X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পিটিয়ে ৩ কিশোর হত্যা: দায় কি নেই আমাদেরও?

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৪ আগস্ট ২০২০, ১৪:৫৮আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২০, ১৫:০৩

ডা. জাহেদ উর রহমান ‘কথা বলতে তো আর ট্যাক্স দিতে হয় না’—কেউ খুব লম্বা-চওড়া, একেবারে বাস্তবতাবিবর্জিত কথা বললে তার প্রতিক্রিয়ায় ঠাট্টাচ্ছলে কথাটা আমরা অনেক সময়‌ই বলি। কিন্তু এই কথাটি আসলে কার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য?
দৈনন্দিন জীবনে নানারকম সেবা নিতে আমরা যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে যাই, সেগুলোর যে কোনোটার ওয়েবসাইটে ঢুকে সেসব সংস্থার লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং কর্মকাণ্ডের দিকে একবার চোখ বুলালেই অস্ফুট স্বরে আমরা বলে উঠবো—‘কথা বলতে/লিখতে তো আর ট্যাক্স দিতে হয় না’। কোনও এক ঘোর কলিকালে কথার ওপরে যদি ট্যাক্স ধার্য করাও হয়, সরকারের অন্তত সমস্যা হবে না।
যে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে এই গৌরচন্দ্রিকা সেটি খবরের শিরোনাম হলো কয়েক দিন আগে। জাতীয় মূলধারার মিডিয়াগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়েই সংবাদ প্রকাশ করেছে, কিন্তু এই বীভৎস, বর্বর ঘটনাটি নিয়ে আমরা নাগরিকরা খুব বেশি উচ্চবাচ্য করিনি।

বহুকাল পরে আমরা একটা ‘প্রতিবাদযোগ্য’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দেখা পেয়েছি। তাই দীর্ঘ একটা সময় নেটিজেনরা ব্যস্ত আছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে। সেই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা কিছুটা থিতিয়ে আসতেই মাথাচাড়া দিলো সেই ঘটনায় আমাদের সামনে আসা আরেকজন মানুষ শিপ্রা দেবনাথকে নিয়ে আলোচনা। যা হয় এই দেশে, কোনও একটা অপরাধের সঙ্গে নারী জড়িত থাকুক অথবা তার নাম যেকোনোভাবে আসুক, তখন এই সমাজের বড় অংশের মানুষের আলোচনা মূল বিষয় ছাপিয়ে ওই নারীর নানা ব্যক্তিগত দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিপ্রার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে,ফলে শিপ্রাও আমাদের মনোযোগের বিরাট একটা অংশ নিয়ে নিয়েছে। তাই চাপা পড়ে গেলো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। অবশ্য সিনহা রাশেদ সম্পর্কিত ঘটনা না ঘটলেও এই ঘটনায় আমাদের বেশিরভাগ মানুষ কি আদৌ প্রতিক্রিয়া দেখাতাম?

ঘটনাস্থল যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র। পাঠকদের যারা জানেন না তাদের জন্য শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়ে দু’টো কথা। আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী এখন আমরাও আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছি ১৮ বছরের নিচের সকল মানুষকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তাই সেই বয়সের কেউ যদি কোনও অপরাধ করে তাহলে তাকে প্রাপ্তবয়স্কদের জেলখানায় না নিয়ে এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে রাখা হয়। এটা এক ধরনের কারাগার‌ই। তবে সাধারণ কারাগারের সঙ্গে কাগজে-কলমে কিছু পার্থক্য যে আছে সেটা এর নামটা শুনলেই অনেকটা অনুমান করা যায়। এসব কেন্দ্রের একটা কথিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে এটার, এটা নিয়ে বলছি একটু পরেই। 

কিছুদিন আগে প্রাথমিকভাবে পত্রিকায় খবর আসে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের আটক কিশোররা পরস্পরের সঙ্গে প্রচণ্ড মারামারি করে এবং তাতে তিনজন কিশোরের মৃত্যু হয়। এবং বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এই হাসপাতালে ভর্তি কিশোরদের কাছ থেকেই যে তথ্য বেরিয়ে আসে সেটা বীভৎস, মর্মান্তিক। কিশোরদের ভাষ্য অনুযায়ী, ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) তার চুল কেটে দিতে বলেন এক কিশোরকে। ওই কিশোর সেদিন অনেক কিশোরের চুল কেটে ক্লান্ত হয়ে গেছে বলে সেটা পরদিন কেটে দিতে চায়। চুল কেটে না দেওয়ার ‘অপরাধ’ হেড গার্ডকে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং তিনি প্রচণ্ড গালাগাল করলে কয়েক কিশোর মিলে তাকে মারধর করে।

এর প্রতিক্রিয়ায় কী হয়েছিল সেটা জেনে নেওয়া যাক জেলার পুলিশ সুপারের বয়ানে—
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) গত বৃহস্পতিবার সকালে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রের ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কেন্দ্রের প্রধান প্রহরীকে আঘাত করা কিশোরদের পেটাতে হবে অচেতন না হওয়া পর্যন্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একে একে ১৭ কিশোরকে আবাসিক ভবন থেকে ধরে আনা হয়। এরপর তাদের দুই হাত জানালার গ্রিলের মধ্যে আটকে, পা বেঁধে ও মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে রড এবং ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এতে মারা যায় ৩ কিশোর, গুরুতর আহত হয় ১৫ জন। সেদিন দুপুরে তাদের খেতেও দেওয়া হয়নি।

কেন্দ্রের কিশোরদের মারধরের ঘটনা ঘটে বেলা একটার দিকে। গুরুতর আহত কিশোরদের সারা দিন চিকিৎসা ছাড়া ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যায় নাঈম নামের এক কিশোর মারা গেলে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। তখনও কেন্দ্র থেকে কোনও তথ্য কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে সিভিল সার্জন ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। তখন কিশোরদের ডরমিটরিতে গিয়ে দেখা যায়,মুমূর্ষু অবস্থায় অনেক কিশোর পড়ে আছে। তাদের পুলিশের পিকআপ ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে আরও দুই কিশোর মারা যায়। পুলিশ সুপার বলেন, পিটুনিতে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরলে আবার তাদের পেটানো হয়।

বর্ণনাটা একটু দীর্ঘ হলেও এটুকু জেনে রাখা দরকার যে কর্তৃপক্ষের হেফাজতে কিছু অভিযুক্ত কিশোরকে রাখা হয়েছিল তারা সেই কিশোরদের সঙ্গে ঠিক কী আচরণ করেছেন তারা। এবার একসঙ্গে তিনজন কিশোর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় এবং আরও বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয় বলে এই খবরটা মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে খুব গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা যারা একটু চোখ কান খোলা রাখি তারা জানি, এই কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত বন্দি কিশোরদের ওপরে অমানুষিক নির্যাতন হয়, কিশোররা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে হতাহত‌ও হয়।
যশোরের ঘটনায় মৃত রাব্বির বাবার সঙ্গে কথা বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট করেছে বাংলা ট্রিবিউন। সেই রিপোর্ট আমাদের ধারণা দিতে পারে ওই কেন্দ্রগুলোর ভেতরে আসলে কী হয়। মৃত্যুর সাত দিন আগে ফোনে রাব্বি তার বাবাকে যা বলেছিল, সেটাই খুব স্পষ্ট করে দেয় কেমন পরিবেশে আমরা ওদের রেখেছি—‘এখানে আর থাকতে চাই না, জন্মনিবন্ধন সংশোধন করে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও। সারা জীবন জেলখানাতে থাকবো, তবু শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকবো না।’

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর কার্যাবলি কী সেটা জানতে কৌতূহলবশত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকেছিলাম। মোটামুটি বিস্তারিতভাবেই লেখা আছে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং কর্মপদ্ধতি কী। লেখার কলেবর ছোট রাখার জন্য সেই অংশগুলোতে যাচ্ছি না, তবে তাদের ভূমিকাতে উল্লেখ করা সারাংশটুকু দেখে নেওয়া যাক—  ‘উন্নয়ন কেন্দ্রসমূহে স্বীকৃত পদ্ধতিতে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু ও অভিভাবক কর্তৃক প্রেরিত শিশুদের কেইস ওয়ার্ক, গাইডেন্স, কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে মানসিকতার উন্নয়ন, ডাইভারশন ইত্যাদি স্বীকৃত পদ্ধতিতে রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণপোষণ, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন করে কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসিত/আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’

পাঠক মনে মনে কী বলে ফেললেন—‘কথা বলতে/লিখতে তো ট্যাক্স দিতে হয় না।’ আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই বোধ আপনার আরও প্রকট হবে যদি আপনি বিস্তারিতভাবে তাদের লিখে রাখা সব কথা পড়েন। 

কিছুক্ষণ আগে যেটা বলছিলাম, মেজর সিনহা রাশেদের হত্যাকাণ্ড এবং এরপর শিপ্রাকে নিয়ে আমাদের অশোভন বাড়াবাড়ি যদি নাও থাকতো তবুও কি এই তিন কিশোরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা ফেসবুকে যথেষ্ট উচ্চকিত থাকতাম? আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি সেটা আমরা থাকতাম না।

আমাদের এই সোচ্চার না থাকাটাই আসলে এসব মর্মান্তিক বীভৎস ঘটনার পেছনে আমাদের দায় তৈরি করে। ‘দায়’ শব্দটা আমি খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। এই রাষ্ট্র এই কাজগুলো করতে পেরেছে কারণ রাষ্ট্রের অনেক নাগরিক মোটামুটি একমত হয়েছে কোনও গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এরকম হত্যাকাণ্ড চলতেই পারে। সমাজের এই স্বীকৃতিটাই এই ঘটনাগুলোকে এতটা বাড়িয়ে দিতে পেরেছে এটুকু বোঝার জন্য খুব সামান্য কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।

যশোরে দুই তিন কিশোর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তারাও খুব গুরুতর অপরাধে অপরাধী। দুজন ধর্ষণ এবং একজন হত্যা মামলায়। হতেই পারে তারা সত্যি সত্যি অপরাধগুলো করেছে। তাদের বয়স ১৮-এর নিচে বলে এই সমাজে তারা কিছুটা বেশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পাবে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। সেই কারণেই ওইসব শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কর্মকর্তারা মনে করেন এদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই করা যায়। তার ওপরে তো আছে তাদের ‘আজন্ম পাপ’ এরা একেবারে দরিদ্র প্রান্তিক পরিবারের সন্তান। 

মানব সৃষ্টির একেবারে আদিত‌ম কাল থেকেই অপরাধের অস্তিত্ব আছে। মানব সভ্যতা শেষ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত সমাজে অপরাধ থাকবেই।

একটা সমাজ অপরাধীদের কোন দৃষ্টিতে দেখে সেটা সেই সমাজের সভ্য হয়ে ওঠার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক বলে আমি মনে করি। কোনও সমাজ যদি তার অপরাধীদের মানবিক দৃষ্টিতে দেখে, রাষ্ট্রের কাস্টডিতে নিয়ে তাদের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আবার সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে পারে তবেই সেটা একটা মানবিক সমাজ। সেই সমাজেই অপরাধের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে থাকে।

আমরা যারা মনে করি অপরাধীদের ঘৃণা করে, খারাপ পরিবেশে রেখে শাস্তি দিয়ে, এমনকি বিচারিক (কিংবা বিচারবহির্ভূত) হত্যাকাণ্ড করে অপরাধ দমানো যাবে তারা অপরাধবিজ্ঞানের খুব ব্যাসিক জ্ঞানটুকুও রাখি না। এটা নিয়ে কথা বলা যাবে আরেক দিন। 

 

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ