X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে ভারতে রাজনীতি

আনিস আলমগীর
১৯ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৪৫আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৪৭

আনিস আলমগীর গত ১৪ অক্টোবর ২০২০ সকাল সকাল নতুন দিল্লির এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ইনবক্সে একটি অর্থনৈতিক চার্ট পাঠালো, যেখানে আইএমএফ সূত্র দিয়ে দেখানো হয়েছে–২০২০ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের নিচে নামবে। যদিও সামান্য ব্যবধানের, তারপরও বাংলাদেশের জন্য খুশির খবর এটি। কিন্তু আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এই সমস্ত আগাম বাণীতে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কম হওয়ায় অতটা উচ্ছ্বসিত হতে পারিনি। তাছাড়া, আমার কাছে জিডিপি বৃদ্ধি মানে আমার পকেটে টাকা থাকা, সাধারণ মানুষের হাসি মুখ আর আলু-পেঁয়াজ-চালের বাজারে মধ্যবিত্তের স্বস্তি। সেখানে আমি সুখবর দেখছি না।
দিন শেষ হওয়ার আগেই ভারতীয় মিডিয়ায় এই খবর নিয়ে হৈচৈ দেখে মনে হলো যেন ভারতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। ছিঃ ছিঃ, নরেন্দ্র মোদি যেন তাদের সবার মুখে চুনকালি লাগিয়ে দিয়েছেন। কোথায় চীন-পাকিস্তান হলেও মানা যায়, বাংলাদেশের মতো গরিব প্রতিবেশীর কিনা মাথাপিছু আয় ভারতীয়দের থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছে! অথচ বিজেপির মন্ত্রীরা, এমনকি সুশীল শ্রেণিও প্রতিনিয়ত বলে আসছিল ভাত-কাপড়ের সন্ধানে বাংলাদেশিরা প্রতিনিয়ত ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিষাণ রেড্ডি তো একধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আশ্রয় চাইলে তারা ভারতে নাগরিকত্ব পাবে, কিন্তু মুসলমানদের জন্য এ সুযোগ রাখা হয়নি, কারণ তাহলে অর্ধেক বাংলাদেশি নাকি ভারতে চলে যেতে চাইবে!

জিডিপি নিয়ে মিডিয়ায় যারাই রিপোর্ট করেছেন কেউ বাংলাদেশ নিয়ে কটু কথা বলেননি, কিন্তু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় ইউটিউবারদের সবার বক্তব্যে বেদনার সুর ছিল–অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবে তো হোক, তাই বলে বাংলাদেশের থেকে খারাপ! বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তাদের কেউ কেউ প্রাণ খুলে প্রশংসা করেছেন সত্য, কিন্তু বেদনাটা লুকাতে পারেননি। ক্রিকেট বিশ্বকাপে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ৫ উইকেটে হেরে ভারতের কোয়ার্টার  ফাইনালে যেতে না পারার সময়ও প্রশংসা মিশ্রিত এই ধরনের ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল ভারতীয়দের কণ্ঠে। কেউ কেউ চলতি বছরে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জেতার তাজা ঘায়ের কথাও স্মরণ করেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ তার প্রথম বিশ্বকাপ খেলায় সেই বারের সেরা দল পাকিস্তানকে হারালে পাকিস্তানেও বাংলাদেশকে নিয়ে এ ধরনের মাতম উঠেছিল তখন।

বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে পাকিস্তানের গা-জ্বালা এখন কমে গেছে। তারা স্বীকার করে নিয়েছে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রায় সব সেক্টরে বাংলাদেশ বহু আগে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

জিডিপির খবর প্রচারে মোদিবিরোধী মিডিয়া বেশ সোচ্চার। গত ক’মাস ধরে বাংলাদেশ ভারতকে পাত্তা না দিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে বলে মোদির পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনায় মুখর যে ক’টি মিডিয়া এখনও অবশিষ্ট আছে তারা যেন আরেকটি মোক্ষম হাতিয়ার পেলো হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারকে ঘায়েল করার জন্য। অন্যদিকে মোদির পক্ষের মিডিয়া সংবাদ প্রচার করলেও কিছু অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ দিয়ে বাংলাদেশ যে খুব ছোট অর্থনীতির দেশ এবং ভারতের সঙ্গে টক্করে এখনও অনেক দূরে আছে–সেটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে রাহুল গান্ধীর টুইট আরও বেকাদায় ফেলেছে মোদি সরকারকে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করে বলেছেন, ‘গত ৬ বছরে বিজেপির ঘৃণা ছড়ানোর জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির দুর্দান্ত সাফল্য হলো, বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।’

আসুন দেখে নেই কী ছিল আইএমএফ-এর পূর্বাভাস। ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি তিন দশমিক আট শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। অন্যদিকে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক তিন শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে। আইএমএফের এই পূর্বাভাস ঠিক থাকলে ভারত মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও নেপালের থেকে সামান্য এগিয়ে থাকবে। সে হিসাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তানের আগে চলে আসবে। বাংলাদেশের আগে থাকছে শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ।

ভারত পরবর্তী বছরেই আবার বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে ২০২৪ সালে এসে বাংলাদেশ আবারও ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ভারতের নাগরিকদের মাথাপিছু জিডিপি কমে যাওয়ার পেছনে তাদের দেশের বিশ্লেষকরা দুটি কারণ দেখাচ্ছেন। একটি হলো ২০১৬ সালের নভেম্বরে বড় নোট বাতিল করা। আরেকটি করোনা সংকট মোকাবিলায় ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা, বিশেষত অপরিকল্পিত লকডাউন। অন্যদিকে জিডিপিতে বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। এটা ঠিক নয় যে করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে গেছে। আসলে ২ বছর আগের পূর্বাভাসেও বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে যাবে বলা হয়েছিল।

শুধু জিডিপি নয়, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট গত ১৬ অক্টোবর যে হাঙ্গার ইনডেক্স প্রকাশ করেছে তাতেও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অপুষ্টির হার কমিয়ে ক্ষুধা মুক্তির লড়াই এবার অনেক এগিয়ে আছে। ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫, অন্যদিকে ভারতের অবস্থান ৯৪। পাকিস্তান থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, তার অবস্থান ৮৮। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮।

সত্যি কথা বলতে গেলে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিশ্ব সুখ, টিকাদান, শিশুমৃত্যু রোধ ইত্যাদির মতো সমস্ত সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে ছিল। এবং ভারত কেবলমাত্র দুটি সূচকে এগিয়ে আছে–মাথাপিছু আয় এবং মানব উন্নয়ন সূচকে। এবার মাথাপিছু আয়ে ভারত যদি হেরে যায় বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত সম্মানের। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশকে যেভাবে প্রজেক্ট করে সেটা বন্ধ হবে কিছুটা। ভারতীয় মিডিয়ার এই উপস্থাপনাকে আমি অবশ্য খুব একটা দোষ দেখি না। শুধুমাত্র নিজের কথা চিন্তা করেন–নিজের বাড়ির পাশের গরিব প্রতিবেশীকে আপনি কতটা পাত্তা দেন? পাত্তা পেতে হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় সবার আগে।

ভারতীয় মোড়লরা নিজেরাই এখন উপলব্ধি করছেন যে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করেছিল সেই খোঁটা আর কত! শেখর গুপ্তর মতো নামজাদা সাংবাদিক বলেছেন, ভারতের বাস্তবতা যাচাই এবং নম্রতার মাত্রা দরকার। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশীদের সম্মান করার পাঠ নেওয়া দরকার ভারতের। তিনি বলেন, প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র বড় বন্ধু ছিল ভারতের এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন ব্ল্যাঙ্ক চেক বই নিয়ে মরিয়া হয়ে বাংলাদেশকে পেতে চাচ্ছে, সে বিষয়ে ভারতের সতর্ক হওয়া উচিত। পরিস্থিতি এত মারাত্মক যে, এমনকি আমেরিকাও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। গুপ্ত মোদি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে তার ঝামেলায় বাংলাদেশ কীভাবে ভারতকে সমর্থন দিয়েছে আর সেভেন সিস্টারে ‘সন্ত্রাস দমনে’ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ধরে হাতে তুলে দিয়ে কত ‘সুন্দর ও অপূর্ব’ সহায়তা করেছে।

আমার দৃষ্টিতে সামনের এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আইএমএফ-এর এই রিপোর্ট মোদির জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি মুসলমানদের কোনও ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় হিন্দুদেরকে একরোখা করার চেষ্টায় লিপ্ত। যে কোনও মূল্যে ‘বাংলাদেশ কার্ড’ খেলে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটিয়ে রাজ্যটি দখলে নিতে চায় তারা। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি দিলীপ ঘোষ এখনও বলে চলেছেন, ‘এক কোটি অবৈধ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হবে।’ তাদের দীর্ঘদিনের প্রচারণা হচ্ছে, বাংলাদেশি মুসলমানরা বসবাসের জন্য অবৈধভাবে আর হিন্দুরা নির্যাতিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বানিয়ে বাংলাদেশকে হিন্দু নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দানের ‘মুলা’ও দেখাচ্ছিল তারা। সাউথ এশিয়ান মনিটরের এক খবরে বলা হয়েছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাংলাদেশে অফিস খুলে হিন্দুদের দেশত্যাগে সাহায্য করছে। উদ্দেশ্য একটাই, বিজেপির নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা।

আইএমএফ-এর রিপোর্ট যেন সবকিছুতে জল ঢেলে দিলো। তার ওপর মমতার পশ্চিমবঙ্গের জন্য শেখ হাসিনা আগেরবারে ৫০০ টন থেকে বাড়িয়ে এবার ১৫০০ টন ইলিশ পাঠানো, দুর্গা পূজা উপলক্ষে উপহার হিসেবে স্বয়ং মমতার জন্য শেখ হাসিনার জামদানি আর সন্দেশ পাঠানো কিসের আলামত, মোদি সরকারকে সে হিসাবও কষতে হবে।

পরিশেষে এ কথা বলে শেষ করতে চাই, আইএমএফ-এর এই ভাবীকথন নিয়ে ভারতীয়দের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, আর বাংলাদেশিদেরও খুব সামান্য ব্যবধান নিয়ে খুশিতে গদগদ হওয়ার কিছু দেখি না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ভারতের সমতুল্য হতে এখনও অনেক পথ বাকি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শিক্ষায় আমাদের চেয়ে ভারত অনেক এগিয়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে: যেমন আইটি, মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্যবসায় ভারতের অবস্থান আমাদের অনেক ওপরে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ