X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ফেমাসিজম’ দিয়ে ফেমিনিজম হত্যা

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
১৬ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪৫আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৫৩

হায়দার মোহাম্মদ জিতু সভ্যতার বিবর্তনে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যুদ্ধ-বিগ্রহ নিত্য দিনের সংকট ও সম্ভাবনার উদাহরণ। যা আজও বহমান। যদিও একবিংশ শতকের অভিনয়-মোড়কে তা অনেকটা বদলে গেছে। এখন যুদ্ধ চলে সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের আদলে। আর এই মিছিলে টিকে থাকার কিংবা দখল নেওয়ার উৎকৃষ্ট হাতিয়ার হলো স্বল্প আয়োজন ও স্বল্প খরচে অধিক সুবিধা সেবা-সংযোজন।
সমৃদ্ধি ও সম্পত্তি অর্জনের এই যুদ্ধপথে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ আজ ভুলতে বসেছে ব্রেক ধরবার তাগিদ। ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে বৈশ্বিক সামাজিক সংকট। ভোগবাদী মানসিকতায় মানুষ আজ মানুষকে বিবেচনা করছে পণ্য বা উপভোগ্য বস্তুতে। যার প্রমাণ বিকৃত যৌন ক্ষুধায় ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারী। আর এর দায় যেমন আছে পুরুষের বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার, তেমনি আছে আপন আপন দায়িত্ববোধেরও।
এখনও পরিবারে কোনও সন্তান জন্ম নিলে তার লিঙ্গ বিবেচনায় সেখানে খুশির মাত্রা উঠানামা করে। নির্ধারিত হয় নারীর প্রতি উদাসীনতা কিংবা সাধুবাদের ব্যারোমিটার। যদিও বায়োলজিক্যাল বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে যে ছেলে বা মেয়ে সন্তানের জন্যে এককভাবে পুরুষই দায়ী। কিন্তু তবু এই তথ্যের বিকাশ একেবারে মফস্বল পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আর এ কারণে সেখানে আজও  এই দায় যায় নারীর ঘাড়েই। অর্থাৎ এখনও নারীকে কল্পনা করা হয় একখানা চাষযোগ্য বা ভেদনযোগ্য উর্বর জমিন হিসেবেই।
গেলো বেশ কিছু দিন ধরে দেশে করোনা মহামারির পাশাপাশি আরেক সামাজিক মহামারির স্রোত বইছে। যার নাম ধর্ষণ। এই স্রোতের মাত্রা এখন এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে তাতে ভেসে চলেছে সর্বস্তরের মানুষই। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এর প্রতিবাদ করছেন। বিবেকবোধের এই তাড়না সত্যিই সাহসের। কিন্তু ঘটে যাওয়া ধর্ষণগুলোর কেসস্টাডি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় এগুলো নিতান্তই জৈবিক নয়; বরং মানসিক বিকৃতি এবং কোথাও কোথাও প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার ফলাফল।
যার প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ৭০ বছরের একজন নারী (ওজু করতে বের হয়ে), পুরোহিতের কাছে শিষ্য, মাদ্রাসার শিক্ষকের কাছে ছাত্র, চকোলেট-আইসক্রিম দেওয়ার নামে শিশু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে শিক্ষক, বাম রাজনৈতিক কর্মী তারই সহযোদ্ধাদের দ্বারা মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে, বিয়ের প্রলোভনে একটি নব্য ছাত্র সংগঠনের প্রতিবিপ্লবীদের দ্বারা তারই সহযোদ্ধা আক্রান্ত। ধর্ষণের গ্রাফগুলো এমনই। অর্থাৎ একে একপাক্ষিক যৌনাচরণ ভাবার সুযোগ নেই। এর সঙ্গে জড়িত নৈতিক অবক্ষয়, নির্যাতনের মানস ও অপরাধ প্রবণতা।
কিন্তু ভয়ঙ্কর সংকটের বিষয় হলো এই সমস্যাগুলোকে এভাবে বিবেচনা না করে একটা খুব সামান্য অংশ দোষারোপের সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন এবং একপাক্ষিক সমালোচনা করছেন। এককথায় ধর্ষণের রাজনীতি করছেন। এরাই নিজেদের উঠতি ‘ফেমাসিজম’ (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভর) দিয়ে ফেমিনিজম ও সামাজিক সংকটগুলোকে আড়াল করতে চান। এককথায় এরা ট্রাবল মেকার বা ট্রাবল ক্রিয়েটর, ট্রাবল শুটার নয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে বললে, যেখানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক মোকাবিলা এবং আত্মশুদ্ধির নীরব পারিবারিক বিপ্লব প্রয়োজন সেখানে এরা সেটাকে সরকার পতনের বিপ্লবে রূপ দিতে চেষ্টা করছেন। বিরোধীদলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নারীকর্মীরা ধর্ষণের মতো সংকটকে পাশ কাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন সরকার পতনের, প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন যাতে লেখা, ‘... me, তবু শেখ হাসিনার পতন চাই’ ! এই যদি প্রতিবাদের ভাষা হয় তবে এদের প্রতিবিপ্লবী বলতে দ্বিধা নেই। কারণে প্রতিবিপ্লবীরা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে থাকেন এটাই ধারাবাহিক দৃশ্যমানতা।
আরেকজন আছেন যিনি নিজেই ধর্ষণ সহযোগিতাকারী হিসেবে আসামি। তিনি যদি ট্রাবল শুটারই হতেন তবে নিজের উঠতি ফেমাসিজম কিংবা চৌকসতা দিয়ে আগে নিজের সংগঠনের ধর্ষণ সমস্যাটিকেই সমাধানে উদ্যোগী হতেন। কিন্তু কয়েকজনের সংগঠনেই তিনি ব্যর্থ বা বলা যায় তিনি বিষয়টিকে পুরুষতান্ত্রিকতার মোড়কে দেখেছেন। তাই হয়তো অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নেননি!
এক্ষেত্রে আক্রান্তদেরই সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কারণ তাদের আক্রান্ত হওয়ার অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কেউ যেন সেটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারেন। কারণ, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন চিন্তা এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে রাজনীতিতে টিকতে না পারা জোটবদ্ধ বিরোধীরা এখন ইস্যুভিত্তিক রাজনীতি করতেই তৎপর।
তারই ধারাবাহিকতায় ধর্ষণের মতো সামাজিক অবক্ষয়কে এরা সরকার পতনের আন্দোলনের টানেলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ এই সংকটগুলোর সহায় পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। ভিন্নভাবে বললে, একজন কন্যাসন্তানের বাবাকে যেন আমৃত্যু তাঁর মেয়ের জন্যে ধর্ষণ আতঙ্কে না থাকতে হয় সেজন্যে সমাজের ছেলে সন্তানের বাবাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। আর অসম শরীর ও বয়স সম্পর্কিত যৌনাচারণের কারণ অনুসন্ধানে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীদের পরামর্শ জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন বাঙালি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধের জাগরণ। কারণ, এখানেই আছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীল-সম্মিলিত সমাজ বিনির্মাণের শেকড়।
পাশাপাশি নারীকেন্দ্রিক এই যৌনাচারণগুলো রুখতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিচারিক সংস্কৃতির সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত জরুরি। আর এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে গ্রিক নাট্যকার আরিস্টোফিনিসের লিসিস্ট্রাটা নাটকের গল্প কাঠামো। যেখানে এথেন্স ও স্প্রাট্রা দুই অংশের যুদ্ধ উন্মাদনা থামাতে সকল নারী সম্মিলিতভাবে যৌনাস্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ দুই অংশের পুরুষেরা যুদ্ধ না থামালে কোনও নারী আর তার পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমে জড়াবেন না। আইন প্রয়োগে এরকম সম্মিলিত অধিকার আয়োজন প্রয়োজন। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে সেটাকে কেউ যেন আবার নিজেদের ভিন্ন স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করতে না পারেন।
বিষোদগার করা বা ছড়ানো ভীষণ সহজ। কিন্তু যার যার অবস্থান থেকে পারিবারিক শিক্ষার আবহে মানুষ হয়ে ওঠা বড় কঠিন। আজকের অনেকেই এই সহজ পথের যাত্রী। তাই উপরি-উপরি শুধু অভিনয়ই চলছে কিন্তু মূল শেকড়-সমস্যার সমাধান মিলছে না। কাজেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ঝাণ্ডা ছিঁড়ে নিজেদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নারীকেই মানুষ হয়ে এবং পুরুষকেও মানুষ গড়বার ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি পুরুষকেও স্মরণে রাখতে হবে ধরণীর বুকে সে-ও কোনও নারীর নাড়ি এবং সে-ও কোন কন্যা বা নারীর আত্মজ। আর দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিজ্ঞানীদের সামাজিক সচেতনতা ও এই অপরাধগুলো খণ্ডনে আরও জোরদার ভূমিকা রাখা জরুরি। কারণ, সমকালীন ঘটনাগুলোতে স্পষ্ট যে এই ধর্ষণের মানস শুধুই নারী, নারীর পোশাক বা সঙ্গমকেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষা নয়; বরং অপরাধ প্রবণতা, নৈতিক সংকট ও সাংস্কৃতিক শূন্যতা।
লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ