X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন নেই, আশাভঙ্গও নেই

সেবন্তী ঘোষ
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৯

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ-এর ৫০তম জন্মদিন আগামীকাল শনিবার। তার লেখালেখির সূচনা কৈশোরেই, বাংলা ও ইরেজি ভাষায়। ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকা প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউ-এ, ২০০০ সালে। গল্পগ্রন্থ ‘গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বাংলাদেশে প্রকাশ করে ইউপিএল, ২০১২ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা আননেম্ড প্রেস, ২০১৪ সালে। উপন্যাস ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ প্রকাশ করেছে ভিনটেজ/র‌্যানডম হাউজ, ২০১৩ সালে। তার সবগুলো বই কাগজ প্রকাশন থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

কাজী আনিস আহমেদের জন্ম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ঢাকাতেই, সেন্ট জোসেফ ও নটরডেম কলেজে। উচ্চতর শিক্ষা আমেরিকায়-ব্রাউন, ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে সাহিত্যে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা ট্রিবিউন-বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক।

কাজী আনিস আহমেদের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে কবি শামীম রেজার সম্পাদনায় বাতিঘর  প্রকাশ করছে একটি মূল্যায়ন-গ্রন্থ ‘অধরা বিশ্বের প্রতিভূ’। উক্ত সংকলন থেকে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। 

স্বপ্ন নেই, আশাভঙ্গও নেই ইংরেজি ভাষার গল্পকার কাজী আনিস আহমেদের ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার ও অন্যান্য গল্প’-এর অনুবাদ করেছেন কবি ও অধ্যাপক মুহম্মদ মুহসিন। গল্প সংকলনটি ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। মূল বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা একশ নব্বই। মুহম্মদ মুহসিন কর্তৃক বঙ্গানুবাদে একশ সত্তর। মোট গল্প নয়টি।

এই বাংলা অনুবাদটি পড়েই আমার দু-চার কথা লেখা। সমালোচনা না বলে একে আমার একটি পাঠ বলতে পারি। অনুবাদ অতি কঠিন কাজ। শব্দের সৌকুমার্য ভাষান্তরিত করা অসম্ভব। পাওয়া যায় গল্পটুকু, অর্থাৎ বর্ণিত বিষয়ের প্রতি লেখকের মনোভাব। তার চিন্তার ভঙ্গি, বাক্য গঠনের বৈশিষ্ট্য বা ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তার দর্শন কিন্তু অধরা থেকে যায়। সমালোচকের সমর্থন না পেলে, যে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে আমরা ঔপনিবেশিকতায় আবাল্য পরিচিত, তারও প্রশংসা করতে সাহস পাই না। পাতা উল্টে দেখে নিই কোন বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে বা মুখবন্ধ কে লিখেছেন! এমত অবস্থায় হাতে এসে পড়ল এই গ্রন্থটি। লেখক বাংলাদেশের মানুষ, অনুবাদকও তাই। মনে হলো অনুবাদক লেখকের চিন্তাজগতের পরিপ্রেক্ষিত খানিক সহজে ধরতে পারবেন। কাজী আনিস আহমেদ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। পৃথিবীব্যাপী সুবিখ্যাত সাহিত্য সভা ও আড্ডাগুলোতে তাঁর রচনার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর গল্পগুলোতে মূলত ঢাকা শহরের উচ্চবিত্ত বা ক্ষমতাবান জগতের একটা প্রেক্ষাপট আছে। কিন্তু ঐশ্বর্য্যরে ঝলকানির বদলে নিরাসক্তি, তীব্র নিঃসঙ্গতা আর বিচ্ছিন্নতার বোধই আচ্ছন্ন করে রাখবে পাঠককে।

আজকের বিচ্ছিন্ন লক্ষ্যহীন সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিফলন দেখতে পাই সেখানে। সুখী জীবনের তাবৎ উপকরণ নাগালের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাঁর চরিত্রগুলো অদ্ভুত বিষণ্ণতার ভেতর ডুবে থাকে। নিঃসঙ্গ মানুষের প্রেম তাঁকে অশান্ত করে তোলে, আশ্চর্য রকমভাবে সমুদ্রতলের আলোড়নের মতো অন্তরে থেকে যায়। পাঠক ওই ব্যক্তিচরিত্রের তীব্রতা দেখতে পান, কিন্তু চরিত্রের চারপাশের লোক তা টের পায় না। মহৎ হয়ে ওঠে না কেউ। এক যুদ্ধবিধ্বস্ত মহানগরীর গভীর অসুখ, হত্যালীলা, সম্মুখ এনকাউন্টার ছাড়াই দেখাতে পেরেছেন তিনি। নিচু স্বরে, নিরাবেগ ভঙ্গিতে সম্পর্কের ব্যর্থতা, বিচ্ছিন্নতা ও প্রয়াণ দেখিয়েছেন অধিকাংশ গল্পে।

অমিতাভ ঘোষের উপন্যাসে শাঁখারীটোলার যে দাঙ্গার রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা দেখি, সৈয়দ শামসুল হকের ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’তে যে একাত্তরের দমবন্ধ করা আবহাওয়া, যে তাজা লাশের গন্ধ পাওয়া যায়; আনিসের লেখায় তার একটা বিপরীত রূপ আছে। সেই লাশ এখানে অনুত্তেজিত ভঙ্গিতে মর্গের ভেতর কোনো বিচার বা চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে শুয়ে থাকে। যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছেন লেখক, তাতে এশীয় ধারণার আশাবাদ ও নিয়তির কোনো প্রবেশ-প্রস্থান নেই।

আনিস এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘আমি নিজেকে একজন রাজনৈতিক লেখক হিসেবে দাবি করতেই পারি। কারণ, রাজনীতি নিয়ে লেখা এবং জীবনের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় কোনো বাধা নেই।’ আনিসের চরিত্ররা ব্যক্তি রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীক রাজনীতির বিষয়ে অতি সচেতন।

ঢাকার বিবর্তিত বর্ধিত রূপ ও সমাজ, অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন, একাত্তরের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাতে মোড়া জীবন, যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থিরতা এবং উচ্চবর্গের ও রাজনৈতিক নেতাদের চূড়ান্ত দুর্নীতি অবরুদ্ধ ক্রোধের জন্ম দিয়েছে লেখকের মনে। স্বপ্ন নেই, ফলে আশাভঙ্গ নেই। প্রেমজাত অস্থিরতা আছে, নেই মানবিক বোধের উচ্চকিত ধারণা; যা একান্তভাবে মধ্যবিত্তের। অনাচারি শুভবোধের উন্নীত হওয়ার আশা তিনি বহু পেছনে ফেলে এসেছেন।

মনে পড়বে হারুকি মুরাকামির কথা, ‘আমার দায়িত্ব পৃথিবীর মানুষকে লক্ষ করা। তাদের বিচার করা নয়। একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া থেকে আমি নিজেকে বিরত রেখেছি। পৃথিবীতে প্রতিটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে রেখেছি আমি।’

ধরা যাক প্রথম গল্প ‘চামেলি’। খুব ক্লিশে মনে হলেও প্রথমে রবীন্দ্রনাথকেই মনে পড়বে গল্পটির বিষয় নির্বাচনে। ১৯৭০-এর উত্তাল সময়ে এক বাঙালি কিশোরের পাঞ্জাবি কিশোরীর প্রতি অপরূপ নৈতিকতা, শুদ্ধ এক প্রেম ও শ্রদ্ধা, যার বাবা পশ্চিম থেকে সেনাবাহিনীর কর্তা হিসেবে পুবে যোগ দিয়েছেন-খুবই ব্যতিক্রমী মনে হবে। রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট ইংরেজ ও বড় ইংরেজের ধারণা মনে পড়াবে। এমন সচেতনভাবে কামনারহিত প্রেম, নিকষিত হেম মেখে তেরো চৌদ্দ বছরের লাজুক অন্তর্মুখী বাঙালি কিশোরটিকে যে স্থৈর্য দিয়েছে, তা বয়স অনুপাতে বেসুরো লাগতে পারে। তবে একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মি অফিসারদের সংগঠিত ইতরামি, নারকীয় অত্যাচার ও পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে যেন ওই সময়ের এক বাঙালি কিশোরের মনে পাঞ্জাবি সেনা অফিসারের কন্যার প্রতি নির্মল স্নিগ্ধ অথচ তীব্র আকর্ষণ এক বৈপরীত্য সৃষ্টি করে।

এই কিশোরটির নামও ইঙ্গিতময়। গালিব। গালিব এতটাই স্পর্শকাতর যে পাঞ্জাবি মেয়েটিকে হৃদয় সমর্পণ করে তার গায়ে কোনো ইতর শব্দ দিয়েও মালিন্যের আঁচড় লাগতে দেয় না। যে বন্ধুদের রঙ্গরসিকতা তো কোন ছার, মা-বাবার সঙ্গেও তাকে নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী নয়। শুদ্ধ হৃদয় উৎসারিত অকৃত্রিম মনোবেদনায় তার এই হৃদয় সমর্পণ।

দুজনের সম্পর্ক বলতে লেকের ধারে পাথর কুড়িয়ে জলে টিপ করা আর খানিক হেঁটে বেড়ানো। মেয়েটির মা তাকে ও তার বাবাকে ছেড়ে অন্য সম্পর্কে চলে গেছে। বাড়ির উল্টো দিকে থাকা তাদের বাড়িতে গালিব একবারই সাহস করে উপস্থিত হয়। প্রথম দিকে সেদিকে কারও মন ছিল না। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই পাঞ্জাবিদের সঙ্গে মেলামেশা বাঙালির বাড়িতে আলোড়ন তুলল। চামেলিদের সঙ্গে গালিবকে মিশতে বারণ করা হলো। গালিবের মনে হলো, ‘এই লোকটা কে আর কেনই-বা সে এতক্ষণ তার সঙ্গে বকবক করল? কেন সে এত দিনে বুঝতে পারল না যে তার বাবাটা এমন বুনো কিছু? লোকটার সঙ্গে তার কি মিল আছে যে সে তার বাবা? তার বমি পেতে লাগল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল চামেলির সঙ্গে দেখা সে চালিয়েই যাবে। বাবার প্রতি যে ঘৃণা আজ সে অনুভব করল, কোনো দিন কোনো কিছুর প্রতি এত প্রবল ঘৃণা আর সে অনুভব করেনি।’

চামেলির বাড়িতে একবারই তার যাওয়া। সেখানেই আবার চামেলির শঙ্কা তার পাঞ্জাবি সেনা অফিসার বাবার আগমনের। চামেলির পাশে বসে অ্যালবাম দেখা ও তার কাপড়, ত্বক ও চুলের ঘ্রাণ পাওয়া, এতেই মাতোয়ারা গালিব। বাবার আসার সময় হয়ে যাওয়ায় বাধ্যত গালিব উঠে পড়ে। ‘একটি সবুজ শীতের আলো চতুর্দিক ঢেকে দিতে শুরু করল’, চামেলি বলল না যে গালিব যেন আর না আসে। ‘তবে গালিব বুঝল এখন যেতে হবে।’ বিদায় মুহূর্তটির পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেইলিং বিষণ্ণ বেদনায় বিধুর।

‘সে রাতে শহরের অন্য সবার মতো গালিবেরও ঘুম ভাঙল মর্টারের গোলা আর ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দে। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। বোঝা যাচ্ছিল উচ্চবিত্ত গালিবের পরিবার ওপারে তখনো নিরাপদ। পরের দিন মালি এলো। দিশেহারা চোখে শুধু আতঙ্ক। সে শুধু সারা শহর জোড়া লাশের কথা বলে যেতে থাকল। পরের দিন গালিব ও তার পরিবার শহর থেকে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যেই গালিব তার এই যুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়ে অজ্ঞানতা নিয়ে লজ্জিত হতে শুরু করেছে। নিজের রঙিন কল্পনার মোহে কী ভীষণ আচ্ছন্নই না হয়ে ছিল!’

গ্রামের বাড়ির দিকে চলে গেল তারা। বর্ষাকালের শেষ দিক থেকে শুরুতে শুরু করল বিজয়ের গল্প। পরিণতমনস্ক গালিব এখন জানে রাজনীতি আর ইতিহাস। নয় মাস পর যুদ্ধ শেষে যখন তারা ফিরে এলো ঢাকার বাসায়, গলির ওপারে চামেলির বাড়ি তখন ফাঁকা। যুদ্ধ পরিস্থিতে প্রেম হারানোর ‘স্থায়ী অমোচনীয় ব্যথার ক্ষত’ হয়ে থাকল শত্রুপক্ষ পাঞ্জাবিদের মেয়ে চামেলির ভেতর।

যেমন আমরা গ্রন্থের শীর্ষ নামের গল্পটি ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার’ নিয়ে দু-চার কথা আলোচনা করতে পারি। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীকে রুখে দিতে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন হেনরি কিসিঞ্জার। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশ ভ্রমণ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ আছে তাঁর ওপর। ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’-এ আমেরিকার সাংবাদিক ও লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স কিসিঞ্জারের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। তাঁকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যায়িত করেন। ইন্দোচীন, বাংলাদেশের সিলেট, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুরের মুক্তিকামী জনতাকে দমন, বিপ্লবীদের হত্যা করতে উৎসাহ দেয়া, উদ্বুদ্ধ করা, অপহরণ-নির্যাতন-প্রতিটি অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এহেন কিসিঞ্জার সংবাদ ও প্রচারমাধ্যম এড়িয়ে চলতেন। নিজেই লিখেছেন ‘ডিপ্লোমেসি’ গেমস তার প্রিয় ক্রীড়া।

হার্ভার্ডের এমএ, পিএইচডি কিসিঞ্জারের গবেষণাপত্র ছিল, পিস, লেজিটিমেসি অ্যান্ড দ্য ইকুইলিব্রিয়াম। গবেষণায় প্রথম লেজিটিমেসির ধারণা এভাবে জানালেন, একে বিচারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না! এটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। বৈদেশিক পলিসির একটা লক্ষ্য! এতদ্বারা মান্যতা পেল প্রতিটি মেজর পাওয়ার হলো লেজিটিমেট আর অন্যরা রিভল্যুশনারি বা ডেঞ্জারাস! যত দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বড় দেশ আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই হবে লেজিটিমেট। সেখানে জনগণের মতামত বা নীতি অপ্রাসঙ্গিক!

এহেন মানুষটি ভিয়েতনামের শান্তি ফেরাবার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন যৌথভাবে! সঙ্গে যিনি পেলেন সেই ভিয়েতনামের নেতা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন। কুখ্যাত নিক্সন টেপে এই শান্তি পুরস্কার প্রাপক স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে থাকা ভারতীয়দের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এত বড় বেজন্মা’, আর ইন্দিরা বিষয়ে ‘বিচ’ এবং বাংলাদেশ ‘বটমলেস বাস্কেট’! কম্বোডিয়ায় বেআইনিভাবে বোমা ফেলে গণহত্যা, চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত-এমন বহু ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়েছে।

এহেন কিসিঞ্জারকে নিয়ে নামগল্পে প্রবেশ করতে পারি আমরা। অনুবাদক বাটলার বলতে নরসুন্দর লিখেছেন। নরসুন্দর কিন্তু নাপিত। আমেরিকায় অভিবাসী একসময় বাংলাদেশের বেসরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক, বর্তমানে দ্য সলিস্টিস-এর মতো অভিজাত রেস্তোরাঁয় কাজ করা জেমসের এখানে দেখা হয় প্রায় বৃদ্ধ কিসিঞ্জারের সঙ্গে।

কিসিঞ্জার তার বাংলাদেশি ওয়েটার জেমস ডি-কস্তাকে মনে রাখেন সম্ভবত বাংলাদেশি হওয়ার কারণে। ‘অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির মতো আমিও মনে করি আমার দেশের ১৯৭১-এর গণহত্যার জন্য হেনরি কিসিঞ্জার অনেকখানি দায়ী’, যে অতীত ছেড়ে জেমস আমেরিকায় চলে আসে, তা তার পিছু ছাড়ে না। ‘কিন্তু আমার জানা উচিত ছিল যে কোনো কিছুই আসলে চিরতরে পেছনে ফেলে আসা যায় না... তখনই সেই অতীত একেবারে অজানা এক দিক থেকে এসে হেনরি কিসিঞ্জারের মূর্তিতে আমার সামনে দাঁড়াল।’

একদা ইংরেজির অধ্যাপক বর্তমানে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ওয়েটার জেমস, কিসিঞ্জারকে স্বাভাবিক কারণে এড়াতে চাইলেও তিনি এড়াতে দিলেন না। ‘আমি হয়তো কোনো অজ্ঞাত কারণে তার ভেতরে আমার বিষয়ে কোনো বিকৃত ঔৎসুক্যের জন্ম দিয়েছিলাম’। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সেই ভয়ংকর আক্রমণ সম্পর্কে তোমার ভাবনা কী?’ জেমস কিসিঞ্জারের সামনে না আসার দায়িত্ব থেকে সরে গেলেন। তা-ও তিনি ডেকে পাঠালেন, জেমসকে বিব্রত করে এবারে বললেন, ‘বাংলাদেশিরা যে সন্ত্রাসী তৎপরতায় ধরা পড়বে, তা একেবারেই সময়ের ব্যাপার মাত্র কি না!’

সামলাতে না পেরে জেমস বলে ফেলেন, ‘শুধু তৎপরতায় কেন? পুরো সন্ত্রাসটা ঘটিয়ে নয় কেন!’ কিসিঞ্জার হাসির সঙ্গে বললেন, ‘আমার মনে হয় না ও ততটা যোগ্যতা তাদের আছে।’ জেমসের প্রশমিত ক্রোধ ফিরে আসতে থাকে। এই ক্রোধের কারণেই শৈশব থেকে সে বিড়ম্বিত। একাত্তরের যুদ্ধে স্থানীয় চার্চের যাজক তার বাবাকে বাড়ির মধ্যে, তাদের চোখের সামনে খান সেনারা খুন করে। সঙ্গে ছিল স্থানীয় রাজাকাররা। জীবনটাই পাল্টে যায় জেমসের। অসহনীয় এক ক্রোধকে সঙ্গীকে করে বড় হয়ে ওঠে সে। হয়তো চূড়ান্ত অরাজকতা দেখেই কড়া নীতিবাগীশ ও রীতি-নিয়মের সমর্থক হয়ে ওঠে সে।

‘যখনই বিভাগে দেখা দিয়েছে কোনো নতুন প্রয়োজন আমি সেখানে সবার আগে গিয়ে দাঁড়িয়েছি’, বাথরুম করিডর নোংরা দেখলে কর্মচারীদের যাচ্ছেতাই বকাঝকা করেছে। ছাত্রদের অভিভাবক যারা অদায়িত্বশীল, তাদের ‘তৃপ্তি নিয়ে’ বকাঝকা করেছে। ফেল করা ছাত্রকে পাস করাতে কোনো চাপের কাছে মাথানত করেনি। এই মানুষটি একেবারেই মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের মানুষ নয়। ‘বেতন বৃদ্ধি জাতীয় সাধারণ স্বার্থবাদী প্রয়োজনগুলোর কথা বলছি না’-মধ্যবিত্ত বেতন বৃদ্ধির কথা ভাববে না, এ এক আশ্চর্য ঘটনা! এই জেমস সরকারি বা বিশেষত বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির মতো ন্যায্য অধিকারকে স্বার্থবাদী প্রয়োজন ভাবছে, এখানেই সে ব্যতিক্রমী।

ফের জেগে ওঠা ক্রোধকে বিশ্লেষণ করে জেমস। কারণ, এখন সে রাজনৈতিকভাবে আমেরিকায় আশ্রয়প্রার্থী। সে চিন্তা করে দেখে শারীরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে সে তার ইচ্ছে পূরণের ব্যর্থতাকে সফল করার চেষ্টা করেছে। সে বুঝেছে যুদ্ধ কোথাও শেষ হয় না আসলে। শারীরিকভাবে প্রত্যাঘাতের অনুমোদন তার দেশের এক শ্রেণির মধ্যে পেয়েছে সে। আমেরিকায় আসার পর সে ভাবছে, দেশে থাকলে সে এত কিছু না ভেবে কিসিঞ্জারকে আঘাত করে বসত। কারণ, তার  দেশে এর নৈতিক সমর্থন জুটে যেত।

নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করেছে জেমস। ‘চিলি থেকে কম্বোডিয়া’র জন্য কিসিঞ্জারের প্রতি বৈধ ক্ষোভ জেমসের হাতিয়ার এখন অবজ্ঞা। জেমস অবসরে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের পড়ায়। সেখানে সে তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কি মাফ করে দিতে পারো তাদের, যারা জানেই না যে তাদের মাফ চাওয়া দরকার?’

এভাবেই অনায়াস দক্ষতায় শারীরিক প্রতিশোধের গল্প থেকে মানসিক প্রতিরোধের দিকে নিয়ে যান লেখক। কিসিঞ্জারের খোঁচাখুঁচি কমল না, ‘তোমরা দেখি দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করেছ। তোমাদের কি স্বাধীনতা-টাধীনতা সব গুটিয়ে নিয়ে ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য হয়ে গেলেই ভালো হতো না?’ কিসিঞ্জারের এই কথাগুলো খানিকটা যেন নিজের দেশ বিষয়ে লেখকের আত্মসমালোচনাও। কারণ, এরপর কিসিঞ্জার কী বলতে পারেন এমনটা লিখেছেন তিনি, ‘ত্রিশ বছরের বেশি হলো, কয়েক বিলিয়ন বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ ছাড়া আর অর্জন তো তেমন কিছু হলো না।’ 

লেখকের সূক্ষ্ম অভিমানমাখা অভিযোগের কোনো উত্তর দেয়নি জেমস। যুদ্ধাপরাধের কারণে সে কিসিঞ্জারকে ক্ষমা করল। সিজারের এত চেষ্টার পরও একদা ক্রোধী জেমস শান্ত থাকল এই কারণে যে কিসিঞ্জারের যে মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষের চাল, ঐতিহাসিকভাবে তা ব্যর্থ হয়েছে। যে দেশত্যাগী জেমস ডি-কস্তা ক্রমাগত কিসিঞ্জারকে এড়াবার চেষ্টা করেছিল সেই বৃদ্ধ কিসিঞ্জারের, ‘তাঁর বেঁটে নুয়ে পড়া শরীরে’ কোট চড়িয়ে দিতে পারল। ঢাকাবিমুখ যুবকটির সুপ্ত দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলেন এই কিসিঞ্জারই। শারীরিক প্রতিশোধ দিয়ে নয়, ক্ষমাও নয়, তাচ্ছিল্য দিয়েই লড়াই করে জেমস। এভাবেই দেখব লেখক কোনো গল্পে পাঠকের ইচ্ছে পূরণ করেন না।

‘আয়েশাকে হারিয়ে’ গল্পে প্রথম পুরুষ আমি ওই গালিব বা বাহরামই। সাত বছরের একটা ছেলের উচ্চবিত্ত পরিবার। বনানীর লাল ইটের বাড়ি। মার্শাল ল সিস্টেমে বাসার নিয়মকানুন কড়া। ‘সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠা, এরপর ডিম টোস্ট এক মগ ওভালটিনের নাশতা।’ বিকেল সাড়ে চারটায় সামনের লনে খেলা, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আধঘণ্টা টিভি দেখা। পেছনের লনে অনেক ফলের গাছ। যে একটা দোলনা ও সি.শ স্থাপন করেছিলেন বাবা। এই নিয়মটি ধ্রুব সত্য মনে করেছিল সাত বছরের বালকটি। ঘড়ির কাঁটা মেপে খেলার সময় একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। ‘ঘড়ির অ্যালার্মের চেয়েও পারফেক্ট সময়ের জ্ঞানওয়ালা আমার মা সেদিন রুটিন অনুযায়ী সাড়ে চারটায় খেলতে যাওয়ার জন্য আমাকে ঘুম থেকে তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন।’

সাত বছরের বালক নিজেকে প্রবঞ্চিত মনে করে যখন মা বললেন পরের দিন পুরো এক ঘণ্টা বেশি খেলতে দেবেন। তখন সে চিৎকার করে বলে, ‘তাতে তো আজকের বিকাল ফেরত হবে না। যে ঘণ্টা চলে যায় সেটা কোনো পরের ঘণ্টা দিয়ে আর পূরণ করা যায় না।’ বিকেলের খেলা হারানোর ব্যথার জায়গায় একটা অন্য অনুভব ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলে বালকটিকে। ‘আমি হঠাৎই দেখতে পেলাম, আমাদের রুটিন সে যতই কঠিন ও কড়া হোক তার বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। রুটিন খালি একটা ঘটনার পৌনঃপুনিকতা। শুধু একটা ভাব নেয়া যেসব আছে এবং চলছে আসলে সব হারাচ্ছে ... আমি অনুভব করছিলাম আমার মায়ের পক্ষেও এই হারানো থেকে আমাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।’ একটি শীতের বিকেল হারিয়ে কথক প্রথমবার দুঃখের ভাব উপলব্ধি করেন। এই দুঃখের বোধ স্পর্শকাতর মন নিয়েই সে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়। এই দুঃখ ও নঞর্থক অনুভূতি থেকে মানুষ দূরে থাকতে চায়। মানুষ পরিণত বয়সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কথক বলছেন, ‘আমাদের সুখ অসুস্থতা অনেকটা নির্ভর করে এই বেড়া বা প্রতিরোধের শক্তির ওপর’-এই সূক্ষ্ম তারে বাঁধা মন নিয়ে কথকের ঠাঁই হয় ইবিদ স্টোরের বুক কর্নারে, যেখানে জার্মানদের আধিপত্য। ধুলোমলিন শোপেনহাওয়ার এবং হেগেল অনেকটা যেন নিৎশে ও হাইডেগারের জগতে হারিয়ে যাচ্ছে এবং অবধারিতভাবেই, ‘ঢাকায় কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না। এখানে মানুষের জানাশোনার কৌতূহলের শেষ কথা ছিল নতুন মডেলের গাড়ি কিংবা কোনো নতুন ইলেকট্রনিক যন্ত্র।’ বোঝাই যাচ্ছে গল্পকথকের বিত্ত উচ্চশ্রেণির। তার শ্রেণির মতো, বড়জোর রাজনীতি, বড় কোম্পানির খবর, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ বা নতুন রেস্টুরেন্টের খবরে আগ্রহ নেই। ‘মহিলারা আলাদা কিছু না। শুধু আগ্রহের বস্তু আলাদা’ আমার কথা বলার লোকদের মাঝে ‘চেতনার নদী’ বদলে যাচ্ছে ‘কাদার ডোবা’য়।

এই কথক ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে আসা আয়েশার প্রেমে পড়ে। সে বাংলাদেশের মেয়েদের মতো জানত না পুরুষ ও নারীর দুজনের একটা অদৃশ্য এবং অভেদ্য পর্দা দিয়ে পৃথক করা দুটো আলাদা জগতে থাকতে হয়।  ‘আমাদের পাশাপাশি মেয়েরা সবসময় চিন্তিত থাকে এই করুণা তারা কোনো অযোগ্যকে করে ফেলল কি না এই নিয়ে’ সমমানের, সমশ্রেণির, জাতপাত, গোত্রের বিচার আয়েশার মতো ইংল্যান্ডে বড় হওয়া মেয়েদের থাকে না। আয়েশা কিছুদিন পরই ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে। এই ভবিষ্যৎ বিচ্ছিন্নতার বোধ কথককে ক্রমে আতঙ্কিত করে দিচ্ছিল। ও যেন রাধার চোখ থেকে কৃষ্ণকে দেখা।  মিলনের সময় বিচ্ছেদের চিন্তা।

কথক তার বয়সী ছেলেদের থেকে আলাদা। ‘এত দিন পর্যন্ত মনে হতো আমার এই অস্তিত্ব বা বেঁচে থাকার জন্য সবারই মতো কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। জন্ম ... ওপর ঘটেছে বলেই শুধু আমি বেঁচে আছি। ঈশ্বরে বিশ্বাস আমার আগে থেকেই নেই। তখনই আমি সার্ত্র পড়েছি। কামু পড়েছি।’

আয়েশার মূল্যায়নে এহেন কথকের আত্মবিশ্বাস বেড়ে ওঠে।

ওরা দুজনেই ছাদে আড্ডা মারে। আয়েশা একদিন জলের ট্যাংকের ওপর এসে বলে, ‘আমরা তো আসলেই সেইটুকুই জানি, যেটুকু আমাদের নিজেদের মনের মধ্যে থাকে, তাই না? তাহলে আমরা বন্ধু এ কারণে না যে আমরা অপরকে বুঝি, বরং এ কারণে যে আমরা একে অপরকে না বোঝার ক্ষেত্রে কোনো ভুল করি না।’ যদিও এই ধরনের কথা বলা আয়েশার এমন পরিণত মনষ্কতার পরিচয় পরে পাওয়া যায় না। তার বহিরঙ্গের উচ্ছলতা, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা, অন্তর্মুখী কথককে বিব্রত করেছে। বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক সমস্যা হয়েছে। মিটেও গেছে। কথকের বন্ধু রকিব আর পাঁচটা ছেলের মতো মেয়েদের সঙ্গলাভে উৎসুক। যৌনতা ছাড়া সে যে কোনো দিন মরে যেতে পারে, এই ভেবে চিন্তিত! সে বিশেষ পল্লিতে গিয়ে সে আকাক্সক্ষাও পূরণ করে আসে। কথকের সেসবে মন নেই।

সে আয়েশার প্রেমে মগ্ন। সম্পর্ক ক্রমে গাঢ় হয় তাদের। অবসেসড এক তুঙ্গ উন্মাদনায় স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যায় কথক। ‘আমি ওকে যত চুমুই খাই, যেখানে আটকে ধরেই চুমু খাই, যেভাবে দুই হাতে আগলে রাখার চেষ্টাই করি, সময়টাকে তো আমি মোটেই আটকাতে পারছিলাম না।

আয়েশার সঙ্গে প্রেম অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। আয়েশা তার নির্ধারিত সময়ের কিছুদিন আগেই লন্ডনে চলে গেল। কথকের কাছে থেকে গেল ওর ঘ্রাণ, শারীরিক স্পন্দন, অবাক করা সংগীতের সুর। একদম দমবন্ধ করা বিরহের সুরে গল্পটি গেঁথে তুলেছেন আনিস, যেখানে একটু একটু করে সযতেœ চরিত্রের খোলস ছাড়ানো হয়েছে। সব হারিয়ে যায়। সে ফেলে আসা মুহূর্তটুকু হোক, শৈশবের একটি খেলার দিন অথবা আয়েশা নামে প্রেম। একাকী বিচ্ছিন্নতাই মানুষের নিয়তি।

‘পরীক্ষা দিয়ে কবি হওয়া’ গল্পেও এই শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি ভর করে তারুণ্যে পৌঁছানোর কাহিনি পাই। প্রেক্ষাপটে সেই ১৯৭০-৭১-এর তপ্ত আবহাওয়া। পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণার বীজের একমাত্রিক প্রকাশ দিয়ে শুরু হলেও গল্প সরে যায় স্বাভাবিক মানবচরিত্রের জটিলতায়। বাহরাম ও জামশেদ দুই পিঠাপিঠি ভাই। এই বাহরাম গালিবের প্রলম্বিত রূপ। জামশেদ জেদি, সাহসী, স্বেচ্ছাচারী। সে গেল ক্যাডেট কলেজে। বাহারামকে বাসার পাশেই একটা মোটামুটি ভালো স্কুলে পাঠাতে সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। উচ্চবিত্ত পরিবারে বাহরামের ‘দেহ-দোমড়ানো’ লজ্জা দূর করার জন্য তাকে তার মা বিভিন্ন জন্মদিনের পার্টিতে, সিনেমায় নিয়ে যেতেন, খেলনা গাড়ি ও লোগো সেট কিনে দিতেন। শিক্ষিত পরিবারটিতে রাতে মা তাকে রাশিয়ান ভূত-প্রেতের গল্প পড়ে শোনাতেন। এহেন বাহরাম, জামশেদের মতো খেলার মাঠে না গিয়ে দাদা বা দাদুর লাইব্রেরি রুমে প্রবেশ করল। তার বাবা এই পড়–য়া মানুষগুলোকে ভয় পেতেন। কারণ, তার মতে, ‘পড়া ভালো তবে অতিরিক্ত পড়া মানুষকে পঙ্গু করে দেয়... বই পৃথিবীতে অনেক প্রতিভাকে নষ্ট করেছে।’ বাবার উদাহরণ ছিল তার এক বন্ধু যে চোখে চশমা নিয়ে এত পড়ত যে রাস্তায় দেখা হলে কাউকে হ্যালো করার হুঁশ থাকত না। তার সঙ্গে কথা বললে ‘ডায়ালেকটিক ম্যাটেরিয়ালিজম বিষয়ে তার ভাবনা কী’ এই নিয়ে বলতে থাকত! কিন্তু বাহরাম নিঃশব্দে বাবাকে অস্বীকার করল। বাবার প্রশ্নে চেষ্টা করত তার বিরক্তি চেপে রাখতে। তারপর বাবার প্রশ্নের উত্তর নিজে খুঁজত। ‘প্রশ্নগুলো তার কাছে অর্থহীন মনে হতো’। পড়–য়া বাহরাম ডাবল প্রমোশন পেল এবং জামশেদ এক ক্লাসে দুই বছর থাকায় তারা সহপাঠী হলো। জামশেদ বাড়ি ফিরে এলে বাড়ির সামনে ফুটবল খেলার মাঠে যুদ্ধের সূত্রপাত হলো। ফুটবল মাঠে বিহারিদের দলের সঙ্গে জামশেদের নেতৃত্বে যে বুক চিতিয়ে মোকাবিলা, তা যেন শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্তের খেলার মাঠে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ায়।

সেখানেও ছিল বাঙালি-বিহারির দ্বৈরথ। সেখানে ছিল দুই ধর্মের ছেলেদের সংঘাত। এখানে এক ধর্মের দুই ভাষাভাষীর বিরুদ্ধতা। গ্যারেজ থেকে সাইকেলের চেইন টায়ার হাতল আয়না লাগানো দাঁত ঝরা হেয়ার ব্রাশ সংগ্রহ করল জামশেদের দল। মাঠে মারপিটের সময় জামশেদের দলের ছেলেরা ক্রিকেট ব্যাট ও উইকেট নিয়ে ঢুকল।

‘বিহারি’ বলতে যে অবাঙালিদের বোঝানো হয়েছে তাদের বিষয়ে ঘৃণার বদলে লেখক নিরপেক্ষভাবে লিখেছেন, ‘ওদের  সংখ্যা ও কঠিন দলীয় আনুগত্য দেখে ওদের কেউ ঘাঁটাতে সাহস করত না’। জামশেদ যে সংঘবদ্ধ লড়াইয়ে বিহারিদের বিরুদ্ধে জিতল তা তার ফুটবল খেলার দক্ষতার আস্থায়। মাঠ নিয়ন্ত্রণ শুধু গায়ের জোরে হয় না। এহেন জামশেদ লড়াই শেষে মোটেই বিহারিদের তাড়িয়ে মাঠের দখল নিল না। এখানেই আনিস ব্যতিক্রমী। ‘এখন থেকে এই পার্ক আমাদের। আমরা এখানে যখন খুশি খেলব এবং তোমরা খেলবে বাইর মাঠে। ভেতরে খেলতে হলে আমাদের দলে যোগ দিতে হবে।’ শুধু এটুকু হলেই গল্পটিতে একটি একরৈখিক বার্তা থাকত। কিন্তু আনিস আরও লিখছেন, ‘আমি এ শহরে না থাকলেও আমি এই দলের দলনেতা থাকব।’ ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র রাজনীতির স্বৈরতন্ত্রের আভাস কি আমরা এই শেষ লাইনে পাই না?

বাহরামের তার ভাইকে স্বাভাবিকভাবেই, ‘একেবারে আকবর বা আলেকজান্ডারের মতো এক বীর মনে হলো’, জামশেদ মোটেই শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ইন্দ্রনাথের মতো রোমান্টিক হিরো হয়ে নৈতিকতার সংজ্ঞা পাল্টে দিল না শ্রীকান্তর মতো গুণমুগ্ধ বাহরামের! জামশেদ তার অনুগতদের মধ্য থেকে যে দল তৈরি করল, তা অবশ্যই সেরা এগারো। তার বাইরে অতিরিক্ত যারা দলে ঢুকল তারা খুব খেলার জগতের নয়। আফসারকে নেয়া হলো, কারণ, তার সরবরাহ ছিল সিগারেট বাংলা এবং বিএফ! টুলুর ছিল সহজে পাওয়া গাড়ি। আরেকটি ছেলের মাধ্যমে পাশের চাপাতি দোকানে যথেচ্ছ খাওয়া যেত। একজনের বাবার ছিল চীনে রেস্তোরাঁ, আরেকজনের আস্ত সিনেমা হল। এরপরই আসে সবচেয়ে জোরালো মোচড়। ‘বিহারি’ দলের নেতা মোটকু আসকরিকেও নেয়া হলো কারণ, ওর ছিল কিডনি আকারের সুইমিংপুল। জামশেদ তার ‘মেধাহীন ছোট ভাইকে এই সার্কেলের মধ্যে ঢুকিয়ে ইতিমধ্যে স্বজনপ্রীতির স্বাক্ষরও রেখেছে।’ ভ্রাতৃত্ব সৌভ্রাত্র সম্পর্ককে কোনো প্রাচ্যের পারিবারিক প্রেমের বাঁধনে বাঁধেননি লেখক। মনের ভেতর সম্পূর্ণভাবে একাকী, শিক্ষিত বাহরাম পিতার আশঙ্কামতোই সমাজে পরিবার বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে লাগল। তার বিশ্বনাগরিক মন তাকে পারিবারিক আনুগত্য, ধর্ম, জাতের খাঁচায় ধরে রাখতে পারল না। এই গল্পটিতে জামশেদের কবি হয়ে ওঠার চেয়ে বাহরামের নির্মাণ আমার কাছে অত্যাশ্চর্য। জামশেদের জীবনের একটা ঘটনার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চমকপ্রদ পারিবারিক পঞ্চায়েত বসল। চিত্তাকর্ষক ও কৌতুককর ঘটনাটির পেছনে আছে জামশেদের কবিত্ব শক্তির পরীক্ষা!

কাব্যরসিক ফারসি সাহিত্যে পণ্ডিত উচ্চবংশীয় মাওলানা আরাকান খান এলেন বাড়িতে। লেখক জানালেন, তাকে নিয়ে নানান জল্পনাকল্পনা ছিল। যেমন এমনও বলা হয় যে তিনি লালন ফকিরের আবিষ্কর্তাদের মধ্যে একজন! তুর্কির সুলতানদের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল এবং শেষ মোগলের তিনি গৃহশিক্ষক ছিলেন! এভাবেই খাঁটি পারস্য রক্ত নিয়ে সাধারণের দুর্বলতার প্রতি সূক্ষ্ম একটা ঠাট্টা আছে আনিসের লেখায়।

‘তার বয়সের দিকে তাকিয়ে এমন যেকোনো প্রাচীনতার গল্প তার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া যায়, এমন গল্প চালু আছে যে ফেরেশতা জিন-পরি নবী-রসুল... বুজুর্গদের সঙ্গে তার নিয়মিত বৈঠকাদি হয়।’ আনিস ক্রমে তীক্ষ্ণ করেছেন তাঁর লেখনী, ‘মাওলানা আরাকান খানের এমন চেহারার দিকে তাকিয়ে কঠিন নাস্তিকেরও কোষের মধ্যে সুপ্ত অবচেতন ধর্মীয় অনুভব ও ভক্তিবোধ জেগে ওঠে।’

মাওলানা সাগরেদদের ‘বিরক্তিকরভাবে দাড়িগুলো মেহেদি দিয়ে লাল করা। এই লাল দাড়ি শুধু তাদের ধার্মিকতার প্রকাশ নয়, এগুলো পরোক্ষে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বহন করছিল। দেশটা যতই গোঁড়ামি বা সনাতনতার দিকে এগোচ্ছিল ততই দাড়িগুলো বেশি করে মেহেদিতে মাখামাখি হচ্ছিল।’

ফর্ম ছেড়েই দিন, বক্তব্যের এই জোরের জন্যেই গল্পকারকে শাবাশি এবং আশিতে আশি দিতে হয়!

‘ফেরার বছর’ গল্পে কথক সারা পৃথিবী চষেছে। টরন্টোতে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে ভ্যাঙ্কুভারের চাকরি করে, শিকাগোয় মাস্টার্স করে সান ফ্রানসিসকোয় ফের চাকরি। ক্যারিবীয় অঞ্চল একই আধা ইন্ডিয়ান আধা ফরাসি মেয়েকে বিয়ে। হ্যান্ড গ্লাইডিং-এর ক্যারিয়ার, কয়েন কালেক্টরের কাজ সবকিছু দিন সেরে ফেলেছে বক্তা। স্ত্রী এক কিউবান সংগীতশিল্পীর জন্য তাকে ছেড়ে যায়। সঙ্গে যায় চার বছরের মেয়ে ও অনেক টাকার খোরপোষ। এহেন মানুষটি দেশে ফেরে তার পুরোনো বাড়ি বিক্রি করতে। যে দেশ তার কাছে ‘ব্যস্ত ঘিঞ্জি আর নোংরা’-তার মনে হয় ঢাকা শহরটা ‘একটা বিশাল বিস্তৃত বস্তি। দাগি আসামিরা জায়গা করে নেয় আমাদের পাশে...লালায়িত হয় আমাদের যেটুকু আছে সেটুকু কেড়ে নিতে বা ধ্বংস করে দিতে’। ধনতন্ত্রে প্রলেতারিয়েতের লুম্পেনীকরণ সম্পন্ন হলে যেকোনো কসমোপলিটনকে যেভাবে মাটির তলা থেকে ইঁদুরের মতো খেয়ে যায়, ঠিক সেভাবে ঢাকাকে খেয়ে নিচ্ছে যারা, তাদের প্রতিভূ এখানে বাদশাহ। অন্য গল্পেও এদের বিরাজমান।

এই বাদশাহকে পাঠকের বক্তা কথিত ‘দামড়া’ বা ‘দাগি’ কিছুই মনে হবে না যখন  সে যখন তত্ত¡জ্ঞানীর মতো বলে, ‘তুমি ভাবছ আমি তোমাকে ব্যবহার করছি। তুমি ভাবছ আমি একটা ক্রিমিনাল। চারদিকে তাকাও, এই শহরটার দিকে তাকাও, সমাজটার দিকে তাকাও। ভালো মানুষগুলো তোমাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এমনকি তোমার পরিবারও তোমাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই একে অপরকে চিবিয়ে খাই। মজ্জা শুষে হাড়টা ফেলে দেয় আরেকজনের চাটার জন্য। দোষ কি আমার একার?’ গল্পের নাড়া বাঁধা এই বক্তব্যে। আদর্শহীন, নিরাকার এক শূন্যতার মাঝে পাঠককে চরম অস্বস্তিতে ফেলে রেখে দেন লেখক।

‘রামকমলের উপহার’ গল্পে রামকমল নামে এক ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার মানুষ, যে আসলে এক লেখকও বটে, তার সঙ্গে কথকের প্রথম দেখা এক বিখ্যাত কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। তার অস্থিরতা দেখে কথক জিজ্ঞেস করে, মৃত লেখক তার কাছের মানুষ ছিলেন কি না। উত্তরে রামকমল বলে, ‘সে ছিল খুবই নিচু মানের লেখক। আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে তাঁকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।’

কথক বুঝে গেল এর কাছে সব সময় অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়া যাবে। সে সাহিত্যপ্রেমী কিন্তু ঢাকার তথাকথিত লেখক সমাজের অংশ নয়। তার ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা সাহিত্য ভালোবাসবেন। বদলে সে দেখল, ‘তারা সেখানে উঁচু মেধাসম্পন্ন করণিক। তারা ভালোবাসে বেতন এবং তাদের নিজেদের প্রফেসরদের উদ্ধৃতিযোগ্য বাণী।’

রামকমলের মধ্যেই সাহিত্যপ্রেমী কথক প্রকৃত শিক্ষিত পাঠকের সন্ধান পেল। অন্যদিকে একজন খাঁটি লেখকের বাসনাই যেন মূর্ত হয়েছে রামকমল নামে লেখকের মধ্যে। রামকমলের সঙ্গে কথকের আড্ডা জমে ওঠে। রামকমলের মাধ্যমে লেখকই যেন বলেন, লিওপল্ড বøæম এবং দন কিহোতের ঘোরাঘুরির অন্তর্গত কমেডিটা বুঝতে হবে, কাফকার ত্রাস, ভন ক্লিস্টের মোহনীয়তা, বার্নহার্ডের রসিকতা, দানিলো কিশের মর্মবাদিতা, ইউরোপিয়ানদের প্রতি ‘ভয়াবহ পক্ষপাত’, দক্ষিণ আমেরিকার কার্পেন্তিয়র ও কোর্তাসার, বোর্হেস রুলফোর প্রতি অনুরাগ। আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারে, স্পেনের হুয়ান গয়তিসেলো, ইতালিয়ান লেখক লি ল্যাম্পেদুসার গ্রন্থ ‘দ্য লিওপার্ড’ এবং হাঙ্গেরিয়ান লেখক সান্দর মারাইর গ্রন্থ ‘এমব্রেসের’ কথা জানায় রামকমল। তার গণনায় কোনো বাঙালি লেখকের স্থান কখনো হয়নি। ‘আড্ডায় যারা নবাগত থাকত তারা প্রায়ই বাঙালি সমাজতান্ত্রিক বা সেন্টিমেন্টাল লেখকদের পক্ষে তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চাইত। রামকমল তাদের দিকে তার দীর্ঘ ধূসর চাহনিতে তাকাত। যারা সে চাহনিতে ভীত হতো, তারা এ আড্ডা ত্যাগ করত, বাকিরা নিয়মিত হতো।’ এই রামকমল একদিন হারিয়ে গেল বা কাউকে কিছু না বলে কোথাও চলে গেল। হারিয়ে যাওয়া রামকমলকে নিয়ে রহস্য গল্পের জাল বুনতে বসেননি লেখক। সে বুঝে যায় ‘রামকমল ফিরে এলেও যে জাদু আমাদের প্রথম দেখিয়েছে, সে জাদু সে নিজেও আর কখনো সৃষ্টি করতে পারবে না।’ এটাই গল্পের মূল বিন্দু। রামকমলের মতো ব্যতিক্রমী চরিত্রের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। কথকের মনে হয়েছে, ‘রামকমলের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা ছিল আমার কাছে কংক্রিটের এক দৈত্যাকার নির্মাণ, তবে বড়ই হতদরিদ্র। কোনো কিছুই এখানে ঠিকমতো নির্মিত নয় এবং ঠিক জায়গায় নির্মিত নয়। শ্বাস ফেলার ফাঁকটুকু কোথাও নেই। সর্বত্র লোভ আর লোলচর্মের গন্ধ।’

রামকমল একটি বিশেষ চরিত্র। তার এই পাণ্ডিত্য ও খানিক ওপর চালাকির পাশে লেখক তাকে সাধারণ একটি মানুষেও নামিয়ে এনেছেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তার নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাওয়ায় লেখক তা নিয়ে কোনো আক্ষেপ করেননি। ‘রামকমলের কাছে ইতিমধ্যেই আমি কয়েক লাখ টাকা পাই। ভাড়া, খাবার, কাপড়চোপড়, ট্যাক্সিতে ঘোরা, অফিসে ঘুষ দেয়া, প্রতিপত্তিশালী কাউকে উপহার প্রদান, কারও জন্য স্কুলের বেতন বা কারও জন্য চিকিৎসা-সাহায্য ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে বা কাজে সে  টাকাগুলো নিয়েছে।’ রামকমল নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাবার পর স্বভাবতই এসব টাকা ফেরত আসেনি। রামকমলের সঙ্গে থাকার জন্য কথককে মামলার ঝামেলা সইতে হয়েছে। এমন সব জায়গায় তার খোঁজ করা হয়েছে, তেমন অন্ধকার জায়গায় রামকমলের মতো কেউ যেতে পারে সেটাও কথক ভাবতে পারেনি। কিন্তু এই ভাবনাগুলোর কোনোটাই মধ্যবিত্তের নীতিনৈতিকতার বোধ নিয়ে তাকে টলাতে পারেনি। তার অন্তরে শেষ পর্যন্ত রামকমল বেঁচে থাকে কোনো ফেরার ফেরেববাজ হিসেবে নয়, ‘প্রাণস্পন্দনসম্পন্ন এক ডকুমেন্ট হিসেবে।’

‘এলিফ্যান্ট রোড’ গল্পে মুহূর্তের সিদ্ধান্তহীনতায় ‘মব’-এর হাতে একটা ছেলেকে ফেলে দিয়েছিল অনিন্দ্য। ছেলেটি প্রকৃত দোষী কি দোষী নয়, সেটি নিয়ে অনিন্দ্যর চিন্তাপদ্ধতি এগোয়নি। গণপ্রহারে প্রায় ছেলেটির সম্ভাব্য শোচনীয় অবস্থা কল্পনা করে সে পরের দিন সে জায়গায় ফিরে গেছে।

ঘটনার দিন তার সামনে দিয়ে ছেলেটি দৌড়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ধর ধর শব্দে অনিন্দ্য মুহূর্তের মধ্যে কিছু না ভেবেই তার পা এগিয়ে দিয়েছিল। তাতে জড়িয়ে পড়ে পলাতক তার অনুসরণকারীদের হাতে ধরা পড়ে গেল। ‘পরের দিন ঘুম থেকে জেগে অনিন্দ্য দেখল তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কেমন যেন কাঁপছে।’ অপরাধবোধে অস্থির অনিন্দ্য নানা খোঁজখবর করে হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ছেলেটির সঙ্গে ভাব জমাল। অভিযুক্তকে এক ডজন কমলা দেয়ার জন্য হাসপাতালে ড্রাইভারের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল। গিয়ে দেখল এক হাতে স্যালাইন অন্য হাত হ্যান্ডকাফে বাঁধা ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে। হাসপাতালের ঘরটিতে বিশ্বযুদ্ধের বিষণœতা। দেয়ালগুলোয় খসে যাওয়া পলেস্তারা আর বিভিন্ন রকম দাগের আঁকিবুকি। পুরোনো লোহার খাটিয়াগুলোয় হলুদ লিনেনের বিছানা। ছেলেটির বর্ণনাও তথৈবচ। ‘হাড় জিরজিরে বুকের খাঁচাটি শ্বাসের সঙ্গে স্থিরভাবে উঠছে নামছে।... কপালজুড়ে ব্যান্ডেজ। মাঝেমধ্যে রক্তের রসে ভিজে বাদামি হয়ে গেছে। জানতে পারল ছেলেটির বাবা দক্ষিণে কোন জেলায় শিক্ষক। তার বাবা জানে যে সে একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে। হাসতে হাসতে ছেলেটি বলল, ‘কথাটা একেবারে মিথ্যাও না।’

অনিন্দ্য তাকে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে একটা ছোটখাটো কাজ দিতে চাইল। ছেলেটি মোটেও নিতে উৎসুক হলো না। তার মালিক এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। মালিকের কাজে দ্রæত ফিরতে চায় সে।

ছেলেটি পিয়নের, দোকানে হিসাব রাখার চাকরি করেছে, কিন্তু তার আকাক্সক্ষার তুলনায় সেসব কাজে ওপরে ওঠার সুযোগ নেই। সে নির্বিকারভাবে জানায়, বড় ভাই অবৈধভাবে ইতালিপ্রবাসী। ছেলেটি যে অভিযোগে অভিযুক্ত, সেই হাইজ্যাকার সে হতে পারে, এটাও বুঝে ফেললেন লেখক। যে প্রবল অপরাধবোধের তাড়নায় তাকে কাজ দিতে চেয়েছিলেন, তা ছেলেটির কাছে অবান্তর। ছেলেটি জানায়-তার শখ একটা ভালো বাসার, ভালো ব্র্যান্ডের পোশাকের, ডিশ টিভি লাইনের, মোটরবাইকের।

তাকে প্রশ্ন করল অনিন্দ্য, ‘সত্যি? এসবের পর তুমি আবার চাকরিতে যোগ দেবে?’

ছেলেটি গম্ভীরভাবে জানায়, ‘আমার বস ভালো লোক, আমার কাছে তার অনেক পাওনা আছে।’ এর সঙ্গে আরও যুক্ত করে, ‘কেউ কোনো ঝামেলা করলে খবর দেবেন সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব।’

যে অনিন্দ্য লোভী ও অনৈতিক কাজে উৎসাহী শ্যালকের ওপর বিরক্ত হয়ে এই ছেলেটিকে সেই কাজ দিতে চেয়েছিল, সেই শ্যালক মিতুনের কথা তার মনে পড়ে গেল।

সে এবার বলে ফেলল, সে মোটেই সাংবাদিক নয়। উপরন্তু তার জন্যই ছেলেটি গত দিন ধরা পড়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই নর্দমার নালা খুলে গেল যেন। বিকারগ্রস্তের মতো ছেলেটি তার দিকে তেড়ে আসার চেষ্টা করল, থুতু দিল, অকথ্য গালিগালাজ শুরু করল।

‘যে হারামজাদা আমাকে চটি দিয়ে ফেলে দিয়েছিল তারে তো আমি এত দিনে মাফ করে দিয়েছিলাম। যেগুলো আমারে মেরে ছিল সেগুলো আমি মাফ করে দিছি। আমি সেইটারে মাফ করতে চাই না যেইটা আমারে নিয়ে মজা করতে আসে। এর জন্য তোমারে পস্তাইতে হবে।’

অনিন্দ্য যতবার ক্ষমা প্রার্থনা করে ততবারই সে গালাগাল দেয়। অনিন্দ্য বারবার বলে সে ইচ্ছে করে করেনি। পুরোটাই একটা দুর্ঘটনা। ‘তোমার কাছে স্যরি বলতে এসেছি, দেখতে এসেছি আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি কি না। আমাকে কি মাফ করা যায় না?’

অনিন্দ্যর নৈতিকতা ছেলেটির পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সে ভেবে নেয় তাকে নিয়ে মজা করতে এসেছে অনিন্দ্য। অপরাধীর শাস্তি নিয়ে লেখকের পক্ষপাত নেই কোথাও। নির্বিকার নির্মমতার সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের খোসা খুলে খুলে যেন তিনি চরিত্রের হাড়মাস অব্দি পৌঁছে গেছেন। পাঠকের মনে পড়বে-গল্পের ভেতর লেখকের উক্তি, ‘এ গল্পে অসাধারণ বা আজব কিছু নেই।’ লেখকের এই নির্বিকার প্রত্যাশাহীনতাই তাঁকে বিশ্বমানের গল্পকারের স্তরে উন্নীত করে।

‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন’ গল্পে অন্তর্গত রক্তের ভেতর যে বোধ খেলা করে, মানুষ তার তল পায় না। এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং শাখার জেনারেল ম্যানেজারের সুখী জীবন। ‘স্ত্রী রিতা সহৃদয়  সুনিপুণ সুহাস্যময়। সে একজন  চমৎকার গৃহিণী ও চমৎকার মা। পাঁচ বছরের ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে এবং ড্রাগন নিয়ে ভাবে।’ কথক নিজে জানান, ‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে খুব আসনাই রেখে চলার চেষ্টা কখনো করিনি।’ তার দিক থেকে কোনো চেষ্টা না থাকা সত্তে¡ও বন্ধু বাদল যোগাযোগ রেখে চলত। বাদল প্রায়ই পুরোনো দিনের গল্প করত, সেই সব শৈশবের গল্প, যখন সে নাকি খুব ভালো ছিল। কথকের মত একেবারে উল্টো, ‘আমার কাছে সব আড্ডাফাড্ডা একদম বিরক্তিকর মনে হতো। আমি মনে করতাম না আমার সুখের দিনগুলো পেছনে চলে গেছে। আমি তো বরং স্কুল-কলেজের ওই দিনগুলোয় বেশ কষ্টে ছিলাম। টাকা ছিল না, স্বাধীনতা ছিল না।’ ঘোর স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী সফল মানুষটি আচমকা বদলে গেল ছোটবেলার বন্ধু আমজাদের কয়েকটি চিঠিতে। আমজাদ আত্মহত্যা করেছে কোনো এক অজানা কারণে। একেবারেই যোগাযোগ না থাকা বন্ধু এই গল্প-কথককে সে তার চিঠিগুলো দিয়ে যেতে বলেছে।

কথক আমজাদের আত্মহত্যায় মৃত্যুর থেকেও বেশি অবাক হয় তাকে এই খামবন্ধ চিঠিগুলো দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। ‘কৌত‚হল একটা বিদঘুটে জিনিস। এটি কখনো এগিয়ে নেয়। আবার কখনো থামিয়ে দেয়। বেশ কয়েক দিন চলে গেল। তারপরও আমি আমজাদের প্যাকেটটি খুললাম না। ব্যাখ্যা করতে পারব না আমি এমনটা কেন করছিলাম। আমি কি ভয় পাচ্ছিলাম যে হয়তো এখান থেকে অনাকাক্সিক্ষত কিছু বেরিয়ে পড়বে আমারই বন্ধু সম্পর্কে যাকে আমি একসময় অনেক আপন জানতাম আজ শেষ পর্যন্ত যার খবরও রাখিনি?’

এত দিন একরৈখিকভাবে জীবন দেখেছে কথক। ‘আমি জানি আত্মহত্যাগুলোকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যারা জীবনের প্রতি পর্বে সুখী ও সফল তাদের আত্মহত্যাগুলো একটি রহস্য। আর যাদের জীবন ডিপ্রেশনের এবং বঞ্চনার তাদের আত্মহত্যাগুলো জীবন থেকে পালানোর এক চরম চেষ্টা।’ আমজাদকে এর কোনো দলেই ফেলতে পারছিল না কথক। সে বাদলের মতো উদ্যমী বা উচ্ছ্বাসসময় ছিল না। কথকের  মতো কর্মচারীও ছিল না বা আরেক বন্ধু মোনেমের মতো বুদ্ধিজীবীও ছিল না। আমজাদের মতো সাধারণ মানুষের, যার জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ছিল না, সুখ নিয়ে তার লেখা ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু চিঠির মতো অংশ পড়ে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল কথক। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারছিল ছোটবেলায় চেনা আমজাদকে বড় হয়ে মোটেও সে চেনে না। আসলে গুরুত্বহীন বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে চিনতে চায়ওনি। ‘মানুষ পাল্টায়। সে পাল্টে কোন মানুষটি হয়েছিল সেটি আসলে আমি জানতে পারিনি।’ কথক উপলব্ধি করে, ‘তবে আমি মনে করি না বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, ঋণ ইত্যাকার সুনির্দিষ্ট প্রদর্শনযোগ্য কোনো কারণে সে আত্মহত্যাটি করেছে।’

আমজাদের লেখাগুলো তার এমন ‘বেহুদা’ মনে হলো যে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোলো কাজের কোনো তথ্য পাওয়ার আশায়। কোথাও উল্লেখযোগ্য বা উত্তেজক কিছু নেই। যে মুহূর্তগুলোতে সে এক ঝুলে থাকা অন্ধকার থেকে নিজেকে মুক্ত ভেবেছে সেই নিয়েই লিখেছে! বউ-বাচ্চার কোনো উল্লেখ নেই। নিজের কীর্তিকর্মের কোনো উল্লেখ নেই। একটা কাগজে আমজাদ লিখেছে-‘মাঝেমধ্যে আমি ভাবি আমার বন্ধুদের কাছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখী দিনটি সম্পর্কে জানতে চাইব। অবশ্য তারা বলবে বলে মনে হয় না।’ কথকের অবাক লাগে এই ভেবে যে এই তুচ্ছ ও এই হাস্যকর প্রশ্ন নিয়ে তার অফিসে আসত! তার আরও মনে হয়, সে আধুনিক বাস্তববাদী মানুষ। তাদের মতো মানুষদের আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই জীবনের বড় আঘাতের, মান-অপমানের কথা আসে। কথা বলার সময় তাদের কথা প্রতিষ্ঠিত রীতির বাইরে যায় না। স্বাভাবিকভাবেই বিরক্তির সঙ্গে আমজাদের লেখা কাগজগুলোর প্যাকেটকে কথকের মনে হলো মশকরা বা একটি অভদ্রতা। কী লিখেছিল আমজাদ? ‘গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফেরার সময় খেয়াল চাপল বাসে যাব না। বাসে না উঠে   নদীর উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। নদীটা কতদূর এবং কোন পথে তার পুরোটা জানা ছিল না...জীবনে প্রথমবার অনুভব হলো আমি হারিয়ে গেছি...হারানো অবস্থায় যে কয়টা ঘণ্টা আমি ছিলাম, একটি একতলা দালানের জানালার লিন্টেলের ওপর বসে দেখছিলাম রাস্তা দিয়ে মানুষগুলো আসছে-যাচ্ছে...আমার মনে হচ্ছে, অনেক দিন ধরে এমন সুখের সময় আমার আর যায়নি।’

আমজাদের এই ‘সুখের’ সংজ্ঞা কথকের জীবন পাল্টে দিল। হিসেবি সাংসারিক উচ্চাকাক্সক্ষী একটি মানুষ, আপাত তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর আমজাদের প্রভাবে জীবনের প্রকৃত সুখের সন্ধানে ‘লক্ষ্যহীনভাবে গাড়ি চালাতে লাগলাম শহরের যে দিকটায় ভিড় কম সেদিকে’। অতি সাধারণ মানুষ আমজাদের মতো তার সাহস নেই প্রকৃত সুখের কাছাকাছি পৌঁছনোর। ‘ও শহর ছেড়ে বেরোতে সাহস হলো না আমি জানি অকারণে বাসায় যেতে দেরি করলে রিতা কতটা মন খারাপ করে।’ কথকের মনে প্রশ্ন আসতে শুরু করে, ‘একটি সুখী জীবন কি একই সঙ্গে অর্থময়? বিষয় দুটো কি দুমুখো?’

যে বাদল প্রায় একতরফাভাবে কথকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গেছে, সে হয়তো কথকের সমস্যা ও পরিবর্তন ধরতে পারে। বাদল কেমন আছে জানতে চাইলে বলে, ‘তো আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ধারের মাথায় কখনো যাব না। তুমিও আবার হঠাৎ রওনা দিয়ো না। এক মৌসুমে একজন কি যথেষ্ট নয়?’

কথক এবারে বাড়িতে কাউকে না বলে রোজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে থাকে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসে ঘুমন্ত স্ত্রী-সন্তানকে দেখে মনে হয়, ‘আমি জানতাম এরা আমার ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু তারপরও, সব ভালোবাসা সত্তে¡ও ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল এদের কি আমি চিনি?’

জটিল ও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন মানুষ পরমুহূর্তে কী করবে জানে না। প্রায় জীবনানন্দের কবিতার মতো সমাপন এই গল্পের।

‘অল মাই এনিমিজ’ বা ‘আমার শত্রুরা’ গল্পে উচ্চবিত্ত এক দুর্দান্ত সফল বয়স্ক নির্মাণ ব্যবসায়ীর কথা আসে। যে স্তরের মানুষদের আমরা সাধারণত তাদের অতিরিক্ত সাফল্যের কারণে সাহিত্যের চরিত্র নির্বাচন করি না। করলেও বেশির ভাগ সময়ে তাদের একরৈখিক খল চরিত্র বা দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে দেখানো হয়। লেখক প্রাচুর্যের মধ্যেও দৈনন্দিনের ঘোষিত বা সম্ভাব্য শত্রæর কাঁটার আঘাতে জর্জরিত হতে দেখিয়েছেন শাহবাজকে। আপাতভাবে সুন্দরী স্ত্রী, দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে শাহবাজ সাহেবের সুখের সংসার। কিন্তু গ্রামের মাস্টারের ছেলে ঢাকায় এসে পরিশ্রমে বুদ্ধিতে কৌশলে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা তাকে দিয়েছিল এক জটিল মানবমনের উত্তরাধিকার। মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছে না কোনো সময়। প্রতি মুহূর্তের জীবনধারণের ও ব্যবসায়িক কৌশল তাকে এক পলকের জন্যও শান্তি দেয় না। কিন্তু দেখো ‘কাঁটার রাজমুকুট’ কেমন লাগে গোছের সরলীকরণে লেখকের স্পৃহা নেই।

শাহবাজের চরিত্র নির্মাণে শৈশবের কথা এসেছে। গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইংরেজ স্টুয়ার্ট ছিল মিতাহারী, অকল্পনীয় পরিশ্রমী ও নিয়ম পালনকারী। শাহবাজের বাবা সেই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিজেকে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে স্টুয়ার্টের মতো করে পাল্টে নিয়েছিলেন। যে কেউ শৈশব গঠনে এই মিশনারীয় কৃচ্ছসাধনকে মহৎ মনে করবে, কিন্তু শাহবাজ মন থেকে স্টুয়ার্টকে ঘৃণা করত। শাহবাজের মনে আছে, তার অনুগত পিতা ডায়েরিতে এমন মহান মানুষের কথা শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে লিখে রাখতেন, যাকে মনে হতো, ‘নীরস ওয়াজ নসিহতে বলার মতো কিছু নীতিকথা, যা ঔপনিবেশিক আচরণের কোনো হ্যান্ডবুক-জাতীয়।’ শাহবাজের মতে স্টুয়ার্ট তার নিজের ত্যাগের বিষয়গুলো, ‘ধর্ষকামিতার সঙ্গে অপরের ওপর আরোপ করার প্রয়াস’ করতেন। ‘শাহবাজ এই কষ্টকর ত্যাগ শিক্ষার বিপরীতে গেলেন।’ চাকরি ছেড়ে ব্যবসা কনট্রাক্টরি শুরু করল। রাশিয়ার গম, তুরস্কের মসলা এবং ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার ভোজ্যতেল দিয়ে ব্যবসা করল। ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত সেতু ও সড়কের নির্মাণ মেরামত’-এর সঙ্গে ‘হাত করলেন প্রচুর শত্রু সম্পত্তি ও ফেলে যাওয়া মিল-কারখানা।’ প্রতিটি গল্পে আমরা বুঝতে পারছি, নায়ক বা ভিলেনের মৃত্যু ঘটে গেছে বহু আগেই। ঔপনিবেশিক শাসকেরা চলে গেছে কিন্তু ছেড়ে গেছে তাদের দেশীয় রাজাকারের উত্তরাধিকার, যারা অধিকাংশই মন্ত্রী, আমলা। ঢাকার ইটের জঞ্জালের মতো শাহবাজের জীবনও ধীরে ধীরে জঞ্জালে ভরে উঠছে।

ষাট বছরের জন্মদিনের উচ্চাকাক্সক্ষী পার্টি তছনছ হয়ে যাওয়ার পর শাহবাজের মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বড় মাপের মানুষেরাও পারেননি যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যেতে। তার ব্যবসা হাতে নিতে পারার ক্ষমতা নেই ছেলে ও মেয়ের। ইতিহাসপড়–য়া শাহবাজের সান্ত্বনা ‘উবার’ নিয়ে লেখা গ্রন্থটি। ‘কিছুই স্থায়ী নয়। গিরি কান্তার-মরু কোথাও না...তারপরও মানুষ বানিয়ে যাচ্ছে শহর, বানিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্য।’ শাহবাজের হাতে রয়েছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া উবার নিয়ে লেখা বইটি। হাজার হাজার বছর আগে নিশ্চিহ্ন হওয়া শহরটি বইয়ের মাধ্যমে আজ তার সঙ্গে কথা বলছে। ইট-কাঠের সাম্রাজ্যে বুঁদ হয়ে থাকা শাহবাজ নয়, লেখকই বলছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাট ও দার্শনিক মার্কাস অরেয়েলাস রেখে গেলেন অকর্মার ঢেঁকি কমোডাসকে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে। এক চাষা সৈনিকের নেতৃত্বে পরিচালিত আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ মিঙ সম্রাট নগরীর বাইরে একটি গাছের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে মরলেন। ‘শাহবাজের এই সাম্রাজ্য তিনি চান বা না চান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেই। প্রাচীন তামিল নগরী পুম্পুহার সুনামিতে ভেসে গেছে। মরক্কোর প্রাচীন নগরী সিজিলমাসার একটি পিলারও রাখেনি বিদেশি আক্রমণকারীরা।’

ইতিহাস যেন শাহবাজের সব উদ্বেগের উত্তর দিয়ে যায়।

বইয়ের ব্যাক কভারে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘নিখুঁত আঙ্গিক ও মোক্ষমভাবে যথার্থ ভাষার বুনন গল্পগুলোকে নাইপল য়োসা কোয়েৎজির লেখার কাতারে পৌঁছে দেয়।’

আমরা পাঠক কাজী আনিস আহমেদের পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকি।

আরও পড়ুন :

জীবন লিখতে লিখতে | জহর সেনমজুমদার 

ক্ষমতার পঠন : ইতিহাস আর উপন্যাসের বোঝাপড়া | সুমন রহমান

বি-উপনিবেশায়নের জ্বালামুখ | হামীম কামরুল হক 

দোটানার বৃত্ত | আফসানা বেগম 

বিস্ময়মুগ্ধতা ও ডুবসাঁতার | মোস্তাক আহমেদ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন