X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির ‘আন্দোলন’ ও ‘কৌশল’ এবং সাম্প্রতিক নির্বাচন

আমীন আল রশীদ
২০ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪২আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪৪

আমীন আল রশীদ ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। হেরে গেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থীরা। যদিও সংসদে আসন প্রাপ্তির অনুপাতে বিএনপি এখন তৃতীয় দল। দ্বিতীয় অবস্থানে জাতীয় পার্টি। প্রশ্ন হলো, উপনির্বাচনের ফলাফল যে এর ব্যতিক্রম কিছু হবে, অর্থাৎ বিএনপির প্রার্থীরা জিতবেন—তা কি বিএনপির লোকেরাই বিশ্বাস করতেন? সহজ উত্তর হলো, না। বিএনপিও জানতো তারা এই নির্বাচনে জিতবে না। কিন্তু পরাজয় জেনেও তারা কেন নির্বাচনে অংশ নিলো?
পাঠকের মনে থাকার কথা, গত দুটি জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বহুবার এই কথা বলা হয়েছে যে, তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আবার সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জয়ী হলেও তিনি শপথ নেননি। বলা হয়েছে, এটি ‘কৌশল’।

জাতীয় নির্বাচনে আসন না পাওয়া বা কম পাওয়া নিয়ে সমালোচনার জবাবে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক নেতা বলে থাকেন, তারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন না। মানে ভোটে হারজিত তাদের লক্ষ্য নয়। সিস্টেম পরিবর্তনই (তাদের ভাষায় বিপ্লব) তাদের লক্ষ্য। ফলে গত কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং ‘আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’—এই বক্তব্য শুনে মনে হয়, বিএনপির নেতারাও বুঝি বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ‘সিস্টেম পরিবর্তন’ বা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন।

কয়েকটি প্রশ্ন আছে:

১. ছোটবেলায় আমাদের স্কুল ক্রীড়ার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বলতেন, এই যে তোমরা অনেকে অংশ নিলে। কিন্তু সবাই বিজয়ী হওনি। এটা বড় কথা নয়। খেলাধুলায় অংশ নেওয়াটাই বড় কথা। বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল কি এখন খেলায় (নির্বাচন হচ্ছে রাজনীতির সবচেয়ে বড় খেলা) অংশ নেওয়াকেই মুখ্য মনে করছে?

২. অনেক দিন ধরেই যে তারা এই তথাকথিত ‘আন্দোলন’ এবং ‘কৌশল’-এর ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে—সেটিকে শুধু বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে নাকি এই ‘আন্দোলন’ ও ‘কৌশল’ দেশের পরিবর্তিত রাজনীতি ও নির্বাচনি ব্যবস্থারই প্রতিফলন?

৩. বিএনপি যদি মনে করে বা বিশ্বাস করে যে প্রচলিত নির্বাচনি ব্যবস্থায় তাদের প্রার্থীরা জয়ী হবেন না, তাহলে তারা কেন নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাদ দিয়ে নির্বাচনি ব্যবস্থা ঠিক করার দাবিতে জনমত গড়ে তুলছে না? জনমত গড়ে তোলার মতো সাংগঠনিক অবস্থা কি তাদের আছে?

৪. যে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, সেই নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য বিএনপির নেতারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করেন কেন? নির্বাচন করতে তো অনেক পয়সা খরচ হয়। এটা নিশ্চয়ই কালো টাকা সাদা করার কোনও মাধ্যম নয়। তাহলে বিএনপির যে নেতারা মনোনয়ন ইস্যুতে মারামারি করলেন, দলের মহাসচিবের বাসায় ইটপাটকেল মারলেন, তারা আসলে কী অর্জন করতে চান বা দলের নেতাকর্মী ও জনগণকে কী বার্তা দিতে চান?

প্রসঙ্গত, গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনে ভোট পড়েছে মাত্র ১০.৪৩ শতাংশ, আর নওগাঁ-৬ আসনে ৩৬.৪৯ শতাংশ। এর আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২২ শতাংশেরও কম। কাছাকাছি সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মেয়র হন মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে। আর  দক্ষিণে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়র হন শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, উত্তর সিটিতে ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। তার মানে উত্তরে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং দক্ষিণে ভোট দেননি প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি।

ঢাকা উত্তর সিটিতে আতিকুল ইসলামকে মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন, মানে বাকি ৮৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটিতে ফজলে নূর তাপস মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, মানে বাকি ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন—এমনটি বলার সুযোগ নেই। কারণ জয়ী হওয়ার জন্য ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে বা কত শতাংশ ভোট না পড়লে সেই নির্বাচন বৈধ হবে না—এমন কোনও বিধান বাংলাদেশের নির্বাচনি আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে উল্লেখ নেই। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোট বেশি পেলেও তিনি জয়ী। পক্ষান্তরে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পড়লেও সেই নির্বাচন অবৈধ নয়। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলেও এককভাবে অর্থাৎ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার নিয়মও রয়েছে এবং এটিই এখন ‘জনপ্রিয়’ হচ্ছে। জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকার হয়ে এখন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনেও এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

ভোটের ফলাফলে অস্বাভাবিকতাও অস্বাভাবিক রকমভাবে বাড়ছে। ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যে বিএনপি, তাদের ভোট প্রাপ্তির সংখ্যা যতটা না অস্বাভাবিক, তার চেয়ে বেশি হাস্যকর বা পরিহাসের। সবশেষ নওগাঁ-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ার হোসেন (হেলাল) পেয়েছেন ১ লাখ ৫ হাজার ৫২১ ভোট। বিএনপি প্রার্থী শেখ মো. রেজাউল ইসলাম পেয়েছেন ৪ হাজার ৬০৫ ভোট। অন্যদিকে ঢাকা-৫ উপনির্বাচনে, নির্বাচন কমিশনের হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু পেয়েছেন ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ পেয়েছেন দুই হাজার ৯২৬ ভোট। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭১ জন। অথচ ৫০ হাজার মানুষও ভোট দেননি। এটি কি ভোটের ব্যাপারে নাগরিকের আগ্রহ কমে যাওয়া নাকি আস্থাহীনতা?

দ্বিতীয়ত, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এক লাখের বেশি ভোট পান, সেই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর ৫ হাজার ভোট পাওয়া কতটা স্বাভাবিক? ভোটের এই পরিসংখ্যান কি রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তা এবং ভোটের অনুপাতের প্রতিনিধিত্ব করে? নাকি নিজেদের প্রার্থী হেরে যাবেন জেনেই বিএনপি সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে যান না? একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থীর নিজস্ব যে কর্মীবাহিনী থাকে, তারা এবং তাদের পরিবার ভোট দিলেও তো সেটি ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে ভোটগুলো কোথায় যায় বা ভোটাররা কোথায় থাকেন?

ঢাকা ও নওগাঁয় ভোট কম পড়ার পেছনে করোনাভাইরাসকে দায়ী করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রশ্ন হলো, যে করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পাস করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, সেই বাস্তবতায় ভোটের মতো একটি উদ্যোগ কেন নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করলো, যেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়? নাকি তারা আগেই জানতেন যে ভোটকেন্দ্রে খুব বেশি মানুষ আসবে না?

সুতরাং, ঢাকা ও নওগাঁর উপনির্বাচনে কারা জয়ী হলেন বা বিএনপি কেন সেই নির্বাচনে অংশ নিলো, সেই আলোচনা ও তর্কের বাইরে গিয়েও গত কয়েক বছরে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো এবং এই পদ্ধতিতেই ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো হবে নাকি এখানে পরিবর্তন আসবে; সেই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি কী হবে এবং সেখানে নাগরিকদের ভূমিকা কী হবে—এসব বিষয় নিয়েও কথা বলা দরকার।

তাছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই বিএনপির প্রার্থীরা গণহারে জয়ী হবেন আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি হবে—এই তত্ত্বে যারা বিশ্বাস করেন, তাদেরও বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে এবং নিজেদেরকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে যে, মানুষ বিএনপিকে গণহারে কেন ভোট দেবে? গত দুই দশকে বিএনপি কী ধরনের রাজনীতির বার্তা জনগণকে দিতে পেরেছে? শুধু আওয়ামীবিরোধিতা দিয়ে রাজনীতি হয় বা তরুণ প্রজন্ম শুধু এই বিরোধিতার জন্য ধানের শীষে ভোট দেবে? মাঠের রাজনীতিতে সরকারের তোপের মুখে বিএনপি দাঁড়াতে পারেনি—এরকম একটি কথা অনেক সময় বলা হয়। কিন্তু আপনি যদি প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়াতেই না পারেন, টিকতে না পারেন, তাহলে মানুষ আপনাকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে কেন? আপনার নিজের মেরুদণ্ডই তো ঠিক নেই!

লেখক: সাংবাদিক

 



/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ