি যুদ্ধে যাওয়া উচিত—এমন প্রশ্নে ৫৯ শতাংশ মনে করে ‘হ্যাঁ’ আর ৩৪ শতাংশ মনে করে—‘না’।
নরেন্দ্র মোদি মনে হয় এই জরিপের যোশে দিশেহারা হয়ে গত ১৫ আগস্ট ভারতের ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লালকেল্লা সমুখের মাঠে আয়োজিত এক জনসমাবেশে কঠোর ভাষায় চীন ও পাকিস্তানকে শাসালেন। গত ১৫ জুন লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, সেদিন ভারতীয় সেনারা দেখিয়েছেন তারা কী করতে পারে। এই কথাটা প্রধানমন্ত্রী এর পূর্বে আরও কয়েকবার উল্লেখ করেছেন।

১৫ জুন ২০২০, লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত সংঘর্ষ ভারতের অফিসারসহ ২০ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। ভারত এই কথা স্বীকার করেছে কিন্তু চীনের পক্ষে কতজন প্রাণ হারিয়েছে তার উল্লেখ কেউ করেনি। তবে চীন স্বীকার করেছে যে তাদের সৈন্যও প্রাণ হারিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি বুক ফুলিয়ে এই ঘটনার কথা যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে যে চীনের ব্যাপক সেনা প্রাণ হারিয়েছে। অন্তত ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। লাদাখ সীমান্তে উভয়পক্ষ হাজার হাজার সৈন্য সমাবেশ করেছে। স্থল ও বিমান সেনারা সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সীমান্তে দেশরক্ষা মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নিজেই সফর করেছেন। চীনের পক্ষ থেকে অনুরূপ উচ্চপদস্থ কেউ সীমান্ত সফর করেছে বলে কোনও খবর পাওয়া যায়নি।

মোদির স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি চীন। তারা এটাকে তথ্য উপাত্তহীন কেবলই একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা হিসেবে নিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়াং বলেছেন যে উভয় দেশের জন্য ‘সঠিক পথ’ হচ্ছে একে অপরকে সম্মান করা। চীন পারস্পরিক বিশ্বাসের উন্নতি করতে এবং ভারতের সাথে পার্থক্য কমাতে প্রস্তুত।

১৯৬২ সালের উত্তর সীমান্তে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল তাতে ভারত পরাজিত হয়েছিল। এমনকি যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল বি এম কাউল পর্যন্ত চীনের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। সেই থেকে ভারত-চীন সীমান্তে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে চীন ভারত সীমান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত ছিল না, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সময় সীমান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির সময় আরও উন্নত ও সময়োপযোগী করার কাজ চলছে। চীন নিজে সমরাস্ত্র উৎপাদন করে এবং বিশ্বের অন্যতম সমরাস্ত্র বিপণনকারী দেশ। কিন্তু ভারতের অবস্থা সে পর্যায়ে নেই, ভারত বিশ্বের অন্যতম সমরাস্ত্র ক্রেতাদেশ।

২০১৭ সালে ভুটান সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনারা যখন মুখোমুখি হয়েছিল তখন ভারতের সমরাস্ত্রের মজুত সম্পর্কে লোকসভায় আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি সীমান্তে পরিপূর্ণ যুদ্ধ হলে ভারতের পক্ষে দুই সপ্তাহের উপরে সমরাস্ত্রের সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। ভারত ভুটানেরও দেশ রক্ষার ঠিকাদার। ভুটানের পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষার দায়িত্ব দুই রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ভারতের ওপর ন্যস্ত। অবশ্য ভারত ছাড়া ভুটানের সীমান্ত আছে শুধু চীনের সঙ্গে।

১৯৬২ সালের যুদ্ধের মাঝপথে চীন যুদ্ধ বন্ধ করে তার নিজ সীমান্তে চলে গিয়েছিল তবুও আকসাই চীন থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত-চীন বহু জায়গা থেকে তার দখল ছাড়েনি। ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক শংকর ঘোষ তার এক বইতে লিখেছেন, চীন ভারতের সাড়ে সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে আছে। আবার দাবি করছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ চীনের এলাকা। অরুণাচল একসময় তিব্বতের ছিল আর এখন তিব্বত যেহেতু চীনের অংশ সে কারণে তাদের এই দাবি। অথচ চীন যখন তিব্বত নিয়ে যায় তখন ভারত চীনকে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদান করেছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের মুখ্য বিরোধ কাশ্মির নিয়ে। ৭২ বছরব্যাপী এই বিরোধ চলছে। জওহর লাল নেহরু কাশ্মিরের ব্রাহ্মণ। নেহরুর কারণে দেশভাগের সময় কাশ্মির পাকিস্তান পায়নি। উভয়ের মধ্যে কাশ্মির সীমান্তে কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম যুদ্ধ হয় ১৯৪৮ সালে, যে যুদ্ধে পাকিস্তান দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল আর দুই দিন যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে কাশ্মির ভারত নিতে পারতো না। কারণ পাকিস্তানি সেনারা আর দুইদিন যুদ্ধ করলে শ্রীনগর বিমানবন্দর দখল করে নিতো বলা হয়। ভারত তখন কাশ্মিরে সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হতো যেহেতু সৈন্য পাঠানোর জন্য শ্রীনগর বিমানবন্দর ভিন্ন বিকল্প কোনও পথ ছিল না। কিন্তু নেহরু জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। তাতেই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে কাশ্মির এখন দুই টুকরা। কিছু অংশ পাকিস্তানের দখলে আর কিছু অংশ ভারতের দখলে। ১৯৪৭ সাল থেকে একটি উত্তেজিত তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে কাশ্মিরে এবং তা এখনও অব্যাহত আছে। এতদিন কাশ্মির জাতিসংঘের বিচারাধীন বিষয় ছিল কিন্তু নরেন্দ্র মোদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ধরে একতরফাভাবে জাতিসংঘের কজ লিস্ট থেকে কাশ্মির বিষয় বাদ দিয়েছেন। যে কারণে নরেন্দ্র মোদি সংবিধানের ৩৭০ ধারা নির্ভয়ে বাতিল করে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে দিয়েছেন। লাদাখকে কাশ্মির থেকে বিচ্ছিন্ন করতে দ্বিধা করেননি। রাজ্যের মর্যাদা পর্যন্ত হারিয়েছে কাশ্মির।

কাশ্মির ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একটি চুক্তির মাধ্যমে। চুক্তিটিকে নরেন্দ্র মোদি কোনও গুরুত্বই দেননি বরঞ্চ এখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিনষ্ট করার জন্য মূল ভারতীয় লোকজনকে কাশ্মিরে বসতি করার অনুমতি দিয়েছেন। লালকেল্লার ময়দানে ৮৬ মিনিটের বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদি চীন-পাকিস্তানকে একসঙ্গে শাসালেন। যার ঘরে দুই সপ্তাহের যুদ্ধ করার সমরাস্ত্র মজুত আছে, যার দেশের দুই তৃতীয়াংশ লোক দারিদ্র্যসীমায় বাস করে, তার মুখে তো দুইটি যুদ্ধবাজ প্রতিবেশী, পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী রাষ্ট্রকে এভাবে হুমকি দেওয়া সমীচীন হয়নি।

ভারতের দু’জন সাহসী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেছেন। একজন ইন্দিরা গান্ধী আর দ্বিতীয়জন নরেন্দ্র মোদি। ইন্দিরা গান্ধী সাহস দেখেছি এবং ১৯৭১ সালে কত বড় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হয়েছিলেন। আর কূটনৈতিক প্রয়াসের মাধ্যমে চীন এবং আমেরিকাকে মোকাবিলা করেছিলেন, তাও দেখেছি। নরেন্দ্র মোদি এই যাবৎ ফাঁকা ময়দানে সাহস দেখিয়েছেন। বাস্তবে কিছুই দেখাননি। ভারতকে মজবুত করার নামে ভারত বিভক্তির পাঁয়তারা করেছেন। বিশ্বে অনেক অঘটন ঘটেছে রাষ্ট্রনায়কদের মুখের দোষে। নরেন্দ্র মোদিকে পরামর্শ দেবো যেন মুখ সংযত করেন। একই পরামর্শ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও তাকে দিয়েছেন। সাহস দেখিয়ে ছত্রপতি শিবাজী হওয়া উচিত হবে না মোদির। চীন-পাকিস্তান একত্র হলে নরেন্দ্র মোদির জন্য কেয়ামত হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ