X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাগরিকের প্রাণের মূল্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৪ অক্টোবর ২০২০, ১৫:০৩আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২০, ১৫:০৪

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আবারও লজ্জার এক মুহূর্ত তৈরি হলো। যিনি রক্ষকের ভূমিকায়, তার বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ। সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ৩৪ বছরের যুবক রায়হান আহমদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভোর রাতে পুলিশ হেফাজত থেকে ফোন করে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাবার কাছে দশ হাজার টাকা চেয়েছিল রায়হান। তার পা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। এমনকি তার হাতের নখ উপড়ানো ছিল। প্রথম দিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করলেও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর এখন ঘটনার তদন্ত চলছে। যার বিরুদ্ধে এই নির্মম বর্বরতার অভিযোগ, ফাঁড়ির ইনচার্জ সেই এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করেছে এসএমপি।   
কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যার রেশ কাটেনি। এক মাস হয়েছে পল্লবীর গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনিকে পুলিশের হেফাজতে হত্যার ঘটনায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে করা মামলার রায়ে পুলিশের তিন সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের কথাও মনে আছে আমাদের। এখন আবার এক রক্ষকের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অভিযোগ। কক্সবাজারের ঘটনা, মিরপুর রায়ের পরে আমাদের আশা ছিল পুলিশের বদনাম ঘুচবে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে তারা অমানবিকতার মুখ নয়, গায়ে তাদের অত্যাচারীর পোশাক নয়।

কিন্তু এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো অনেক পুলিশ সদস্যেরই ওরিয়েন্টেশন সমস্যা আছে, আছে মানুষকে মানুষ না ভাবার মনস্তত্ত্ব। আইনরক্ষার ভার যাদের হাতে তুলে দিয়েছে রাষ্ট্র, দেশের আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন তারা। পুলিশের একটা অংশের বিরুদ্ধে ঠিক এই অভিযোগটাই করছে মানুষ। মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার গুরুদায়িত্ব যাদের কাঁধে, তা বহন করার শক্তি অর্জন করতে হয় তাদের। অন্যথায় ঔদ্ধত্যসুর্ধিত অপব্যবহারই যে হয়, তা আরও একবার প্রমাণ হলো সিলেটের বন্দরবাজারে।

পুলিশের এক অমানবিক মুখ দেখা গেলো এই ফাঁড়িতে। যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচানো যেতে পারতো এই যুবককে। নির্মম অত্যাচারে আহত হওয়ার পরও তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না পাঠিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির হাজতে রেখে আরেক বড় অপরাধ করেছেন ফাঁড়ি ইনচার্জ। শুধু তাই নয়, ভয়ংকর মিথ্যারও আশ্রয় নিয়েছে সেখানকার পুলিশ। ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া রবিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রায়হানকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসাই হয়নি। ফাঁড়িতে নিয়ে আসার বিষয়টি সত্যি নয়। তাকে কাষ্ঠঘর এলাকায় গণপিটুনি দেওয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ কিন্তু সিলেট সিটি করপোরেশনের সিসিটিভির ফুটেজে ওই এলাকায় এমন কোনও ঘটনার সত্যতা মেলেনি।

কী বলবেন পুলিশের উচ্চস্তরের নেতৃত্ব? আমরা কোনোভাবেই বলতে চাই না যে, পুলিশ অর্থেই অমানবিক বা অত্যাচারী। অসংখ্য পুলিশকর্মী আছেন, যারা এর উল্টো পথের পথিক, সমাজ তাদের সম্মান করে। এই করোনাকালেও আমরা পুলিশের অসংখ্য মানবিক কাজের দৃষ্টান্ত দেখেছি। মানুষ বিপদে পড়লে সবার আগে পুলিশের কথাই ভাবে। তাই মানুষকে শুধু সাহায্য নয়, মানবিকতার চর্চার চিন্তাটি পুলিশ সদস্যদের ভেতরে আসতে হবে আরও গভীরভাবে। একটা কথা মনে রাখতেই হবে, রাষ্ট্রের অনেক অনেক শক্তির ভেতর পুলিশ সবচেয়ে দৃশ্যমান, তাই তার কাজের পাবলিক অডিটও অনেক বেশি।

যার শক্তি আছে, সে ক্ষমতার স্বাদও পায়। কিন্তু ক্ষমতা চর্চা হতে হবে মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ থেকে। সিলেটের রায়হান মারা গেছে তার ছোট্ট সাজানো সংসারটি রেখে। কী এক অনিশ্চয়তায় পড়েছে তার পরিবারটি সেটি এসআই আকবর বা তার সহকর্মীরা ভাবতেও পারবেন না। অনেকেই বিনা কারণে বা ছোট্ট অপরাধে পুলিশ কর্তৃক শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন। এই মানুষগুলো তার চেয়েও বেশি করে, মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হন সেটা কি পুলিশ সদস্যরা কখনও ভেবে দেখেন? সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারে মানুষ অনেক রকমের সমস্যা নিয়ে, অনেক দৈনন্দিন গ্লানি আর অপমান সহ্য করে, অনেক অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে বেঁচে থাকে। বিরাট মর্যাদা তাদের নাই, একটা জান নিয়ে কোনোভাবে দিনযাপন করে। সেটাও এভাবে নিয়ে নেওয়া যায়?

পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট সক্রিয় হলে কোনও কোনও সদস্যের এই সব অনাচার বন্ধ করা কঠিন নয়। পুলিশের, কোনও কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে, মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পুরনো। এগুলোর ব্যাপারে কঠোর হতে হবে পুলিশ প্রশাসনকে। নিজেদের কাজের নিয়মিত মূল্যায়ন এবং তৎসম্পর্কিত অভাব-অভিযোগ বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন পুলিশের বড় কর্তাদের। পুলিশের সঙ্গে জনগণের কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত না হলে, পুলিশের সহযোগিতার ওপর ভরসা রাখতে না পারলে, সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হবে। আর সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদের মতো ঘটনা ঘটতে থাকলে, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে মানুষের ভেতর ভাবনা আসবে–নাগরিকের প্রাণের আবার মূল্য কী?

লেখক: সাংবাদিক

 

 
/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ