X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ ও নারীর পোশাক

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৭ অক্টোবর ২০২০, ১৭:০৪আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২০, ১৭:০৬

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার ‘উচ্ছৃঙ্খল যৌনসংসর্গ’ মানুষের মর্যাদাকে পশুর চেয়েও নিচে নামিয়ে দেয়। জগৎখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আল বেরুনীর এই উক্তি আজও শতভাগ সত্য, সাম্প্রতিক দেশজুড়ে একের পর এক ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা তার বড় প্রমাণ। ওই সব নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা সত্যি মানুষের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। ওই ঘটনা এতটা ন্যক্কারজনক যে তা পশুতুল্যও নয়। মানুষের মতো পশুরা কখনও তাদের স্বজাতি নারীদের শ্লীলতাহানি করার জন্য দলবেঁধে নেমেছে বলে অন্তত শুনিনি। সিলেটের এমসি কলেজের মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া গণধর্ষণের ঘটনা অনন্ত ওইসব মানুষের অবয়বযুক্ত অমানুষকে পশুদের থেকেও নিকৃষ্ট পর্যায় ভুক্ত করেছে, যা প্রকাশে বাংলা অভিধানের শব্দভান্ডার হয়তো যথেষ্ট নয়।

তবে দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া ধর্ষণকাণ্ড ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় বাংলা সিনেমার নায়ক অনন্ত জলিলের মতো অনেকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দায়ভার উল্টো নারীদের ওপর চাপিয়ে এই ঘটনার জন্য তাদের পোশাককে দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, নারীরা যদি সঠিকভাবে পোশাক পরতেন; তবে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য, যারা এমন পরামর্শ প্রদান করছেন তারাও এক অর্থে ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের সমর্থন করছেন। কারণ যারা এই ঘটনায় যুক্ত তারাও এমনটি ভেবেছেন। পোশাকের দোহাই দিয়ে তারা নারীর শরীর জনসম্মুখে ভোগ করতে চেয়েছেন। তারা নারীকে মানুষ না ভেবে কেবল ভোগের সামগ্রী মনে করেছেন। তাই যারা সরাসরি নারী ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আর যারা নারীকে কথিত শালীন পোশাক পরার পরামর্শ প্রদান করছেন উভয়ের চিন্তা-চেতনা একই সূত্রে গাঁথা। সংকটটা উভয়ের মনস্তত্ত্বের।

পোশাক নারীর শ্লীলতাহানি করার জন্য দায়ী এই দৃষ্টিভঙ্গি আর যাই হোক সভ্য নয়। পুরুষের যেমন নিজের পোশাক নির্বাচনের অধিকার রয়েছে, তেমনি নারীরও তা রয়েছে। আর পোশাকই যদি নারীর শ্লীলতাহানির প্রধান ও একমাত্র কারণ হয়; তবে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিটি মা-বোনই প্রতিদিন তাদের পুরুষ সদস্য কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হতো। কারণ পাহাড়ি নারীরা অনেক সময় একটি কাপড় ব্যবহার করে শরীরের ওপরের ও নিচের অংশ ঢেকে থাকে। সমতলের নারীরা পাহাড়ের ওই নারীদের চেয়ে শরীরের বেশি অংশ ঢেকে রাখেন। বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের পথে-প্রান্তরে ঘুরে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আলোকেই বলছি, পোশাকের কারণেই নারীরা ধর্ষণের শিকার হয় অথবা শ্লীলতাহানির স্বীকার হয়, সেই কথাটি আদৌও সত্য নয়।

বেশ কয় বছর আগে সাংগ্রাইতে জল উৎসব দেখতে গিয়েছিলাম। ওই সাংগ্রাই জল উৎসবে যেসব মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছেন তারা কেউই শরীরের ওপরের অংশে ওড়না ব্যবহার করেননি। কিন্তু কোথাও শোনা যায়নি যে, মারমা মেয়েদের ওপর মারমা পুরুষরা পোশাকের দোহাই দিয়ে শ্লীলতাহানির উৎসবে মেতে উঠেছেন। বাংলাদেশের যেসব মেয়ে ধর্ষণের বা নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিহিত পোশাক মারমা মেয়েদের চেয়েও বেশি রক্ষণশীল ছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, মুসলিম শাসনের পূর্বে এদেশের নারী-পুরুষ উভয়েই একই ধরনের পোশাক পরিধান করতেন। নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, নারী এবং পুরুষ উভয়ই পরতেন একটি মাত্র বস্ত্র-শাড়ি অথবা ধুতি।...নারী ও পুরুষ উভয়ই শরীরের ওপরের অংশ খোলা রাখতেন। আর ওই নারীর শরীরের ওপরের অংশ খোলা রাখার কারণে বাংলাদেশের প্রাচীন যুগের মানুষরা নিশ্চয় নারীর বক্ষ উন্মুক্ত সেই অজুহাতে শ্লীলতাহানি অথবা ধর্ষণের উৎসব করেননি। প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসে নানা অপরাধের কথা জানা গেলেও দলবেঁধে যুবকদের নারী ধর্ষণে মেতে ওঠার কথা জানা যায় না। যদি পোশাকের কারণে অর্থাৎ বক্ষ আর নাভি উন্মুক্ত রাখাই ধর্ষণের মূল কারণ হতো, তবে আমাদের পূর্ব পুরুষের সবাই ধর্ষক হয়ে উঠতেন। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আল বদর-আল শামস কর্তৃক বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই ঘটনায় বাঙালি নারীর পোশাকের কি দায় ছিল?  আজ যারা নারীর ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করছেন, তারা কি সেদিনের কথা ভুলে গেছেন?

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে লিখেছেন, ‘অল্প বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে প্রৌঢ় মহিলা, মা, নানী, দাদী—কেউ রেহাই পাননি। অনেক বুড়ি মহিলা বাড়ি থেকে পালাননি, ভেবেছেন তাদের কিছু হবে না। অল্প বয়সী মেয়েদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছেন, তাদেরও ছেড়ে দেয়নি পাকিস্তানি পাষণ্ডরা। এক মহিলা রোগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তাকে টেনে ধর্ষণ করা হয়। আরেক মহিলা কুরআন শরীফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কুরআন শরীফ টান দিয়ে ফেলে তাকে ধর্ষণ করে।’ যারা নারীর শ্লীলতাহানির জন্য তার পোশাককে দায়ী করছেন তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, একাত্তরে নামাজ পড়া বা কোরআন শরিফ পড়া অবস্থায় ধর্ষিত হওয়া ওইসব নারীর পোশাকের দায় কোথায় ছিল?

প্রকৃতপক্ষে পোশাক নয়, মানসিক বিকৃত ঘটার কারণেই বর্তমানে বাংলাদেশের পুরুষরা ধর্ষণের ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়ছে। ওই মানসিক বিকৃতির বিষয়টি পাশ কাটিয়ে দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাকে পুঁজি করে গোঁড়াপন্থি মুসলিমদের একটি অংশ নারীকে শেকলবন্দি করতে সুকৌশলে ধর্ষণের ঘটনায় নারীর পোশাক দায়ী বলে প্রচার করছেন। আর ওই প্রচারণার মাধ্যমে তারা নারীকে অযাচিত পর্দার জালে আবদ্ধ করতে চাইছেন। কিন্তু একথাও সত্য, গোঁড়াপন্থি মুসলিম নেতারা নারীদের যে পর্দা করার কথা বলেন, তার সঙ্গে ইসলামের মৌলিক বিধানের কোনও মিল নেই। বরং ইসলামের মৌলিক বিধানে পর্দার যে কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ নারীই সেই বিধান মেনে চলেন। তারা সবাই শালীন পোশাকই পরেন। পর্দার ক্ষেত্রে আল-কোরআনে নারীদের বুকের ওপর চাদর টেনে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এদেশের ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে প্রতিটি নারী চাদরের ন্যায় বুকের ওপর ওড়না ব্যবহার করেন। আর যারা শাড়ি পরেন তারাও সযত্নে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাই ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনার জন্য নারীর পর্দা না করাই মূল কারণ এমনটি সত্য নয়। বরং নারী নয়, ইসলামের বিধান অনুসারে পুরুষের পর্দা না করাই এ ঘটনা ঘটেছে এমনটি বলা যেতে পারে।

নারীর পাশাপাশি ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্যও পর্দা ফরজ করা হয়েছে। পুরুষ যদি সেই পর্দার বিধানগুলো মেনে চলতো; তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটতো না। তাই যারা নারীকে পর্দা করার জন্য বিনা পয়সায় সবক দিচ্ছেন তারা পুরষকেও পর্দা করতে বলবেন বলে আমরা আশা করি।

আল কোরআনের সুরা নূরে (আয়াত ৩০) বলা হয়েছে, ‘(হে নবী!) মুমিন পুরুষদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে চলে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা। নিশ্চয়ই তারা যাহা কিছুই করে, আল্লাহ তৎ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত।’ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে পুরুষরা যদি আল কোরআনের উপরোক্ত বিধান মেনে দৃষ্টি অবনমিত রেখে চলেন, তাহলে তো তাদের জানার কথা নয়, কোন নারীর বক্ষ উন্মুক্ত অথবা কোন নারী নাভির নিচে শাড়ি পরেছে বা কোন নারীর পোশাক কেমন ইত্যাদি বিষয়। 

তাই পুরুষতান্ত্রিক মানুষিকতা লালনকারী বাংলাদেশের মুসলিমদের উচিত হবে নারীর পোশাক নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার আগে পুরুষকে আল কোরআনের উপরোক্ত আয়াত মেনে পথেঘাটে অফিস আদালতে দৃষ্টি সংযত করে চলাফেরা করতে পরামর্শ প্রদান ও অভ্যস্ত করে তোলার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারীর পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী—এমন প্রচার প্রচারণা থেকে বিরত থেকে বরং পুরুষের চিন্তা পরিবর্তন করা। মনে রাখা দরকার, স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা না করে নারী দেখলে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। ওই ধরনের অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করানোর কথা বলার বদলে যারা নারীর পোশাক নিয়ে মেতে আছেন, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সরকারের কাছে দাবি জানাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যালোচনা করে যেসব পুরুষ নারীর পোশাককে ধর্ষণের জন্য দায়ী মনে করছেন তাদের অতিসত্ত্বর মানসিক চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ ওইসব পুরুষের মধ্যে একটি ধর্ষক মন বসবাস করছে। ভবিষ্যতে তারা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই ওইসব ব্যক্তির মানুষিক চিকিৎসার মাধ্যমে অগ্রিম প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

পরিশেষে, নারীর পোশাকের জন্যই নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে এমনটি সত্য নয়, বরং ওই সব যুবকের মনস্তাত্ত্বিক বিকৃত ঘটার কারণে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তাই নারীকে কথিত শালীন পোশাক পরিধানের পরামর্শ প্রদান করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করে সবার উচিত হবে, পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক জায়গাতে আঘাত করা। নারীকে শুধু ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখার সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরির্বতন করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 

এমএমজে

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ