X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘খুঁটির জোরে ছাগল নাচে!’

রেজানুর রহমান
০৭ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৫৩আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৫৪

রেজানুর রহমান কী মারাত্মক স্বীকারোক্তি। একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য স্বয়ং স্বীকার করলেন তার এলাকায় একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। নোয়াখালী-৩ আসনের এই সাংসদের নাম মামুনুর রশীদ কিরণ। কোনও প্রকার রাখঢাক না করেই তিনি তার এলাকার সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম বলে গেলেন। দেলোয়ার বাহিনী, সম্রাট বাহিনী, সুজন বাহিনী, কাশেম বাহিনী, আলাউদ্দিন বাহিনী...আরও কত নাম! একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে নামগুলো বললেন ওই সাংসদ। তিনি একজন মানবাধিকার নেতাও বটে। তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি একদিকে যেমন আশা জাগিয়েছে, অন্যদিকে তেমনই আতঙ্কও ছড়িয়েছে। একজন সাংসদ হলেন দেশের নির্ধারিত এলাকার অভিভাবক। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একজন সাংসদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। অথচ তিনিই যদি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম বলে নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তাহলে কী বার্তা পাই আমরা?

বার্তাটা খুবই পরিষ্কার। একজন মাননীয় সাংসদের মুখে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম উঠে আসা মানে এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ হওয়া। ব্যাপারটা যদি এমন হতো, সাংসদের মুখে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নাম উঠে আসার পর তারা অর্থাৎ বাহিনীগুলো ভয় পেয়েছে। অথবা সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীগুলোর ওপর অ্যাকশন অর্থাৎ নজরদারি শুরু হয়েছে। কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটেনি। বরং সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছে। সাংসদের মুখে তাদের নাম উঠে আসা মানেই ফ্রি পয়সায় বড় বিজ্ঞাপন। এতদিন হয়তো অনেকেই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নাম জানতো না। এখন জেনে গেলো! ফ্রি বিজ্ঞাপনে উপকার পেলো সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো। ভবিষ্যতে তাদেরকে হয়তো মুখ ফুটে চাঁদা চাইতে হবে না, জোর করে কারও জমি দখল করতে হবে না। এলাকার কোনও সুন্দরী মেয়েকে তাদের পছন্দ হয়েছে, ব্যস সহজেই উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কেউ হয়তো সাহস করে প্রতিবাদও করবে না। কারণ স্বয়ং মাননীয় সাংসদ এই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নাম বলেছেন। তার মানে এরা অনেক পাওয়ারফুল।

হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে এই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোই অনেক ‘পাওয়ারফুল’। শহরে তো বটেই গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এরা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলে ভিড়ে যায়। দলের নীতি আদর্শের ছিটেফোঁটাও জানে না। শুধু জানে নেতা-নেত্রীর নাম। দিতে পারে শ্লোগান। আর যদি ভালো বক্তৃতা দিতে পারে তাহলে তো কথাই নেই। যেন সোনার টুকরো ছেলে। তবে সন্ত্রাসী ক্যাডার হতে পারলে গুরুত্বটা আরও বাড়ে। কাজ তো তেমন কিছুই না। চোখে থাকবে সানগ্লাস। পরনে জিন্সের প্যান্ট, শার্ট অথবা টিশার্ট। পায়ে দামি জুতা! নেতার আগে পিছে ছায়ার মতো থাকতে হবে। নেতাকে প্রটেক্ট করতে হবে। নির্ধারিত এলাকায় নেতা যাওয়ার আগেই যমদূতের মতো এলাকায় হাজির হতে হবে। যাতে এলাকার লোক ভয় পায়। যে যত ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে সে তত বড় ক্যাডার। নেতার আপন মানুষ। হরিহর আত্মা। নেতার কাছে হরিহর আত্মা হয়ে ওঠা সন্ত্রাসীরাই এক সময় কোনও না কোনোভাবে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী তৈরি করছে। এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে উঠছে। এদের প্রধান কাজই হলো কোনও না কোনোভাবে স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নেতানেত্রীর সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করা। তাদের সঙ্গে ছবি তোলা। এবং এই ছবিকেই প্রভাব বিস্তারের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা।

প্রতিটি রাজনৈতিক দল শেকড় পর্যায়ের রাজনীতিকে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে শেকড় পর্যায়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিচয় পেতেই সবার আগ্রহ। এখানে আদর্শের বালাই নেই। দলের নীতি ও আদর্শ নিয়ে কারও মাথা ব্যথাও নেই। যত পারো দলের লোক জড়ো করো। দলে ভেড়াও। দল ভারী করো। হ্যাঁ, দল ভারী হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এতে দলের কোনও লাভ হচ্ছে না। দলীয় পরিচয় পেয়ে সেটাকে দলের চেয়ে নিজের আখের গোছানোর কাজে লাগাতেই ব্যস্ত হচ্ছে অধিকাংশরাই। অতীতকালে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল মূলত শহরে। এখন শহরের চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চর্চা শুরু হয়েছে। কোনও না কোনোভাবে দলের নেতা হতে পারলেই সামনের ভবিষ্যৎ ঝরঝরা। অর্থাৎ পরিষ্কার। সে কারণে দলের নেতা হওয়ার দৌড়ে সবাই ব্যস্ত। একবার নেতা হতে পারলেই আর পায় কে? কিসের নীতি, কিসের আদর্শ? কিসের আইন। সবই তো নেতার হাতে। সে যত ছোটো নেতাই হোক, যদি থাকে কূটবুদ্ধির যোগ্যতা তাহলেই কেল্লাফতে।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আগের দিকে গ্রামের রাস্তাঘাটে নেতা-নেত্রীর ছবি দেখা যেতো না। এখন গ্রামের রাস্তাঘাটেই নেতা-নেত্রীর ছবিওয়ালা ব্যানারই বেশি। বড় ব্যানার, ছোট ব্যানার, ঢাউস আকারের ব্যানারে এলাকা সয়লাব। অধিকাংশ ব্যানারের ওপরের দিকে দায়সারাভাবে জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর ছবি থাকে। নিচে থাকে স্থানীয় নেতার বড় ছবি। একজনের দেখাদেখি অন্যজন প্রতিযোগিতা করে ছবিওয়ালা ব্যানার টাঙিয়ে রাখে। অনেক সময় ব্যানার টাঙানো নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর সঙ্গে নিজের তোলা ছবি থাকলে ব্যানারে সেই ছবিতেই গুরুত্ব দেয় অনেকে। এতে নাকি প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর সঙ্গে ছবি থাকলে পাওয়ার খাটানোর ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়, এমনটাই বললেন গ্রামের একজন শিক্ষক।

বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আগে ছিল কাঁচা সড়ক। এখন সড়ক পাকা হয়েছে। দ্রুতগতির যানবাহনও বেশ শব্দ করে যাওয়া আসা করে। গ্রামের সড়ক পথে যতই হাঁটছি ততই অবাক হচ্ছি। কিছুদূর অন্তর অন্তর বড় গাছ অথবা কোনও স্থাপনায় শুধুই ব্যানার আর ব্যানার। ব্যানারে জাতীয় নেতা-নেত্রীর ছবি ওপরে রেখে নিচে স্থানীয় নেতাকর্মীর বিশাল বিশাল সাইজের ছবি স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ ব্যানারে বানান ভুল। একটি বিশাল ব্যানারে একজনের ছবি দেখে একটু অবাক হলাম। ছবির ছেলেটি লেখাপড়া জানে না। এলাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত। জাতীয় পর্যায়ের এক নেতার সঙ্গে তোলা তার একটি ছবি ব্যানারে স্থান পেয়েছে। ওই একটি ছবিই তাকে এলাকায় নেতা বানিয়েছে। চাঁদা আদায় আর অন্যের জমি দখল করা তার মূল কাজ। সে নাকি ধর্ষণ মামলার আসামিও। অথচ দাপট দেখিয়ে বেড়ায় এলাকায়।

এখন প্রশ্ন হলো একজন অশিক্ষিত সন্ত্রাসী তরুণ এলাকায় এভাবে দাপট দেখিয়ে বেড়ানোর সাহস পায় কোত্থেকে? গত কয়েকদিন ধরে বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। ঘটনার হোতা দেলোয়ার হোসেন তেমন কিছুই করে না। এক সময় সিএনজি চালাতো। সে-ই এখন হয়ে উঠেছে একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান। তার উত্থানের কাহিনি অনেক চমকপ্রদ। স্থানীয় নেতাদের ‘চামচাগিরি’ করতে করতেই সে এখন সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান! এলাকার এমপি থেকে শুরু করে এমন কোনও নেতা নেই যার সঙ্গে তার ছবি নেই। এসব ছবির কল্যাণে সে ধীরে ধীরে ভয়ংকর সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। সে অপরাধ করলেও গ্রামের অসহায় মানুষ মুখ ফুটে কিছু বলে না। প্রতিবাদ করে না। তাদের একটাই ভয়, প্রতিবাদ করলেই যদি হিতে বিপরীত হয়। নেতাদের সঙ্গে যার দহরম মহরম, সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলতে তার তো সময় লাগার কথা নয়।

সিলেটে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাহিনিও অনেকটা একই রকম। এক সময় নেতাদের পেছনে ঘুরেছে। জীবন বাজি রেখে অনেক অশোভন, অনৈতিক কাজে নেতাদেরকে সহযোগিতা করেছে। এভাবেই একদিন তারা ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছে।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে দেশজুড়ে এই যে এতো সন্ত্রাসী ঘটনা বিশেষ করে ধর্ষণকাণ্ড চলছে, এর মূলে রয়েছে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের মদত। অর্থাৎ রাজনৈতিক সাহস। বিশেষ করে সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দলীয় পরিচয়ে সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। একই উপজেলায় হয়তো একটি ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে ৩টি গ্রুপ, যুব সংগঠনের পরিচয়ে একাধিক গ্রুপ, মূল সংগঠনের পরিচয়েও একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। ফলে পুলিশ কোন গ্রুপের সঙ্গে থাকবে, এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ফলে অনেক সময় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে আর কত দিন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের নানাস্থানে ধর্ষণকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না। ধর্ষণকারীদের তো বটেই পাশাপাশি প্রশ্রয়দাতাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

মাননীয় মন্ত্রীর কথায় আমরা ভরসা রাখতে চাই। কিন্তু এটা যেন কথার কথা না হয়! প্রসঙ্গক্রমে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের একটি বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেছেন, ধর্ষণ যারা করছে আমরা সেই অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। অপরাধীদের শাস্তি দেখলে তার চারপাশে থাকা মানুষগুলো সতর্ক হবে।

এটাই আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। অপরাধীদের শুধু গ্রেফতার করলেই হবে না। দ্রুততার সঙ্গে বিচার সম্পন্ন করে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে সত্যি কি আমরা আন্তরিক? একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করি। সিলেটে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের যেদিন প্রথম আদালতে তোলা হয়েছিল সেদিন তারা প্রকাশ্যে হম্বিতম্বি, দম্ভোক্তি করেছে। এমন কথাও বলেছে, কেউ নাকি তাদের কিচ্ছু করতে পারবে না? এই ধরনের দম্ভোক্তি করার সাহস তারা কোথায় পেয়েছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর আছে। সকলেই বোধকরি এই প্রবাদ বাক্যটা জানেন, খুঁটির জোরে ছাগল নাচে!

প্রিয় পাঠক, আশঙ্কা কী শেষ পর্যন্ত থেকেই যাচ্ছে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ