X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিতব্যয়িতা মূল্যবোধেরই অংশ হওয়া উচিত

মামুন রশীদ
০৩ অক্টোবর ২০২০, ১৫:২৪আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১৫:২৬

মামুন রশীদ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে আমাদের ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত আবুল কাশেম স্যার। তিনি আমাদের এক সহপাঠীকে পরীক্ষার হলেই চপেটাঘাত করেছিলেন। তার অপরাধ ছিল-পরীক্ষার খাতায় বিরাট মার্জিন দেওয়া বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ খালি রাখা। স্যার রাগতস্বরে বলেছিলেন-গরিব দেশের জনগণের করের টাকায় প্রায় বিনা পয়সায়  পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের এতো অপচয় গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটি গরিব প্রজাদের অত্যাচারী জমিদারদের কথাই নাকি মনে করিয়ে দেয়। করোনাকালে আমাদের এলাকার সুপারশপ বা ফার্মেসিতে দেখেছি অনেক বড় বড় করে লিখে রাখা হয়েছে–প্যানিক বাই বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কোনও কিছু না কিনতে। অথচ নিজেই ঢাকার অভিজাত পাড়ায় সুপারশপ বা ফার্মেসিতে দেখেছি কেনাকাটা কাকে বলে? তিনজনের সংসারের এক বন্ধুপত্নীকে দোকানের সহায়তাকারীকে বলতে শুনেছি– ‘আমাকে ২০টি মুরগি, ১০ কেজি খাসির মাংশ, ১০ কেজি গরুর মাংস, পাঁচ ডজন টয়লেট পেপার, ২০ কেজি আলু, ২০ লিটার দুধ ইত্যাদি ইত্যাদি দাও।’ অনেকে দেখেছি নিজেই ডাক্তার হয়ে বাড়িতে  অনেক ধরনের ওষুধ মজুত করছেন। পেঁয়াজের অনুমিত আমদানি সংকটের কথা জানতে পেরে বন্ধুদের অনেকেই সম্প্রতি ২০-২৫ কেজি পেঁয়াজ কিনে মজুত রেখেছেন।

এই গরিব দেশেও অনেকেরই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য, বস্ত্র বা অন্যান্য সামগ্রী কিনে রাখার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কমবেশি সবাই ওয়াকিবহাল।  কয়েক বছর আগে আমার কাছে  বহুল প্রচলিত এক ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক জানতে চেয়েছিলেন- বাংলাদেশে ‘অপচয়ের অর্থনীতি’র  আকার কত? শুধু প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনা বা মজুত নয়, যে কোনও বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠান এমনকি গরিব দেশের সরকারি কেনাকাটার ধরন দেখলেও একই ধারণা হবে।            

কিছুদিন ধরে দেখছি, অনেক বন্ধুজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন- কলকাতায় ইলিশ কেটে বিক্রি হয়। এটা নিয়ে  এমনকি হাসাহাসি চলছে ফেসবুকে। আমি নিশ্চিত যারা হাসছেন তারা সবাই কম বেশি ইলিশ আস্ত কিনে খাওয়া লোকজন। তারা জানেন না বাংলাদেশের কতজন লোক বা পরিবার ইলিশ কিনে খেতে পারছে।

যদি কলকাতার মতো কেটে পিস পিস করে মাছ বিক্রি হতো তাহলে আমাদের আশেপাশের স্বল্প আয়ের লোকজনগুলো একবেলা ইলিশ চেঁখে দেখতে পারতো। কত মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত  ইলিশ খেতে পারে না সে খবর কি আমরা রাখি!

যদি গাদা পেটি মাথা আলাদা করে বিক্রি হতো তাহলে দশ হাজার টাকা বেতনে কারখানায় চাকরি করা লোকটা তার বাচ্চার খাওয়ার প্লেটে একটু ইলিশ দিতে পারতো।

বাংলাদেশে এক পিস আপেল কেনা আর ভিক্ষা করা সমতুল্য। অথচ নিম্নবিত্ত  একটি আনার বা দুটো আপেল কিনতে পারলে স্বস্তি পেতো। বাংলাদেশের দোকানির কাছে এরকম ক্রেতা হয়তো স্রেফ মিসকিন হিসেবেই বিবেচিত হবে। ভারতে কিন্তু এভাবে সবাই কিনে খায়। এমনকি ধনী দেশের লোকজনও চার পিস আপেল কেনে চাহিদা অনুযায়ী।

আমার প্রায়ই কলকাতায় যাওয়া হয়। ওখানে দেখেছি ২৫০ গ্রাম মুরগির মাংস বা ২ পিছ মাছ কেনা যায়! বেশি কিনলে নষ্ট। এটা অপচয় রোধ করে। এটা কিপ্টামি না। বাসি পচা খাওয়া থেকেও এ পদ্ধতি অনেক উপকারী। কলকাতায় এক পিছ মিষ্টিরও সুন্দর কাগজের প্যাকেট আছে। ওখানে যার যতটুকু প্রয়োজন সে ততোটা নিতে পারে। এ সুবিধা খুবই ভালো।

সভ্য সমাজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনে না। ইউরোপ আমেরিকার জনগণ একটি চকলেটবার নিয়ে বন্ধুর বাসায় যায়। বন্ধু এককাপ কফিতে আপ্যায়িত করে। আমাদের মতো ৩ কেজি মিষ্টি নিয়ে হাজির হয় না আত্মীয় পরিজনের বাসায়। যার অনেকটাই ময়লার স্তূপে ঠিকানা হয়।

আতংকিত হয়ে কেনাকাটা বা মুনাফা লাভের চেষ্টা নতুন কিছু নয়। দুঃখের কারণ হচ্ছে অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগেও মানুষ আদিম প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগে  আমরা যেখানে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়িয়েছি তখন দেখেছি মানুষ আপৎকালে মজুতদারি ছেড়ে বরং মানুষের কাছে এগিয়ে এসেছেন। তাহলে ২০২০ সালে এসে আমরা কেন প্রয়োজনের অনেক অনেক বেশি খাদ্যসামগ্রী বা ওষুধপত্র মজুত করে অন্যান্য ভোক্তা বা মানুষকে  বঞ্চিত করবো, বাজারে সরবরাহ বা জোগান ঘাটতি করে দাম বাড়াতে সাহায্য করবো? সমস্যার সমাধান কিন্তু সরকার বা পুলিশের হাতে নয়, আমাদের হাতে। আমাদের বিবেক বুদ্ধির কাছে।

আমার সরকারি কর্মকর্তা বাবা অবসরগ্রহণের পর মৃত্যুর আগে আমাদের এমনকি তার নাতি-নাতনিদেরও এগুলো বলতেন। বলতেন- তোমরা জানো না- বাংলাদেশে কত লোক অনাহারে- স্বল্পাহারে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা বাজারে জোগান সংকটে পণ্যের দাম বেড়ে যায় আর ভুক্তভোগী হয় দিনে কিনে দিনে খাওয়া গরিব লোকজন। আমি নিশ্চিত আমাদের অনেক শিক্ষকও একই কথা বলতেন। আমাদের সম্পদশালী অমিতব্যয়ী লোকের চাইতেও বিবেকবান এবং যুক্তিশীল লোকের বেশি প্রয়োজন।              

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক।

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ