X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জীবন লিখতে লিখতে

জহর সেনমজুমদার
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৫০

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ-এর ৫০তম জন্মদিন আগামীকাল শনিবার। তার লেখালেখির সূচনা কৈশোরেই, বাংলা ও ইরেজি ভাষায়। ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকা প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউ-এ, ২০০০ সালে। গল্পগ্রন্থ ‘গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বাংলাদেশে প্রকাশ করে ইউপিএল, ২০১২ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা আননেম্ড প্রেস, ২০১৪ সালে। উপন্যাস ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ প্রকাশ করেছে ভিনটেজ/র‌্যানডম হাউজ, ২০১৩ সালে। তার সবগুলো বই কাগজ প্রকাশন থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

কাজী আনিস আহমেদের জন্ম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ঢাকাতেই, সেন্ট জোসেফ ও নটরডেম কলেজে। উচ্চতর শিক্ষা আমেরিকায়-ব্রাউন, ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে সাহিত্যে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা ট্রিবিউন-বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক।

কাজী আনিস আহমেদের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে কবি শামীম রেজার সম্পাদনায় বাতিঘর  প্রকাশ করছে একটি মূল্যায়ন-গ্রন্থ ‘অধরা বিশ্বের প্রতিভূ’। উক্ত সংকলন থেকে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। 

জীবন লিখতে লিখতে জীবন কাকে বলে? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যাশাপূরণের ধারাবাহিক চলমানতার নামই কি জীবন? চেতন ও অবচেতনের ইচ্ছেগুলো যখন প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্ব নিয়ে ক্রমাগত আমাদের সত্তাকে ক্ষতবিক্ষত করে, হৃদয়কে পর্যুদস্ত করে, তখনই বারবার ভেতরে ভেতরে প্রশ্ন উঠে যায়-সুখ কোথায়, শান্তি কোথায়, জীবনই-বা কোথায়? তখনই আমাদের মনোবীজের কূট সংক্রমণে চারপাশের স্বাভাবিক স্থিতাবস্থায় ভয়ংকর কম্প তৈরি হয়-ভয়ংকর প্রশ্নমুখী ব্যাকুলতা তৈরি হয়-কেন এই জীবন? কী কারণে এই জীবন? আর চলমান এই জীবনের সত্যিকারের মানেটাই-বা কী? সাধারণত চারপাশে আমরা যে জীবন দেখি, তা মুখ্যত প্রশ্নহীন আনুগত্যেরই জীবন; বড় হয়ে ওঠার হাস্যকর প্রহসনে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আনুগত্য; জীবধর্ম পালনের নামে আহার-নিদ্রা-মৈথুনের আনুগত্য; ফলে গোটা জীবনজুড়েই শুধু সুযোগ-সন্ধানের পৌনঃপুনিক প্রজনন ও উৎপাদন; চলমান জীবন এভাবেই হয়ে ওঠে আরাম এবং আশনাই, প্রবৃত্তি ও প্ররোচনা, আমোদ ও আশ্লেষ; বেশির ভাগ মানুষই এই স্থূলতর জীবনচর্চায় বেশি স্বস্তি বোধ করে; ফলে এক প্রশ্নহীন জীবন, প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং প্রশ্নহীন ভাসমানতাই তৈরি হয়ে যায় আমাদের দিনানুদৈনিক চারপাশে-সমাজবাস্তবতাও গ্রাহ্য করে নেয় এই গতানুগতিক প্রশ্নহীনতার আস্থা ও আসক্তিকে; কারণ, প্রথাবদ্ধ সমাজবাস্তবতাও মনে করে-এই গতানুগতিক আত্মবিভ্রম ও আসক্তিচর্বণই জীবন-যা স্বাভাবিক এবং প্রকৃতিস্থ-যা নিরাপদ ও স্বস্তিপ্রদ; সুতরাং একেই নাও, আশ্লেষে সংশ্লেষে একেই ব্যবহার করো এবং জন্মযাপন থেকে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি পর্যন্ত একই রকম আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণের প্রশ্নহীনতার ভেতরেই আত্মসুখ সম্পর্কে সুখী থাকো; কিন্তু জীবনসম্পর্কিত এই আত্মবিনোদনজাত প্রতিবেদন ও নির্ধারিত মীমাংসাসূচক সিদ্ধান্তের ভেতর যদি কেউ সুখ না পায়? যদি কেউ আসক্তিচর্বণকে একমাত্রিক ভেবে সরে যেতে চায় অন্য কোনো আত্মভাবনায়? তখন তো এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আত্মবিভ্রমে চ্যুতি আসবেই-দেখা দেবে ফাটল ও গহ্বর-দেখা দেবে সংশয় ও অনিশ্চয়-যেমনটা দেখা গিয়েছিল জীবনানন্দের ‘বোধে’, ‘আট বছর আগের একদিনে’ কিংবা ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসের সেই আশ্চর্য প্রশ্নমুখী তামসিক অনিশ্চয়ের কারুকল্পে; এই প্রশ্নমুখী তামসিক অনিশ্চয় থেকেই তো জেগে উঠেছিল জীবনানন্দের সেই সব ঘনগভীর আর্তনাদ-আক্রান্ত তাড়িত আর্তনাদ। লিখেছিলেন :

ক.    হে নর, হে নারী,

তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;

আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,

শত শত শূকরের চীৎকার সেখানে,

শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;

এইসব ভয়াবহ আবৃতি!

[অন্ধকার : বনলতা সেন]

খ.     জানি-তবু জানি

নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;

[আট বছর আগের একদিন : মহাপৃথিবী]

হয়তোবা, এভাবেই, কারও কারও মনে ও জীবনে, খুব সংগোপনে, তৈরি হতে থাকে জীবনকেন্দ্রিক জৈব জীবনপালনের বিবমিষা, প্রশ্নহীন আনুগত্যের বিরুদ্ধে তখনই হয়তো জেগে উঠতে থাকে প্রশ্নসন্ধিৎসু সংশয়-একই সঙ্গে নারী ও জীবনকে তখন থেকেই হয়তো তার মনে হতে থাকে আমোদ ও চুম্বকের অসহায় সংযুক্তি, আর তখনই সে নারী ও জীবনের উদ্দেশ্য বলে উঠতেই পারে-‘ধোঁয়া সব; তুমি যেন মরীচিকা-আমি মরুভূমি—’ মোহাসক্ত মৌমাছির নির্বিবাদ প্রতিষ্ঠিত জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা তখন থেকেই নড়বড়ে হয়ে তলে-তলে ভেঙে পড়তে শুরু করে-ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসের কেন্দ্রবাসী সত্তার, যে নাকি পৃথিবীর অজস্র রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের বাণিজ্য-প্রতিনিধি নামক সামূহিক ‘যদুনাথবাবু’ হয়ে উঠতে পারেনি, আর পারেনি বলেই অন্তর্গত দ্বন্দ্বে আর সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে একসময় স্পষ্ট বুঝেছিল—এই জীবন কিছুতেই তার নয়; যদুনাথবাবুদের মতো কুড়ি একর জীবন কিছুতেই তার হতে পারে না; মনে পড়তেই পারে ‘কারুবাসনা’র শেষ পৃষ্ঠা, শেষ অংশ, যেখানে কুড়ি একরের যদুনাথবাবু বলছে, চুরুটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলছে :

তারপর সেই পরাণকথার রাজকন্যাকে পোষো, ফল ধরতে ধরতে আট-দশটা বছর কেটে যাবে। মনে হবে যেন জেলে রয়েছ-কিন্তু মনের অবস্থাতে নিজেকে না খুন করে বাঁচো যদি, তাহলে দুনিয়ার দালাল মুখ তুলে চাইবেন বইকি। ফকিরের কান্নায় তিনি হার্টফেল করেন না...ফকির সাজা না ঘুঘু সাজা, পৃথিবীকে যদি উপভোগ করতে চাও, তাহলে সৃষ্টির স্রোতের ভেতরকার অক্লান্ত সুবিধাবাদ ও অশ্রাব্য আত্মপরতাকে মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতে শেখো...

কী ভয়ংকর কথা-নিজেকে যদি খুন না করো এবং খুন না করে বেঁচে থাকতে চাও-তাহলে এই ‘অক্লান্ত সুবিধাবাদ’ এবং ‘অশ্রাব্য আত্মপরতাকে’ নির্বোধ উচ্ছ্বাসে মেনে নিতেই হবে-গ্রহণ করতেই হবে-কী মুশকিল—এখান থেকেই আবার মনে পড়ে যেতেই পারে কিয়োরোস্তামির সেই শঙ্কাতুর চলচ্চিত্র-‘আ টেস্ট অব চেরি’-যেখানে কেন্দ্রবাসী সত্তার প্রতিনিধি বদি ও তার রুক্ষ ধূসরতার ভেতর দিয়ে আত্মযন্ত্রণাদগ্ধ গাড়ি চালাবার, ক্রমাগত গাড়ি চালাবার, আত্মহন্তারক দৃশ্যকল্পটি; গাড়ি চালাতে চালাতে, এইভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে কোথায় যাচ্ছিল বদি? প্রশ্নের উত্তরট জানামাত্র স্তব্ধ ও হকচকিত স্তব্ধতা সম্পূর্ণতই গ্রাস কোরে নেবে আমাদের; রুক্ষ ধূসরতার ভেতর, ছড়ানো-ছিটানো পাথুরে বন্ধ্যত্বের ভেতর, বদি আগে থেকেই তার নিজের জন্য বা আত্মহত্যা করবার জন্য একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল; গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার সে শুধু ওই গর্তটার কাছে পৌঁছোতে চেয়েছে আর চেয়েছে কেউ একজন তাকে তার এই আত্মহননের কাজে একটু সাহায্য করুক; তাহলে কি ‘কারুবাসনা’র কেন্দ্রবাসী সত্তার মতো বদিও ক্রমে ক্রমে কোনো কোনো যদুনাথবাবুদের সংস্পর্শ থেকে বুঝে নিয়েছিল যে নিজেকে খুন না করতে পারলে মরীচিকা ও মরুভূমির ভেতর তাকেও ক্রমে ক্রমে মেনে নিতে হবে এই ‘অক্লান্ত সুবিধাবাদ’ এবং ‘অশ্রাব্য আত্মপরতা’?

 

পৃথিবীর এই সব গভীর গভীরতর অসুখের কথা এইভাবে ফিরে ফিরে আসছে কেন আজ? কেনইবা অন্তর্মূল খুঁড়ে খুঁড়ে বার কোরে আনছে মরীচিকা ও মরুভ‚মির নোনা বালি? ফিরে আসছে খুঁড়ে আসছে বারবার কাজী আনিস আহমেদের একটি বিশেষ সবিশেষ লিখনপ্রতিক্রিয়ায়; যে লিখনপ্রক্রিয়ার নাম দেয়া হয়েছে-‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন’; যদিও এই লিখনপ্রক্রিয়াকে গ্রন্থভুক্তিকালে গল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে-চিহ্নিত করা হয়েছে-লিখনজগতে এটাই স্বাভাবিক মান্য নিয়ম, কারণ লিখনপ্রক্রিয়াকে তো চিহ্নিতকরণের বাহ্য সুযোগ দিতেই হয়-দেয়াটাই রীতি ও অনুশাসন-কিন্তু সত্যিই কি গল্প? সত্যিই কি গল্প নামের একটা নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত অবয়বসংস্থানে এই বিশেষ ও সবিশেষ লিখনচেতনাকে রাখা যায়? ভাবা যায়? একেবারেই যায় না; তাই খুব সত্ত্বার পাঠক্রিয়াজাত সংবেদনা ও সংশ্লেষণ থেকে বলতে হয় একটা অবশ্যম্ভাবী কথা-গল্প নয় গল্প নয়-এ হলো এক লিখনপ্রক্রিয়া ও লিখনচেতনার প্রশ্নমুখী অন্তর্গভীর অনুসন্ধান কিংবা সংশ্লিষ্ট জীবনের ব্যবচ্ছেদ, সুতীক্ষ্ণ ও ফালা ফালা, এক অন্তর্গত সত্তার সুতীব্র আর্তনাদ এবং ভেতরের এই চাপা আর্তনাদই তো আসল কথা-যা আপাত ওপর ওপর বোঝা যায় না-‘সুখ’ নামক প্রহসন ও প্রহেলিকা দ্বারা সর্বদাই চাপা থাকে-ঢাকা থাকে-কাজী আনিস তাঁর এই লিখনপ্রক্রিয়ায় আপাত-সুখের সেই প্রহসন ও প্রহেলিকাকেই টান মেরে ছিঁড়ে এনেছেন, দেখিয়েছেন পারিপার্শ্বিক জীবন ও বাস্তবের ভেতর কীভাবে উইপোকার মতো কিংবা ঘুণপোকার মতো লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘস্থায়ী অ-সুখ, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় আসলে যা ‘মরচে ধরা পেরেকের গান’ এবং মরচে ধরাটা শুধু বাইরে থেকে দেখা যায় না বলেই স্থূলতর সুখের নির্মোকে আবৃত থেকে যায় অস্তিত্ব ও তার অচিকিৎস্য সংক্রমণ; এবং এই ‘অচিকিৎস্য সংক্রমণ’কে অস্বীকার ও প্রতিহত করার কোনো উপায় নেই বলেই বুদ্ধদেবকেও লিখতে হয় ‘মন ও প্রাণ : এক অন্তহীন বিতর্কের অংশ’-এর মতো কবিতা; লিখতে হয় এই সব মারাত্মক  পঙ্ক্তি :

মলত্যাগী খাদক জঞ্জালমাত্র, যা আজ ফুৎকারে ওঠে জ্বলে;

এমনকি স্মৃতিও নাড়ে না যাকে, ঠাণ্ডা ক-টি বস্তাবাঁধা হাড়—

অন্ধ, মূক, জান্তব অস্তিত্ব শুধু-হৃৎপিণ্ড তখনো সচল।

       ...

অভ্যন্তর? সে তো এক ব্যর্থ শব্দকোষ,

আক্ষরিক পুনরক্তিময়। যতো নাড়ো কিছুতেই খোলে না তালা,

শুধু ক্ষীণ স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ফের বন্ধ হয়; সেখানে আপোস

চলে অবিরল, বিসংবাদী তথ্যে ও উত্তরে...

কাজী আনিসের ‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন’ পড়তে পড়তে এসব কথা মুহুর্মুহু চলে আসতে থাকে আমাদের চিত্তে, আমাদের চৈতন্যে; আর তখন থেকেই শুরু হয় অভ্যন্তরস্থ অমীমাংসিত প্রশ্নমালা-একটার পর একটা-একটার পর একটা-মানুষ কি সুখী? কীভাবে ও কতখানি সুখী? সত্যিই কি সুখের ঠিকানা তার অধিগত? সত্যিই কি সে সুখ আহ্লাদিত জীবনপ্রবাহের বাসিন্দা? সে কি জানে সুখ কাকে বলে? সুখ কোথায় থাকে? সত্যিই কি সে বোঝে চলমান এই জীবনে কী পেলে কী কী পেলে সুখের পায়রা হয়ে ওঠা যায়? সুখসংক্রান্ত এই সব অমীমাংসিত প্রশ্নমালা যত দিন যায়-যত দিন যাবে-ক্রমাগত ক্রমাগত ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে বাড়তে থাকবে, বাড়তেই থাকবে-কারণ সুখ তো একটা মই-ওপরে উঠবার মই-এ-ও বলা যায় ঘুরিয়ে-ওপরে, আরও ওপরে উঠবার নামই হচ্ছে মই; প্রসঙ্গসূত্রে বলা দরকার-ওপরে উঠবার এই মইকে কেন্দ্র করেও শ্রেণিবিভাজিত সমাজব্যবস্থার কুৎসিত স্বরূপ কিংবা শ্রেণিকেন্দ্রিক তারতম্যভেদ স্পষ্ট বোঝা যায়; প্রশ্ন হলো-কেমন এই ওঠা-নামার মইকেন্দ্রিক স্বরূপ-মইকেন্দ্রিক বিভাজন? বলতে দ্বিধা নেই-স্বাভাবিক চর্মচক্ষেই আমরা এ ক্ষেত্রে অন্তত চাররকম বিভাজন বা তারতম্যভেদ লক্ষ করতে পারি :

প্রথমত, একধরনের মানুষ আছে, যারা সামাজিক স্বাভাবিকতায় এবং প্রকৃতিস্থ স্বাভাবিকতায় মনোবৃত্তির সম্যক প্রয়োগ ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে মই বেয়ে ক্রমাগত তরতর কোরে ওপরে উঠে যায়-আর তার সঙ্গে সঙ্গে ওপরে উঠে যায় বিজয়ীর ভারসাম্য, ওপরে উঠে যায় মুঠোভর্তি সফলতার জৌলুশ-সামাজিক অর্থে যাকে প্রতিষ্ঠা বলে-প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা-সেই আত্মপ্রতিষ্ঠার চমকে ও উত্থানে স্ফীত হয়ে ওঠে তার হাঁটবার ভঙ্গি, তার চলবার ভঙ্গি, তার দেখবার ভঙ্গি-ফলত এভাবেই মই বেয়ে উঠতে উঠতে ফুলেফেঁপে ওঠে তার উঁচুতলার জীবন...

দ্বিতীয়ত, একধরনের মানুষ আছে, যারা কিছুটা ওঠে-কিছুটা হয়তোবা উঠতে পারে-কিন্তু মাঝপথে বা অর্ধপথে পৌঁছতে না পৌঁছতেই পা পিছলে যায়, ছিটকে পড়ে নিচে, অর্থাৎ যেখান থেকে তার মইয়ে ওঠা শুরু হয়েছিল-আবারও নেমে আসে সেইখানে-কিন্তু কিছুতেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যবর্তী ব্যবধান ঘোচাতে পারে না-ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা, হতাশা আর হতাশা-সামাজিক সফলতাকে মনোবৃত্তির সম্যক প্রয়োগ ও অনুশীলনের মাধ্যমে করায়ত্ত করতে না পারবার স্থ‚লতর সংক্রমণ এই সব মানুষদের সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়...

তৃতীয়ত, একধরনের মানুষ আছে, যারা সমস্ত জীবন ধরে অনেকটা যেন দÐিতের মতোই মইয়ের একদম নিচেই দাঁড়িয়ে থাকে-মই বেয়ে কীভাবে উঠতে হয়, উঠতে উঠতে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয় কিংবা কীভাবেই-বা আঙুর ফলে মুখ দিতে হয় এসবের কিচ্ছু জানে না-এই সব মানুষ সারাটা জীবন শুধু হাঁ করে মই দেখে যায়-ভাবে, এটাই বুঝিবা তার নির্দিষ্ট নিয়তি-স্থিরীকৃত ভবিতব্য-প্রাতিষ্ঠানিক সমাজব্যবস্থা ও বাস্তবতার নিকট এদের একমাত্র পরিচয়-বোকা, মূর্খ, নিষ্ক্রিয়, অপদার্থ। একটা সময় সমাজ ও তৎসংলগ্ন মানুষ এদের ফেলে দেয় না-পাওয়ার দলে...

চতুর্থত, একধরনের মানুষ আছে, যারা সব সময় জানে এবং বোঝেও আমাদের এই দৈনন্দিন ব্যবহারিক জগতের কেন্দ্রভ‚মিতে এই রকম ওঠা-নামার একটা মই বিদ্যমান-আকর্ষণীয়ভাবেই বিদ্যমান-কিন্তু এই সব মানুষ-যদিও সংখ্যায় হয়তোবা খুবই অল্পসংখ্যক-এরা কিন্তু এই ওঠা ও নামার এই লোভনীয় ব্যবহারিক মই সম্বন্ধে একেবারেই নিস্পৃহ ও উদাস, নির্লিপ্ত ও বিবিক্ত, মইয়ের বহুবিধ রঙিন ইশারা ও হাতছানি থাকা সত্ত্বেও অন্য এক অন্যতর এক নিভৃত পিপাসায় আকণ্ঠ মগ্ন-চারপাশের প্রাতিষ্ঠানিক আলো ঝলসানো প্রতিষ্ঠার ভেতর এই সব অদ্ভুত মানুষের যে সামাজিক চিহ্নপত্র তৈরি হয়ে গেছে সেই চিহ্নপত্র স্পষ্ট বলে দিচ্ছে-এরা ‘বেখাপ্পা ও বেহুদা’-গ্র্যাজুয়েশন, চাকরি, প্রমোশন, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, লং ড্রাইভ, রেস্টুরেন্ট, পর্নো, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এসবে মজে নেই এরা-যাবতীয় সামাজিক উত্থান-পতন চড়াই-উতরাই কর্মকাণ্ডের ভেতর এরা সেই শঙ্খ ঘোষের মূর্খ বড়, সামাজিক নয়...

কাজী আনিসের ‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন’ লিখনপ্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে এই মইটাকে দেখা খুব একটা কষ্টকর নয় এবং মইয়ের চারপাশের চার রকমের মানুষগুলোকে শনাক্ত করতেও খুব একটা দিব্যজ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না; লিখনপ্রক্রিয়ার বর্ণনাকারী উত্তম পুরুষ ‘আমি’ যদি হয় প্রথম ধরনের সমাজচলিত এবং সমাজস্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার হৃষ্টপুষ্ট সফল কিংবা চরিতার্থ মানুষ-তাহলে লিখনপ্রক্রিয়ার গূঢ় অংশীদার আত্মহত্যাকারী আমজাদ অবশ্যই চতুর্থ তথা শেষোক্ত শ্রেণির নিঃশব্দ প্রতিনিধি; মনে রাখতে হবে এই লিখনপ্রক্রিয়া কিন্তু সফল ও অসফলের ঈর্ষা বা হিংসাকেন্দ্রিক রিপুদ্বন্দ্ব নয়, এই লিখনপ্রক্রিয়া কিন্তু প্রতিষ্ঠ ও অপ্রতিষ্ঠ তারতম্যভেদজাত সংকীর্ণ কলহতিক্ত পারস্পরিক শত্রুবিদ্বেষ নয়-এমনকি একসময়ের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর মধ্যবর্তী বিচ্ছেদতাড়িত কোনো অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের তথ্য প্রদর্শনীও নয়-তাহলে? তাহলে কী আছে এইখানে এই লিখনপ্রক্রিয়ায়? সেইটুকুই শুধু বলা দরকার; সামান্য-অতিসামান্য একটা ঘটনা-ঘটনাটা হচ্ছে উত্তম পুরুষ আমি’র একসময়ের বন্ধু ছিল বাদল-মোনেম-আমজাদ প্রমুখেরা; এদের মধ্যে কেউ মই বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেছে, কেউ কেউ উঠতে হয়তো চেষ্টা করেছে-কিন্তু পারেনি; আবার কেউ কেউ মনেপ্রাণে কখনো কোথাও কোনোভাবে বৈষয়িক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় উঠতেই চায়নি; এইভাবে ওঠাটাই হয়তোবা তার কাছে অপ্রয়োজন-হয়তোবা একেবারেই তাৎপর্যহীন; উত্তম পুরুষ আমি সব অর্থেই প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় একজন বাহ্য অর্থে সফল ও প্রতিষ্ঠিত আমি; মই বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে একসময় সে হয়ে উঠেছে ‘কাইলার’ নামের এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং শাখার জেনারেল ম্যানেজার, কোম্পানির কাজে মাঝে মাঝেই বোম্বে থেকে জুরিখ বিদেশ সফর করে, লালমাটিয়ায় সম্পন্ন নিজস্ব ফ্ল্যাট, সুনিপুণ ও সুহাস্যময় স্ত্রী ও পাঁচ বছরের ছেলের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নিয়ে তার বেশ গোছানো ও গর্বিত দেখবার মতো ঈর্ষণীয় জীবন; মই বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে অনেক কিছু হারাবার মতোই তার হারিয়ে গিয়েছিল বন্ধুবান্ধব হইহল্লা আড্ডার পুরোনো সময়টাও; তা নিয়ে অবশ্য সেই অর্থে তার কোনো দুঃখ বা কষ্টও ছিল না; বরং নতুন এই ধোপদুরস্ত জীবনের জীবিকা ও ব্যপ্ততার সঙ্গে সে নিজেকে বেশ চমৎকারভাবেই মিশিয়ে নিয়েছিল; পূর্ববর্তী সময়ের কোনো কিছু নিয়েই যেমন তার কোনো হা-হুতাশ আক্ষেপ ছিল না-তেমনই স্রোতে ও ঘূর্ণাবর্তে হাপিত্যেশ করা কিছু মাঝবয়সিদের সঙ্গ ও সংসর্গও তার কাছে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না; এই রকমই একজন প্রতিষ্ঠিত সে-এই রকমই একজন কর্মব্যস্ত সে-অকারণ মাকড়সার মতো কল্পনার জাল বুননার ভাববাদী প্রবণতা কলেজজীবন ছাড়বার পর থেকেই ছেড়ে এসেছে সে-যেমন ছেড়েছে বইপড়া কিংবা জীবনসম্পৃক্ত নানাবিধ চিন্তাশীলতা; এখন গলায় টাই বেঁধে, নিজের গাড়ি নিজেই চালাতে চালাতে, গাড়িতে সে শুধু তুলে নিয়েছে স্ত্রী রীতাকে আর নিজস্ব রক্তজাত পুত্রটিকে; এই নিয়েই তার যেন ভরপেট সুখ; এই ব্যক্তিগত সুখ ও উচ্চাকাক্সক্ষাসম্পৃক্ত মাংসল জীবন-এর বাইরে সে আর কোনো কিছু ভাবতেই চায় না এবং কোনো কিছুতে উঁকিঝুঁকিও দিতে চায় না-বলা যায় সচ্ছল জীবন, স্বচ্ছন্দ দাম্পত্য এবং স্বপ্রতিষ্ঠ জীবিকার আত্মপ্রসাদ নিয়েই সে বেশ আছে; মাঝে মাঝে পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে বাদল আসে অফিসে-অগোছালো ও ছটফটে-কিছু সময় থাকে, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে-তারপর চলে যায়; ব্যস-এইটুকুই; এ ছাড়া পুরোনো কোনো কিছুর সঙ্গেই তার আর যোগাযোগ নেই এবং স্মৃতিসঞ্চিত কোনো মায়া রোগও নেই; ঠিক এভাবেই আত্মসুখ এবং আত্মজীবন চরিতার্থতার মধ্যে দিয়েই চলছিল প্রায় প্রশ্নহীন তার জীবন; এই সময়েই ঘটল সেই ঘটনাটা-যা সামাজিক বাস্তবতার কাছে বলতে গেলে তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর এবং তার কাছেও একটা অপ্রয়োজনীয় ঘটনা ছাড়া আর কিছুমাত্র নয়-একদিন বাদল হঠাৎ এসে তার হাতে একটা বন্ধ মোড়ক বা খাম তুলে দিল; হারানো ছড়ানো বন্ধু একসময়ের, সেই আমজাদ, সেই আমজাদ আত্মহত্যা করবার আগে এই খামটা রেখে গেছে তার জন্য; মুখ্যত ও মূলত ঠিক এইখান থেকেই কাজী আনিস ধরেছেন তাঁর লিখনপ্রক্রিয়া-তাঁর লিখনচেতনা; উত্তম পুরুষ আমি-কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না এত লোক থাকতে আত্মহত্যা করবার আগে আমজাদ তাকে কেন এই বন্ধ খাম দিয়ে গেল? কেন কেন কেন? কী আছে এর মধ্যে? কিছু কি লেখা? কী সেই লেখা? ভেতরে-ভেতরে শুরু হলো একধরনের কৌত‚হল, একধরনের অস্থিরতা, বলা যায় সাজানো-গোছানো কর্মব্যস্ত জীবনে এইবার চিড় ধরল, এইবার প্রশ্ন ঢুকল; আত্মমন্থনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকেই তাকে আমরা বলতে শুনলাম :

কৌত‚হল একটা বিদঘুটে জিনিস। এটি কখনো এগিয়ে নেয়, আবার কখনো থামিয়ে দেয়। বেশ কয়েকদিন চলে গেল, তারপরও আমি আমজাদের প্যাকেটটি খুললাম না। ব্যাখ্যা করতে পারব না আমি এমনটা কেন করছিলাম। আমি কি ভয় পাচ্ছিলাম যে, হয়তো এখান থেকে অনাকাক্সিক্ষত কিছু বেরিয়ে পড়বে আমার এই বন্ধু সম্পর্কে, যাকে আমি একসময় অনেক আপন জানতাম আর শেষ পর্যন্ত যার খবরও রাখিনি? একটা মারাত্মক কোনো খবর আমার একদম হাতের মুঠোয়, যা আমি যখন খুশি জেনে ফেলতে পারি এমন একটা অবস্থা আমার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকেই যেন নাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার ঘুম ভালো হচ্ছিল না। সেলস-সংক্রান্ত মিটিংগুলোয়ও আমার একাগ্রতা ছিল না...

স্বস্তি নেই-একটা চাপা অস্বস্তি-যা স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকে নড়বড়ে করে দিয়েছে-এই স্বীকারোক্তি পড়লেই বোঝা যায় আমজাদের খাম না ছেঁড়া পর্যন্ত এবং ভেতরে কী আছে তা না জানা পর্যন্ত এই শারীরিক অস্বস্তির, এই মানসিক অস্বস্তির হাত থেকে মুক্তি নেই; অথচ আমজাদ কী এমন মানুষ এবং এমন করে গেছে জীবনে যাপনে যে তার জন্য এই সংক্রামক অস্বস্তি ক্রমাগত সহ্য করতে হবে? মনেপ্রাণে বহন করতে হবে? এই প্রশ্নটা যত তীক্ষè ও তীব্র হয়, এই প্রশ্নটা যত আমূল ও আক্রমণাত্মক হয়-ততই আমাদের মনে পড়ে যাবে বাদলের সেই আশ্চর্য কথা :

-আমজাদ এক নীরব জীবন যাপন করত ...

-আমজাদ এক নীরব জীবন যাপন করত ...

-আমজাদ এক নীরব জীবন যাপন করত ...

বুঝতে অসুবিধা হয় না আসলে এই ‘নীরব জীবন যাপন’ই একটা বিরাট প্রশ্ন, যাবতীয় সামাজিক ‘অক্লান্ত সুবিধাবাদ’ এবং ‘অশ্রাব্য আত্মপরতার’ ভেতর ক্রমাগত জেগে ওঠা এবং জেগে থাকা একটা বিরাট প্রশ্ন-যা অস্তিমূল নাভিমূল সব কামড়ে ধরে-আমজাদ আসলে কোথাও কিচ্ছু করেনি, সে শুধু তার নীরব জীবন যাপন দিয়ে উত্তম পুরুষ আমি’র অভ্যস্ত চৈতন্যকেই ধাক্কা দিয়েছে-যার ফলে তাকে নিয়ে ভাববার অবসর ও অবকাশ না থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ এক অসহ্য সংক্রমণ উত্তম পুরুষ আমি কিন্তু এড়িয়ে থাকতে পারেনি-বরং ভেতরে-ভেতরে ভাবব না ভাবব না ভেবেও শেষাবধি সারাক্ষণ আমজাদ ও তার আত্মহত্যাই তাকে সম্পূর্ণত গ্রাস করে নিয়েছে; এই জন্যই অফিস থেকে বের হয়ে সুখী গৃহকোণে ফেরবার পরিবর্তে সে প্রায় অন্যমনস্ক, বিমূঢ়, উদ্ভ্রান্ত, উদ্দেশ্যহীন ও লক্ষ্যহীনভাবে গাড়ি চালিয়ে অনেকক্ষণ শহরের যে দিকটায় ভিড় কম সেই দিকে ঘুরে বেড়াতে প্রায় বাধ্য হয়েছে; বোঝাই যায়-আমজাদ ও তার খাম, আমজাদ ও তার ছেঁড়া ছেঁড়া লেখা এইভাবেই ভেতরে-ভেতরে ভেঙে দিয়েছে তার প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান ও স্থিতাবস্থা-তারই প্রতিফলন এই উদ্দেশ্যহীন গাড়ি চালানো; তারই প্রতিফলন এই সত্তাগত অভ্যন্তরীণ অশান্ত ছটফটানি-অথচ সত্যি বলতে ছিন্ন ছিন্ন টুকরো টুকরো লেখায় আমজাদ এমন প্রায় কিছুই বলেনি-যা আজকের আধুনিক বাস্তববাদী কোনো মানুষের কাছে জরুরি কোনো রকম তথ্য হয়ে উঠতে পারে; সে শুধু লিখেছে তার জীবনযাপনের কিছু অদ্ভুত মুহূর্তের কথা, কিছু খেয়ালখুশির কথা, কিছু ঝুলে থাকা অন্ধকারের কথা; আর নিজের মনোজগতের একটাই সুপ্ত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে এই বলে যে-‘মাঝে মধ্যে আমি ভাবি, আমার বন্ধুদের কাছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখী দিনটি সম্পর্কে জানতে চাইবো;’ এই অদ্ভুত ইচ্ছেটাই কি আমাদের এই উত্তম পুরুষ আমি’র যাবতীয় মানসিক অস্থিরতা এবং মানসিক চৈতন্যকে জাগিয়ে তুলেছে? সুখ কোথায়, সুখের দিন কোনটা-সত্যিই কি আমরা কেউ আদৌ জানি? ফলত অবদমিত সংক্রমণের ভেতর অশান্ত ও উত্তেজিত একধরনের আত্মপরিবর্তন নিয়েই উত্তম পুরুষ আমি একটা সময় স্পষ্টতাকেই বুঝেছে :

তার এই চলে যাওয়ার ধরনের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আমি তাকে চিনতামই না। এভাবে ভাবাটাও অবশ্য ঠিক নয়। আমি তাকে সেই বয়সে ততখানিই চিনতাম, যতখানি একজন বন্ধু আরেক বন্ধুকে চিনতে পারে। মানুষ পাল্টায়। সে পাল্টিয়ে কোন মানুষটি হয়েছিল, সেটিই আসলে আমি জানতে পারিনি। তবে আমি মনে করি না বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, ঋণ ইত্যাকার সুনির্দিষ্ট প্রদর্শনযোগ্য কোনো কারণে সে আত্মহত্যাটি করেছে। এটা ছিল অবশ্যই অন্য কিছু। সেই অন্যকিছুটাই শুধু বুঝতে পারছিলাম না...

আসলে সামাজিক সুখ এবং সুখস্থাপনের জন্মবৃত্তান্ত, তার প্রহসন ও প্রহেলিকা, তার শূন্যতা ও অর্থহীনতা-কে বোঝে? কজন বোঝে? এই বোঝা না-বোঝার অতৃপ্ত রহস্যময়তা থেকেই হয়তো আমজাদ লিখে গিয়েছিল এমন কথা-‘যদি মনে করতে পারতাম, কখন সুখী ছিলাম, তাহলে হয়তো আবার সুখী হয়ে উঠতে পারতাম।’ লক্ষণীয়, এই ‘সুখী হয়ে উঠতে পারতাম’ বাক্যবন্ধের মধ্যেই কিন্তু নিহিত রয়েছে আমজাদের অবদমিত কষ্টবোধ এবং সেই সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক বিচরণজাত রহস্যময়তা; অর্থাৎ আমজাদ পারিপার্শ্বিক জীবনসংযোগের প্রদীপে ও তেলে এমন কিছু একটা পেতে চেয়েছিল যা তাকে খুব ‘নির্ভার’ ও ‘আনন্দ-উড্ডীন’ করে রাখবে-যা কোনো একদিন সে বদ্ধ ক্লাসঘর থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখতে পেয়ে গিয়েছিল গরুচরানো অর্ধ-উলঙ্গ ছেলেগুলোর অকারণ ও আবরণ হুটোপুটির মধ্যে-তৎক্ষণাৎ সে-ও মনে মনে তাদেরই সঙ্গে এমন আশ্চর্য নির্ভার সুখে উড়ন্ত হতে পেরেছিল-কিন্তু তারপর? কিচ্ছু নেই কিচ্ছু না; এই কিচ্ছু নেই কিচ্ছু না-টাই বড় ব্যাপার-কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না; আমজাদ বুঝেছিল এবং বুঝেছিল বলেই লিখেছিল-‘সুখী হয়ে উঠতে পারতাম’; তার মানে এ-ও সত্য-আমজাদও সুখী হতে চেয়েছিল-কিন্তু হয়ে উঠতে পারেনি-আর পারেনি বলেই তার এই লিখিত স্বীকারোক্তি, তার এই লিখিত রহস্যময়তা; তার মানে সময় সমাজ ও সমকালের সুখসম্পর্কিত চাহিদা ও ধারণার সঙ্গে তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কিছুতেই মিলছিল না; ‘উঠতে পারতাম’ আর ‘হয়ে উঠলাম’-এই দুইয়ের মধ্যবর্তী ব্যবধান দীর্ঘ থেকে যত দীর্ঘতর হয়েছে—আমজাদ হয়তোবা ততই ভেতরে-ভেতরে তার এই অবদমিত কষ্টবোধ নিয়ে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে হারিয়ে যাবার কথা ভেবেছে, যে হারানোর সুখপ্রদ অন্তর্গত দীপ্তি ও দিশা নিয়ে সে অন্তত একবার সহজ ও সহজিয়া আনন্দে সব চিরে দিয়ে সব ছিঁড়ে দিয়ে সাজানো-গোছানো সুসজ্জিত অন্ধকার ভেঙে দিয়ে বলে উঠতে পারবে, একবার অন্তত একবার-‘আমি হারিয়ে গেছি’। কিন্তু এ রকম সহজ ও সহজিয়া আনন্দে হারাবার জায়গা আধুনিক সমকালে কোথায়? আধুনিক বাস্তবেই-বা কোথায়? এইখানে বস্তুবিশ্ব ও ভোগ্যপণ্যতাড়িত জীবন আছে-কিন্তু কোথাও হারাবার মতো কোনো স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্তি নেই; সময় সমাজ ও সমকাল সব সময় উদ্দেশ্য নিয়েই চলে-কখনো উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না; আমজাদ হয়তো এই উদ্দেশ্যহীনতার ভেতর উড়ন্ত সুখ ধরতে চেয়েছিল-কিন্তু উদ্দেশ্যহীনতাকে পুরোপুরি না পাওয়ার অবদমিত কষ্টবোধ ছাড়া সে হয়তো আদ্যোপান্ত কিছুই পায়নি; একটু ঘুরিয়ে এ-ও বলা যায়-নীরেন্দ্রনাথের অমলকান্তি যেমন ‘রোদ্দুর’ হতে চেয়েছিল, কাজী আনিসের আমজাদও হয়তোবা এমনই এক চিরকালীন উদ্দেশ্যহীনতা হতে চেয়েছিল; কিন্তু নিষ্ঠুর সমকাল ও তার প্রাতিষ্ঠানিক মাছ ধরবার জাল এত বৃহৎ এত প্রসারিত যে আমজাদ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই হয়তো নিজের ভেতর বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি তার এই উড়ন্ত সুখের উদ্দেশ্যহীনতা কিংবা ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’কে; সুতরাং কী করবে সে? কোথায় যাবে সে? প্রাতিষ্ঠানিক জালের ভেতর আত্মক্ষরণ এবং রক্তক্ষরণের যে ইতিহাস চাপা পড়ে আছে-আমজাদ হয়তোবা সেই প্রতিষ্ঠিত রীতির শাসন ও সোহাগের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল; হয়তো তারই স্বরূপ ও অভ্যন্তরস্থ মাকড়সার জাল দেখেই আমজাদ লিখতে প্রায় বাধ্য হয়েছিল-‘সুখী হয়ে উঠতে পারতাম’; সত্যি বলতে তার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই আমজাদকে কি এতটুকু চিনতে বা বুঝতে পেরেছিল উত্তম পুরুষের আমি? পারেনি; আর পারেনি বলেই বলে :

সে নীরব থাকত, তবে চিন্তাগ্রস্ত থাকত বলে মনে হয় না। সে সামাজিক কর্মকাণ্ডে থাকত, তবে ‘আরে দোস্ত’-জাতীয় কথাবার্তা তার খুব ছিল না। সে মেশামেশিতে ছিল, তবে হই-হল্লায় জমিয়ে রাখার যোগ্যতায় খুব ছিল না। সে কর্মে সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিল, তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষিও ছিল না এবং বৈষয়িকভাবে সফলও ছিল না। আসলে সে কেমন ছিল, তার পুরোটা আমার জানা ছিল না বলেই মনে হয়...আমি জানতাম না সে ঠিক কেন আমার অফিসে আসত...

আসলে এই কথনপ্রক্রিয়ার সময় উত্তম পুরুষের আমি বোঝেনি উদ্দেশ্যহীন বাদলদের পুরোটা কখনোই সে জানতে পারবে না-বুঝতে পারবে না; কারণ, উদ্দেশ্যকে জানা যায়-বোঝা যায়-উদ্দেশ্যহীনকে নয়-কোথাও নয়-কখনোই নয়; উত্তম পুরুষের আমি ঠিকই বলেছে-‘সে নীরব থাকত’। বুঝতে চাইলে বোঝা সম্ভব কেন সে নীরব-আসলে এই ‘নীরব’ তো একটা ধ্যান ও মগ্নতা-উদ্দেশ্যহীনতাকে জানার ও পাওয়ার; কিংবা প্রতিবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এই ‘নীরব’ও হয়তো একটা পাল্টা প্রত্যাঘাত। হতে পারে-হতে পারে-সবই হতে পারে-কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক যজ্ঞকুণ্ডে বসে এই সত্য উত্তম পুরুষের আমি বুঝবে কেমন করে? বোঝেনি বোঝেনি। আর বোঝেনি বলেই তো একটা চাপা অস্বস্তি একটা চাপা জিজ্ঞাসা সারাক্ষণ তাকে ঘর থেকে অফিস, অফিস থেকে ঘর-তাড়া করে ফিরেছে; এই তাড়াই ক্রমশ হয়ে উঠেছে মানসিক তাড়নার কারণ; ফলে বন্ধুবান্ধব থেকে সরে বা বিযুক্ত হয়ে এত দিন উত্তম পুরুষের আমি বেশ ছিল তার মাল্টিন্যাশনাল চকলেট ও মিষ্টি দ্রব্য নিয়ে, বেশ ছিল তার মিটিং ও বিজ্ঞাপনের শুটিং নিয়ে; বউ রীতা, পাঁচ বছরের ইংলিশ মিডিয়াম ছেলে এবং চলন্ত গাড়ির কাচ দিয়ে পারিপার্শ্বিক জীবন দেখতে দেখতে বেশ স্বাভাবিক একটা স্থিতাবস্থার ছন্দ পেয়ে গিয়েছিল সে; অপ্রয়োজনীয় আড্ডা আর হা-পিত্যেশ সঙ্গদোষ-এসব তার পদস্থ জীবনের মধ্যে কোনোভাবে ঢুকে পড়ুক এমনটা কখনোই চায়নি সে; নিজেকে ‘বেখাপ্পা’ ও ‘বেহুদা’ করে তোলা একদমই কাম্য সংকল্প ছিল না তার কোনো দিন এবং কোনোকালেও। জীবন একটা পরম উৎপাদিত প্রাপ্তি-একে হাস্যকর খেয়ালখুশির দ্বারা নষ্ট করতে বা বিপদগ্রস্ত করে তুলতে আদৌ আগ্রহী ছিল না সে; তাই নিজের জীবনের চারপাশটাকে সর্বদাই সে বিরক্তিহীন বা উপদ্রবহীন করে তুলেছিল। জরুরি বিষয় ছাড়া কোনো সংস্রব বা কোনো রকম সংসর্গকেই আমল দেয়া স্বভাবধর্মও নয় তার; কী দরকার আনন্দ-উড্ডীন খেয়ালখুশির? কী দরকার উদ্দেশ্যহীন সুখপ্রাপ্তির সন্ধানকাতরতার? এসবের থেকে ঢের ভালো জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, বিদেশ সফর; এসবের থেকে ঢের ভালো টাই আলগা, চুল ওড়ানো, একা একা মসৃণ গাড়ি চালানো; কী আশ্চর্য! এই গাড়ি চালানোর কথা বলতে বলতে আবার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই কিয়োরোস্তামির গাড়ি চালানোর কথা; বদির কথা; দুজনের গাড়ি চালানোর উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ে কতই না তফাত, কতই না ফারাক; এই ফারাক কালও ছিল-আজও সমানভাবেই আছে; আর এই ফারাক আছে বলেই তো উত্তম পুরুষের আমি ব্যক্তিগত আত্মবিশ্লেষণ মুহূর্তে আমাদের একসময় বলেও দেয় :

আমি চিঠিগুলো আবার পড়েছি। দ্বিতীয়বার পড়ার সময় আমজাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বিষয়ে অনেক কিছুই মনে পড়েছে। আমজাদ, মোনেম এবং আমি অন্যদের চেয়ে একটু বেশি চিন্তাশীল ছিলাম। ঐ বয়সে ছেলেরা যে বইগুলো পড়ে, আমরাও তার কিছু কিছু পড়েছি এবং পড়ার শেষে একে অপরের কাছে জানতে চেয়েছি : কী জিনিস একটা জীবনকে সুন্দর কিংবা অর্থময় করে তোলে? একটি সুখী জীবনকে কি একই সাথে অর্থময়? বিষয় দুটো কি দুমুখো? বেশির ভাগ সামলে নেওয়া বয়স্কদের মতোই আমিও এ প্রশ্নগুলো পেছনে ফেলে আসতে পেরেছি। আমজাদ পারেনি ...

‘সামলে নেওয়া’ বাক্যবন্ধটি অবশ্যই লক্ষ করবার মতো; অর্থাৎ উত্তম পুরুষের আমি যথাসময়ে জীবনের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক নাগরদোলায় উঠে চাওয়া-পাওয়ার ভারসাম্য ঠিকই খুঁজে নিতে পেরেছিল এবং পেরেছিল বলেই আজ সে সফল, আজ সে প্রতিষ্ঠি; সুতরাং ঘুরন্ত ও চলন্ত নাগরদোলায় বসে অনেক অনেক উঁচু থেকে জাগ্রত প্রশ্নগুলো একদম নিচে ফেলে দিতে তার মধ্যে আর কোনো দ্বিধা জাগেনি; সাফল্যের চূড়ায় উঠতে গেলে এবং থাকতে গেলে এটাই নিয়ম-এটাই প্রতিষ্ঠিত রীতি; এর বাইরে সে যায়নি-যেতে চায়নি-এবং নিজেকে এ-ও নিশ্চয়ই বুঝিয়েছে-কেন যাব? আমজাদ এইভাবে ভাবেনি-হয়তো ভাবতে ঠিকমতো পারেওনি; তাই উত্তম পুরুষের ‘আমি’র মতো নিঃসংকোচে ও নির্দ্বিধায় অস্তিত্বের ভেতরকার প্রশ্নগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেও দিতে পারেনি; উত্তম পুরুষের আমি যা পারবে সজ্ঞানে ও সচেতনে, আমজাদ তা পারবেই-বা কেন? এসব প্রশ্ন কিন্তু কাজী আনিস রেখে দিয়েছেন তাঁর লিখনপ্রক্রিয়ার চরম অভ্যন্তরে ...

 

কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলতে হয়, উত্তম পুরুষের আমি যতই বলুক ‘বেশির ভাগ সামলে নেওয়া বয়স্কদের মতোই আমিও প্রশ্নগুলো পেছনে ফেলে আসতে পেরেছি’-আমজাদের আত্মহত্যার পর, তার দশ-বারোটা ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো লেখা পড়বার পর, প্রশ্ন জাগে-সত্যিই কি পেরেছে? প্রশ্নগুলো পেছনে ফেলে আসতে সত্যিই কি পেরেছে? যদি সত্যি সত্যি সে প্রশ্নগুলো ফেলে আসতে পারত, মুছে দিতে পারত-তাহলে কি এইভাবে তার মধ্যে আবার একটা প্রশ্নসঞ্চারিত বিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় সত্তা আদৌ জন্ম নিত? কিংবা আমরাও কি পেতাম এই নতুন উদ্ভূত দ্বিতীয় সত্তার আত্মসমীক্ষণ ও আত্মপরিক্রমণ? নিঃসন্দেহে নয়; মনে রাখতে হবে, সব সময় যে উত্তম পুরুষ আমি’র এই দ্বিতীয় সত্তার জন্ম বা উদ্ভব কিন্তু আমজাদের আত্মহত্যার জন্য নয়-তার থেকেও অনেক অনেক বেশি আমজাদের ওই ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো টুকরো লেখাগুলোর জন্য—যাকে বলা যায় একই সঙ্গে সংক্রমণ ও প্রতিক্রিয়ার ফল; সত্যি কথা বলতে আমজাদের মতো মানুষেরা আত্মহত্যা করল কি করল না-বেঁচে রইল কি রইল না-জীবনের সঙ্গে দৌড়াল কি দৌড়াল না-এসব তথ্য ও তত্ত্বের সেই অর্থে কোনো মূল্যই নেই উত্তম পুরুষ আমি’র কাছে; প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা, রীতি, বাণিজ্য ও লভ্যাংশের মধ্যে ক্রমাগত আবর্তনকারী উত্তম পুরুষদের এই সব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত ও চিন্তিত হবার মতো সময় ও মানসিকতা একেবারেই নেই; কারণ, কী হবে এদের নিয়ে ভেবে? এই সব নিয়ে ভেবে? সুতরাং উত্তম পুরুষ আমি’র কাছে আমজাদের আত্মহত্যা নিছক একটা সংবাদমাত্র অন্য সব দশটা-পাঁচটা খবরের মতো-গুরুত্বহীন ও তাৎপর্যহীন; বাদলের মাধ্যমে বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আত্মহত্যার এই খবরটা তার কানে এলে সে বড়জোর একটু আহা-উঁহু সহানুভূতি দেখাত মাত্র-তারপর নানাবিধ প্রাত্যহিক রাশিফলের ভেতর আজ হোক বা কাল-একসময় ভুলেই যেত; কারণ, এই ঘটনাটা মনে করে রাখবার মতো ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা তার বিন্দুমাত্র নেই-যেহেতু এই ঘটনাটা কোনো আয় দেবে না, কোনো লাভ দেবে না-যেহেতু এই ঘটনাটা নিংড়ে নিংড়ে সেই অর্থে কোনো রকম সমকালীন চাহিদাও পূরণ হবে না-সুতরাং মনে রাখবার দরকার কী? সুতরাং বলাই যায়-এই ঘটনার কোনো রকমই লেন-দেনের সমকালীন কার্যকারিতা নেই; আর যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাবাদে কোনো রকম কাজে দেবে না-লামার্কের তত্ত্বের মতো সে তো খসে পড়বেই; সুতরাং আমজাদের আত্মহত্যায় উত্তম পুরুষ আমি’র কোনো কিছুই যায়-আসত না-যদি না বাদল কর্তৃক তার হাতে আমজাদের খাম পৌঁছত, যদি না বাদল কর্তৃক ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দধ্বনির টুকরো টুকরো লিখনাংশ পৌঁছত। মুখ্যত তাই আমজাদের আত্মহত্যা নয়-উত্তম পুরুষ আমি’কে বিব্রত করেছে, সংক্রমিত করেছে, এমনকি ভেতরসত্তাকে অনেকখানি প্রশ্নতাড়িত বিপর্যস্তও করেছে ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো টুকরো এই সব লিখনাংশ, যে লিখনাংশ শুধু চেয়েছিল যান্ত্রিক জীবনের ভেতর-‘একটুকরো সুখী সময়’; এই নীরব চাওয়াটাই, এই নিঃশব্দ চাওয়াটাই আসলে একটা মানবীয় জিজ্ঞাসা ও প্রত্যাশার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি; উত্তম পুরুষের আমি এই অহর্নিশ ধ্বনি প্রতিধ্বনির দ্বারাই ভেতরে-বাইরে আক্রান্ত হয়েছে এবং এই আক্রান্তের জন্যই তার ভেতর-ভেতর উদ্ভূত হয়েছে আর একটা দ্বিতীয় সত্তা, যে সত্তা একসময় স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয়-‘অফিসে আসা-যাওয়ার পথে যে সময়টায় আগে খবরের কাগজ দেখতাম, সে সময়টায় এখন আমি আমজাদকে নিয়ে ভাবি।’ এই স্বীকারোক্তি অবশ্যই মারাত্মক-কারণ, এইখান থেকেই দেখা যাচ্ছে উত্তম পুরুষ আমি’র জন্মপ্রাপ্ত দ্বিতীয় সত্তা; বলতে দ্বিধা নেই-পূর্বকালীন প্রথম সত্তা কি এইভাবে কখনো চলতে ফিরতে চলতে-ফিরতে আমজাদ নিয়ে এতটুকু ভেবেছিল? ভাববার প্রয়োজন ও আবশ্যকতা অনুভব করেছিল? করেনি-করেনি; যে আমজাদ উত্তম পুরুষ আমি’র প্রথম সত্তা থেকে একদম সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছিল-নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল-সেই আমজাদই টুকরো টুকরো লিখনাংশ নিয়ে নতুন করে নতুন স্বরূপেই যেন ফিরে এল উত্তম পুরুষ আমি’র দ্বিতীয় আগত সত্তার ভেতর; অর্থাৎ স্থানচ্যুত হয়েও আমজাদের মতো মানুষেরা যেনবা কিছুতেই স্থানচ্যুত হয় না-রয়ে যায় থেকে যায় অবচেতনের নিম্ন তলদেশে-গাঢ় অন্ধকারে; আর এই সব দেখতে দেখতে আবারও মনে পড়ে যায়-আমজাদরা চিরকাল হয়তো উদ্দেশ্যহীন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল সেই অমলকান্তির মতো-আমরাই তাদের যুগে যুগে বারবার স্থানচ্যুত করবার তীব্র ও আপ্রাণ প্রয়াসে ক্রমাগত বুদ্বুদ ছড়াতে ছড়াতে একটানা বলে গেছি-‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়-মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়;’ তবু সে প্রচ্ছন্ন বীজের মতোই রয়ে যায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার যাবতীয় নির্মম ও কঠিন নিষ্পেষণের ভেতরেও-অঙ্কুরিত হয়-ক্রমাগত অঙ্কুরিত হয়-আর এই অঙ্কুরোদ্গম প্রতিহত করতে না পেরেই উত্তম পুরুষ আমি’র ভেতর মূর্ত হয়ে ওঠে দ্বিতীয় কোনো মন, দ্বিতীয় কোনো সত্তা; একই অনস্বীকার্য : উত্তম পুরুষ আমি’র ভেতর এই দ্বিতীয় সত্তার আবির্ভাব খুব খুব জরুরি ও অনিবার্য ছিল; কারণ, এই দ্বিতীয় সত্তার নিঃশব্দ উপস্থিতি ও আবির্ভাব থেকেই উত্তম পুরুষ আমি’র হৃষ্টপুষ্ট জীবনে পরপর দুটো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে-যা প্রথম আমি’র ঢাকনা ও মৌচাক ভেঙে না গেলে দেখা বা বোঝা কোনোটাই কিছুতেই সম্ভব হতো না-এই সূত্রেই প্রথম আমি’র বাঁকবদল কীভাবে ঘটে যাচ্ছে, কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে তার মনমানসিকতা-তার সঙ্গে ঘটনা দুটির সম্মুখস্থ উল্লেখ চূড়ান্ত আবশ্যক :

প্রথমত, আমরা দেখতে পাচ্ছি বাদল এসেছে উত্তম পুরুষ আমি’র কর্মক্ষেত্র; আমজাদ ও তার লিখনাংশ নিয়ে দু-একটা কথাবার্তা আলগোছে চলবার পর বাদল যখন চলে যাচ্ছে-প্রথম ঘটনাটা ঠিক সেই সময়েই ঘটে গেল চমকপ্রদভাবে; আমরা দেখলাম-উত্তম পুরুষ আমি কথা বলতে বলতে দরজার কাছ পর্যন্ত চলে এসেছে, এইবার বাদল চলে যাবে, ঠিক তখনই উত্তম পুরুষ আমি আকস্মিকভাবে বাদলের হাতটা চেপে ধরল এবং প্রশ্ন করল আচম্বিতে-‘আচ্ছা বাদল, তুমি কি সুখী?’ বুঝতে অসুবিধা হয় না-এই প্রশ্নটা উত্তম পুরুষ আমি’র ভেতর উদ্ভূত দ্বিতীয় সত্তাটিই করছে; প্রথম সত্তাটি ভেতরে-ভেতরে একইভাবে চলিষ্ণু ও বহমান থাকলে এই রকম প্রশ্ন কিন্তু কিছুতেই উঠে আসত না; লক্ষণীয়, বাদলও কিন্তু সমানভাবে অবাক ও বিস্মিত হয়েছে; কারণ, সে উত্তম পুরুষ আমি’র প্রথম সত্তাটাকেই চেনে জানে-ওর ভেতর যে দ্বিতীয় সত্তার জন্ম হচ্ছে-বাদল তা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি; তাই অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেছে-‘তুমি ঠিক আছো তো?’ ছোট্ট একটা সামান্য আঁচড়কাটা ঘটনা মাত্র-কিন্তু বলা দরকার অবশ্যই সুগভীর তাৎপর্যবাহী...

দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় ঘটনাটা আরও গভীর আরও সুদূরপ্রসারী; আমজাদের লিখনাংশ তখন উত্তম পুরুষ আমি’কে এমনভাবে গ্রাস ও আচ্ছন্ন করে নিয়েছে যে বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত অস্থির ও কণ্টকিত উত্তম পুরুষ আমি না পারছে অফিসের কাজ ঠিকমতো করতে, না পারছে আগের মতো নিশ্চিন্তে ও নির্বিবাদে বাড়ি ফিরতে; একটা অদ্ভুত অস্থিরতা শরীরে ও মনে এমনভাবে গেঁথে বসেছে যে উত্তম পুরুষ আমি রাস্তায় রাস্তায় লক্ষ্যহীনভাবে গাড়ি চালানোর অকারণ শ্রম ছাড়া আর কিছুই যেন স্বাভাবিকভাবে করে উঠতে পারছে না; এত দিন ধরে যার লক্ষ্য স্থির-উদ্দেশ্য স্থির-সে-ই কিনা লক্ষ্যহীন? সে-ই কিনা উদ্দেশ্যহীন? ভাবলেও চমকে উঠতে হয়; সেই চমক নিয়েই আমরা দেখতে পাই-উত্তম পুরুষ আমি আজকাল প্রায়শই বাড়ি ফিরতে দেরি করছে-রাতও করছে; এ রকমই একদিন আমরা দেখলাম উত্তম পুরুষ উদ্ভ্রান্ত আমি অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছে-রাতের খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে বউ রীতা পুত্রকে নিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে-উত্তম পুরুষ আমি পা থেকে মোজা না খুলেই ঘুমন্ত ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে-দেখতে পায় ডিমলাইটের নিচে ঘুমের ভেতর শ্বাস নিচ্ছে বউ ও ছেলে; ওই যূথবদ্ধ শ্বাসধ্বনি শুনতে শুনতে ওদের দিকে তাকিয়ে উত্তম পুরুষ আকস্মিক স্তব্ধ হয়ে যায়-তার মনে হতে থাকে-এই দুজনই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ-কিন্তু এত গভীর ও প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও হঠাৎই তার মনোজগতের কোনো গভীর স্তরে সুপ্ত মনোবীজ তীক্ষ্ণ ও তীব্রভাবে বের হয়ে আসে; যেন উন্মুক্ত তরবারির চকিত চিক্কন ধারালো ও শাণিত একটা প্রশ্ন তার ভেতরটাকে তোলপাড় করতে থাকে-তোলপাড় তোলপাড়-সে কী তোলপাড়-এই অসম্ভব তোলপাড় থেকেই একসময় নিজেকে নিজেই সে প্রশ্ন করে-‘সব ভালোবাসা সত্ত্বেও এদের কি আমি চিনি?’ ভয়ংকর আত্মঘাতী এই প্রশ্ন; বলা বাহুল্য-এই প্রশ্ন উত্তম পুরুষ আমি’র প্রথম সত্তার নয়-অবশ্যই অবশ্যই নতুন জাগ্রত সত্তার, অর্থাৎ দ্বিতীয় আবিভর্‚ত সত্তার...

তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যায় এই রকম পরিস্থিতিতে জীবনানন্দের আমিও স্তব্ধ বিস্ময়জাত বিপন্নতায় একদিন বলে উঠেছিল-‘নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;’ বলে উঠেছিল-‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে;’ বধূ ও মননের মধু দুই-ই প্রত্যাখ্যান করে সেদিন সে দড়ি হাতে চলে গিয়েছিল কোনো এক অশ্বত্থগাছের দিকে; সে এক অন্য কাহিনি-সে এক অন্য ইতিহাস; কাজী আনিসের উত্তম পুরুষ এই আমি’র ভেতর যখন থেকে এবং যেদিন থেকে দ্বিতীয় সত্তার উদ্ভব ঘটেছে-মূলত সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে তার এই ধরনের প্রশ্নমুখী জীবনদংশন, এই ধরনের প্রশ্নতল্লাশি চেতনাদংশন; এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যত দিন জীবন থাকবে, যত দিন মানুষ থাকবে, তত দিন, বারবার ঘুরেফিরে ঘুরেফিরে এই সুতীক্ষè প্রশ্নটি নানা পর্বে নানা পর্বান্তরে কিছু কিছু মানুষের চেতনাজগৎ থেকে সামগ্রিকভাবে উত্থাপিত হবেই-‘সব ভালোবাসা সত্ত্বেও এদের কি আমি চিনি?’ কাজী আনিসের লিখনপ্রক্রিয়া তাই কোথাও কোনো গল্প বলেনি, বলবার চেষ্টাও করেনি, শুধু তাঁর এই প্রশ্নসন্ধানী লিখনপ্রক্রিয়া সংসর্গে ও সংযোগে একটু একটু করে মিশে গেছে উত্তম পুরুষ আমি’র চেতনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে; এইটেই তাঁর ঐকান্তিক বিশেষত্ব; লিখনপ্রক্রিয়া ও চেতনপ্রক্রিয়া এইভাবে মিশ্রিত ও একাকার হলে বোঝা যায়-সমস্যাটা কারও একার নয়-উত্তম পুরুষ আমি’র যেমন, কাজী আনিসেরও তেমন; আবার কাজী আনিসের যেমন, আমাদেরও কারও কারও তেমন; লিখনপ্রক্রিয়া এভাবেই চেতনপ্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠে নির্বিশেষে হয়ে যায়; তাই ‘সব ভালোবাসা সত্ত্বেও এদের কি আমি চিনি?’-এই দীর্ঘ প্রশ্ন আমি’র স্তব্ধ অবলোকন বিশ্লেষণ করতে করতে খুব সংগত ও স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে পড়ে যাবে ইয়েটসের ‘হোয়াট দ্যান’ নামের কবিতাটা।

আসলে সাফল্যের পর সাফল্য, একটার পর একটা সাফল্য-মই এবং ভারসাম্য-মানুষ ওঠে-কোনো কোনো মানুষ উঠে যায়-কিন্তু কোথায় যায়? কোথায় পৌঁছায়? একটা প্রত্যাশা চরিতার্থ হবার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে আরও আরও চাওয়া ও পাওয়ার অভ্যন্তরীণ একমাত্রিক তৃষ্ণা; এই অচরিতার্থ তৃষ্ণা থেকেই একসময় মানুষ এমনই অন্ধ ও উন্মাদ হয়ে যায় যে চারপাশ সম্বন্ধে তার আর কোনো আশ্রয়ই থাকে না; আর এখান থেকেই বারবার প্রশ্নটা নানাবিধ তরঙ্গে ভেসে আসতে থাকে-তারপর? তারপর? তারপর? উত্তম পুরুষ আমি’র সঙ্গে ঠিক এইখান থেকেই আত্মহত্যাকারী আমজাদের মধ্যবর্তী তফাত ঘটে যায়; এই তফাতটাই প্রথম দিকে বুঝতে পারেনি উত্তম পুরুষের আমি; তাই আমজাদের উদ্দেশ্যহীন নীরব অথব অস্তিবাদী অবস্থান সে ধরতে পারেনি; আমজাদ তার উদ্দেশ্যহীন অস্তিত্বের নীরবতা দিয়ে, আমজাদ তার উদ্দেশ্যহীন অস্তিত্বের উড়ন্ত মুখ দিয়ে বৈজ্ঞানিক আধুনিকতাবাদের দিকে প্রতিনিয়ত যে বার্তা প্রেরণ করেছে-সেই বার্তা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চক্রব্যূহ ভেদ করে কীভাবে শুনতে পারে উত্তম পুরুষের এই নিছক আমি কে? নির্ভার ও আনন্দ-উড্ডীন আমজাদের খেয়ালখুশি প্রথাবদ্ধ বাস্তবতার স্থূলতর আমোদ-আহ্লাদ দিয়ে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়; উত্তম পুরুষের আমিও তাই সাজানো-গোছানো সুসজ্জিত জীবনকে আঁকড়েই ভেবে নিয়েছে-‘পৃথিবীর অবিচলিত পঞ্জর’; কিন্তু আমজাদের আত্মহত্যার পর, আমজাদের লিখনাংশ পড়বার পর দ্বিখণ্ডিত এই উত্তম পুরুষ, দ্বিখণ্ডিত এই উত্তম পুরুষের আমি-তাকে কি এরপর কেউ আর মাল্টিন্যাশনালের চক্রব্যূহে পূর্ববর্তী সত্তা নিয়ে বাণিজ্যের লভ্যাংশের ভেতর একইভাবে বসে থাকতে দেখবে? হয়তো নয়-কারণ, উত্তম পুরুষের প্রথম আমি এবং উত্তম পুরুষের দ্বিতীয় আমি যে আর কিছুতেই এক নয়-সমার্থক নয়; তাই বলা যায়-একদিন যে উত্তম পুরুষের আমি আলোর আলেয়ার মধ্যে ডুবে ছিল মজ্জাগত রক্ত-মাংস-প্রতিষ্ঠা নিয়ে, সেই উত্তম পুরুষের আমি’র কাছে এইবার যখনই যতবার বাদল যাবে, দেখবে-আমজাদের মতোই আর একটা নীরব জীবন ছিন্ন ছিন্ন লেখার টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে বসে আছে; শুধু আমজাদ কেন-দৃষ্টিঘ্রাণ আরও একটু বাড়ালে বাদলের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দেখতে পাব-উত্তম পুরুষ এই আমি’র মধ্যে কখন যেন উড়ে এসে বসে পড়েছে আরও আরও একজন-যার নাম অবশ্যই রামকমল-কাজী আনিস যে রামকমলকে আমাদের নিকটস্থ হৃদয় করে তুলেছেন তাঁর ‘রামকমলের উপহার’ নামের আরও একটি লিখনপ্রক্রিয়ায়; কে এই রামকমল? সে আসলে একটা অসমাপ্ত স্বপ্ন, একটা প্রস্তাবিত মহাপাণ্ডুলিপি, একটা নতুন কিছু সৃষ্টির অমীমাংসিত প্রণোদনা; আসলে মনে রাখতে হবে-আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই যেমন একটা উত্তম পুরুষের আমি তার ক্ষুধা, লোভ, স্বার্থ নিয়ে বসে আছে— তেমনই কিন্তু সুপ্ত হয়ে আছে আমজাদ অথবা রামকমলের মতো স্বপ্ন সৃষ্টি ও উদ্ভাবনার আমিও; ভেতরে-ভেতরে উভয়ের দ্বন্দ্ব হয়, উভয়ের যুদ্ধ হয়; এই দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমজাদ ও রামকমলেরা মূলত নিঃশব্দে লড়াই করে যায় সেই ‘অক্লান্ত সুবিধাবাদ’ এবং ‘অশ্রাব্য আত্মপরতার’ বিরুদ্ধে; কিন্তু আমরা বেশির ভাগ মানুষই তো বাসনা ও বাণিজ্যের দাস, মৈথুন ও মৃগনাভির দাস-জৈব জীবনের এবং প্রথাবদ্ধ বাস্তবের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠায় এমনভাবে ডুবে আছি যে আমজাদ বা রামকমলের আহ্বান বা হাতছানি কোনোভাবেই শুনতে পাই না-দেখতেও পাই না; আর তাই ক্ষোভে-দুঃখে আমাদের ভেতরেই অসহায় আমজাদ আত্মহত্যা করে কিংবা নিদারুণ অপমানে রামকমলও একদিন তার সেই মহাপাণ্ডুলিপির প্রস্তাব ও পরিকল্পনা অসমাপ্ত রেখেই হঠাৎ আমাদের ভেতরেই হারিয়ে যায়-অদৃশ্য হয়ে যায়; কিংবা এ-ও বলা যায়-আমরাই স্থ‚লতর জীবনের বাস্তব চাহিদা দিয়ে এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠার হিসাবনিকাশ দিয়ে ভেতরে-ভেতরে কখনো হত্যা করি আমজাদকে, আবার কখনো গলা টিপে মেরে দিই আশ্চর্যের রামকমলকে; এই কথাগুলো বলবার কারণ একটাই এবং তা হলো-কাজী আনিস রচিত ‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন’ এবং ‘রামকমলের উপহার’ এই দুই লিখনপ্রক্রিয়াই আসলে একে অপরের পরিপূরক-যেমনটা জীবনানন্দের ‘বোধ’ এবং ‘আট বছর আগের একদিন’; আর এ জন্যই মনে হয়-‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন’ পাঠ করতে করতে আমাদের অবশ্যই প্রবেশ করতে হবে তাঁর ‘রামকমলের উপহার’ নামের চেতনপ্রক্রিয়ায়; আর এইটুকু যথার্থ অর্থে ঠিকঠাক পালন করতে পারলে আমরা কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাব-আমাদের সামনেই প্রত্যক্ষভাবে দাঁড়িয়ে আছে একজন উত্তম পুরুষের বস্তুবাদী আমি-যার ভেতর সুপ্ত হয়ে প্রচ্ছন্ন হয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাসমানতায় ক্রমাগত ভেসে বেড়াচ্ছে একজন অসমাপ্ত আমজাদ কিংবা একজন অমীমাংসিত রামকমলের মতো মানুষ, আমাদের শুধু একটু প্রজ্ঞা ও চৈতন্য দিয়ে চিনে নিতে হবে-আমাদের শুধু একটু স্বপ্ন ও সন্ধান দিয়ে বুঝে নিতে হবে; আর তখনই আমরা পারব-যে প্রশ্নটা একদিন বাদলকে করেছিল উত্তম পুরুষের আমি-সেই প্রশ্নটা ঘুরিয়ে ঠিক তাকেই করতে;

—আচ্ছা উত্তম পুরুষের আমি, তুমি কি সুখী?

আরও পড়ুন :

ক্ষমতার পঠন : ইতিহাস আর উপন্যাসের বোঝাপড়া | সুমন রহমান

স্বপ্ন নেই, আশাভঙ্গও নেই | সেবন্তী ঘোষ 

বি-উপনিবেশায়নের জ্বালামুখ | হামীম কামরুল হক 

দোটানার বৃত্ত | আফসানা বেগম 

বিস্ময়মুগ্ধতা ও ডুবসাঁতার | মোস্তাক আহমেদ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা