X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

পি কে হালদার কেন ফিরবেন?

আমীন আল রশীদ
২৬ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৪১আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৪৩

আমীন আল রশীদ ‘দেশে ফিরলেই গ্রেফতার পি কে হালদার’—এই খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ার পরে যে তিনি আর দেশে ফিরবেন না, তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং এই খবরটি হয়তো পি কে হালদারের জন্য শাপেবর হয়েছে। পত্রিকার এই খবরগুলো কানাডার সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিয়ে তার পক্ষে এ কথা প্রমাণ করা সহজ হবে যে, বাংলাদেশে গেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং সেখানে তিনি নিরাপদ নন। অতএব কানাডায় তার রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়াটা হয়তো সহজ হবে।
হাজার কোটি টাকা লুট করে দেশ ছেড়ে আলোচিত যারা, প্রশান্ত কুমার হালদার তাদের অন্যতম। সংক্ষেপে যিনি পি কে হালদার নামে পরিচিত। মানুষ দুই ধরনের ব্যক্তির নাম বেশি জানে। ১. যারা নিজ কর্মগুণে খ্যাতিমান এবং ২. যারা চুরি-চামারি-রাহাজানি বা আরও বড় অপরাধ করে কুখ্যাত। পি কে হালদার সেই দ্বিতীয় গোত্রের লোক, যার নাম এখন বোধ হয় দেশের সব মানুষ জানে।

দেশের টাকা লুট করে বিদেশে পাচারের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। অসংখ্য লোক এই কাজ করেছেন। সবার লুটের খবর গণমাধ্যমে আসেও না। যাদের খবর জানাজানি হয়েছে, পি কে হালদার সেই ‘অভাগাদের’ একজন। বরং অন্যদের সঙ্গে তার একটা মৌলিক তফাৎ এই যে, তিনি দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। শর্ত ছিল, লুটের টাকা ফেরত দেবেন। বিনিময়ে হয়রানি ছাড়া যাতে ব্যবসা করতে পারেন, সেই সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ, বিমান থেকে নামামাত্রই তাকে গ্রেফতার করতে হবে। আর যখন তিনি জানলেন যে দেশে ফেরা মাত্রই তাকে গ্রেফতার করা হবে, তখন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। যদিও তার দাবি, গ্রেফতার-আতঙ্কে নয়, বরং শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি এ মুহূর্তে দেশে ফিরছেন না।

যে লোক হাজার কোটি টাকা চুরি করে নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারেন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন ধুরন্দর, চতুর, বুদ্ধিমান এবং অবশ্যই। এরকম একজন লোক গ্রেফতার হবেন—এই কথা জানার পরে দেশে ফিরবেন, এটি ভাবার কোনও কারণ নেই।

পি কে হালদার কে—তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কারণ তাকে নিয়ে প্রচুর রিপোর্ট হয়েছে। তারপরও আলোচনার সুবিধার্থে একটু পেছনে ফেরা যাক।

রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে তিনি বেনামে কমপক্ষে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন। এরপর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লুট করেন। এর বাইরে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও বেনামে টাকা বের করেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। 

প্রসঙ্গত, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে পি কে হালদারের বিদেশে পালানোর পর দুদক তার ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খবর দিয়ে মামলা করে। তবে গত ২৮ জুন তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি আবেদন করেন, যাতে বলা হয়, আইএলএফএসএল তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। তার অনুপস্থিতি ও দেশের মধ্যে সৃষ্ট ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে’ ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ‘জটিল আকার’ ধারণ করেছে। তাই তিনি দেশে ফিরতে পারলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘সংকট কেটে যাবে’ এবং মহামারির সময়ে দেশের অর্থনীতিতে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখতে পারবে বলে তার বিশ্বাস। আবেদনে বলা হয়, তিনি ‘ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে’ দেশে ফিরতে চান এবং তার সব প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে আইএলএফএসএলসহ অন্যান্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দায়দেনা মিটিয়ে ফেলতে চান।

হাজার কোটি টাকা লুটের পরে কেউ যদি দেশে এসে নিরাপদে ব্যবসা করতে চান; দায়দেনা মিটিয়ে ফেলার উপযুক্ত পরিবেশ চান—তা তাকে দেওয়া হবে কিনা, সেটি রাষ্ট্রের এখতিয়ার। অথবা তিনি যদি স্বেচ্ছায় ফিরে নাও আসেন, তাহলে তার কাছ থেকে লুটের টাকা কীভাবে আদায় করা হবে এবং তাকে কোন প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির মুখোমুখি করা হবে—সেটিও সরকারের সিদ্ধান্ত। 

বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার কোটি টাকা লুট করা কোনও নিরীহ, গোবেচারা বা অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারও একার পক্ষেও এই কাজ করা সম্ভব নয় যদি পুরো সিস্টেম তার পক্ষে না থাকে। যদি ওই সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তাকে সহায়তা না করেন। সুতরাং শাস্তির ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পি কে হালদার যে দেশে ফিরবেন না, সেটি চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। তাছাড়া যেসব লোকের সহায়তায় তিনি হাজার কোটি টাকা লুট করতে সক্ষম হয়েছেন, সেইসব লোকের মুখোশও খুলে যেতে পারে যদি তিনি সত্যিই বিচারের মুখোমুখি হন। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হলে তিনি হয়তো সেইসব লোকের নাম বলে দেবেন এবং কারা তাকে হাজার কোটি টাকা লুট করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন, সেইসব নামও হয়তো গণমাধ্যমে চলে প্রকাশিত হবে। অতএব পি কে হালদারের দেশে ফেরা তার নিজের জন্য তো বটেই, পুরো সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত সেইসব ব্যক্তির জন্যও বিপজ্জনক, যাদের সহায়তায় তিনি কোটি কোটি টাকা লুট করার পরে নিরাপদে দেশ ছাড়তে পেরেছেন। অতএব, সেইসব লোক কোনোভাবেই চাইবেন না যে, মি. হালদার স্বেচ্ছায় দেশে ফিরুন কিংবা তাকে ধরে আনা হোক। কারণ তাতে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। আর বিচারের মুখোমুখি হলে হালদার যখন নিশ্চিত হবেন যে তাকে শাস্তি পেতেই হবে, তখন তিনি স্বভাবতই চাইবেন, তার সঙ্গে আরও অনেকে ফেঁসে যাক। অতএব পি কে হালদার যাতে কোনোভাবেই দেশে না আসেন বা তাকে যাতে দেশে ফিরিয়ে আনা না হয়, সেই চেষ্টাটি যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো থেকেও হবে—তাতে সন্দেহ নেই। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, পি কে হালদারকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন—এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে।

বহুদিন ধরে তিনি বহাল তবিয়তে থাকলেও তার নাম সামনে আসে মূলত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময়। এ সময় দুদক যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, পি কে হালদার তাদের অন্যতম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত বছরের ১৪ নভেম্বর হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এর আগে ৩ অক্টোবর তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঠিকই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সরিয়ে ফেলা হয় বেশির ভাগ অর্থ। সুতরাং এই বিশাল কর্মযজ্ঞ যে পি কে হালদার একা করেননি বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া এরকম একজন অপরাধী যে কোনোভাবেই দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন না, সে বিষয়ে আশা করি কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। প্রশ্ন হলো, সেই লোকগুলো কারা? তাদের কি বিচারের মুখোমুখি করা যাবে? 

আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এভাবে লুটপাটের ঘটনা পি কে হালদারের আগে-পরেও অনেকে করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। অর্থাৎ লুটপাট উপযোগী ব্যবস্থা চালু রেখে বিচ্ছিন্নভাবে একজন পি কে হালদারকে বিচারের ‍মুখোমুখি করেও আখেরে কোনও ফল হবে না। কারণ এইসব লুটপাটের পেছনে থাকে অনেক বড় রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক শক্তি। সেই শক্তির ছত্রছায়াতেই পি কে হালদারের মতো লুটেরাদের জন্ম ও বৃদ্ধি হয়। কালেভদ্রে দুয়েকজনের নাম প্রকাশিত হয় এবং সম্রাট ও শাহেদের মতো কিছু লোকের শাস্তিও হয় বটে, কিন্তু একটি বিশাল অংশের নামও মানুষ জানতে পারে না।   

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ