X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মীয় অনুভূতি এত ঠুনকো কেন?

আমীন আল রশীদ
০২ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০৩আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০৪

আমীন আল রশীদ এই লেখাটি যারা পড়ছেন, তারা বরিশালের সন্তান কবি হেনরী স্বপনকে চেনেন অথবা তার নাম শুনেছেন আশা করি। ‘জীবনানন্দ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনেরও সম্পাদক তিনি। নব্বই দশক থেকে বহু বছর এই কবিতার কাগজটি সাহিত্যের ক্যানভাসে রং ছড়িয়েছে। হেনরী স্বপন ব্যক্তিজীবনেও সদালাপী, সজ্জন ও নির্বিরোধ মানুষ। গত বছরের মে মাসে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতারের সংবাদটি শোনার পরে একটি প্রশ্নই শুধু মাথায় ঘুরছিল, ‘বরিশাল শহরে কবি হেনরী স্বপনকেও গ্রেফতার করা যায়?’ এই ঘটনার সঙ্গে সম্প্রতি লালমনিরহাটে শহীদুন্নবী জুয়েল নামে এক লোককে দলবদ্ধ পিটুনি দিয়ে হত্যার পরে পুড়িয়ে ফেলার বিষয়টি মিলিয়ে পাঠ করা যায়।
হেনরী স্বপনকে গ্রেফতার করা হয় গত বছরের ১৪ মে। ওই বছরের ২৩ এপ্রিল তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘রোম যখন পুড়ছিল তখন সম্রাট নিরো নাকি বাঁশি বাজাচ্ছিলো। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর গির্জায় আত্মঘাতী হামলায় শত শত মানুষ নিহতের আকস্মিকতায় যখন শোকস্তব্ধ বিশ্ববাসী, তখন বরিশাল ক্যাথলিক ডাইওসিসের বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার চার্চ চত্বরে করছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।’ফেসবুকের এই স্ট্যাটাসই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বরিশাল ক্যাথলিক চার্চের ফাদার লরেন্স লাকা ভেলি গোমেজ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন (মামলার নম্বর ৪৮)। এই মামলায় পুলিশ হেনরী স্বপনকে গ্রেফতার করে এবং আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান। তবে তিনদিনের মাথায় তিনি জামিন পান। পরবর্তীতে পুলিশ মামলায় চার্জশিট দেয় এবং মামলাটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে (মামলার নম্বর ২৬২/২০০) স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মামলায় শুধু গ্রেফতার বা তিনদিন হেলহাজতে থাকাই নয়, বরং এখন হাজিরা দেওয়ার জন্য তাকে বরিশাল থেকে ঢাকায়ও আসতে হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালে আগামী ৮ নভেম্বর মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। 

যে প্রশ্নটি বহুদিন ধরেই জনমনে রয়েছে তা হলো, কোন বক্তব্যে বা কী কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে বা ধর্মীয় অনুভূতির মানদণ্ডই বা কী? হেনরী স্বপন ফেসবুকে যা লিখেছেন, তথ্য হিসেবে সেটি যদি সঠিক হয়, তাহলে তাতে ধর্মের অবমাননা কোথায় হলো? আর যদি সেই তথ্যটি সঠিক নাও হয়, তারপরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই কথাটি লেখার কারণে কী করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় এবং পুলিশ কী করে সেই মামলা গ্রহণ করে? 

২.

ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে বাড়াবাড়ির খবর নতুন কিছু নয়। তবে সবশেষ লালমনিরহাটের পাটগ্রামে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি কোনও ধর্মপ্রাণ মানুষ তো বটেই, যিনি কোনোদিন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশপাশেও যাননি, তিনিও মেনে নিতে পারেন না। 

কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা এবং তারপরে তাকে পুড়িয়ে ফেলা কোনও ধর্মই অনুমোদন করে না। যারা এই কাজ করেছেন, তারা যে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে এই কাজ করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই ইসলাম ধর্মের নবী মোহাম্মদ (সা.) সারা জীবনই সহনশীলতা ও ভিন্নমত প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। যে মক্কা থেকে তিনি কার্যত বিতাড়িত হয়েছেন—সেই মক্কা বিজয়ের পরে তিনি শত্রুদের প্রতিও যে মানবিক আচরণ করেছেন—সেটিই প্রকৃত ইসলাম। অথচ কোরআন অবমাননা হয়েছে বলে একজন লোককে পিটিয়ে মারা হলো; মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হলো। 

যারা জুয়েলকে হত্যার পরে পুড়িয়ে দিলেন, তারা এই সমাজেরই মানুষ। নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত ধর্ম পালন করেন। মসজিদে যান। রোজা রাখেন। যে মানুষ নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, তিনি কী করে আরেকজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারেন? 

জুয়েল নামে যে লোককে মারা হয়েছে, শোনা যাচ্ছে তিনি মানসিকভাবেও পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ যদি আপত্তিকর কোনও মন্তব্য করেন বা কাজ করেন, তারপরও কি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়? কারা এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন? তাদের এত উৎসাহ কেন? ধর্মের কোন বাণীতে তারা উজ্জীবিত হয়েছেন? মানুষ মেরে ফেলায় এত আনন্দ কেন? ঘটনার সময়ে সেখানে এর প্রতিবাদ করার মতো কেউ কি ছিলেন না? 

ধর্মীয় অনুভূতি কি এতই ঠুনকো বিষয় যে কেউ কিছু একটা বললেই সেটি আঘাতপ্রাপ্ত হবে? ইসলামের মতো একটি মানবিক ধর্মের অনুসারী মানুষ কী করে এতটা হিংসাত্মক হতে পারে? যারা ইসলাম এবং কথিত জিহাদের নামে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটিয়েছেন, তারা কোন ইসলাম প্রচার করতে চান? 

৩.

লালমনিরহাটে যারা ধর্মের অবমাননার দোহাই তুলে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন, সেটি স্পষ্টতই ফৌজদারি অপরাধ এবং শুধু ইসলাম নয়, কোনও ধর্মই এই ঘটনা সমর্থন করে না। বরং একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার পরে যে পুড়িয়ে দেওয়া হলো, এটিই ধর্মের অবমাননা। কারা মানুষকে উত্তেজিত করলো, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল—এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। হাজার হাজার মানুষ একটি জায়গায় জড়ো হয়েছেন কাদের প্ররোচনায়, কোন প্রক্রিয়ায়—সেটিরও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান প্রয়োজন। সেইসঙ্গে এটিও বিবেচনায় নিতে হবে, মানুষ কেন ‘ধর্মের অবমাননা’ হয়েছে শুনলেই উত্তেজিত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং হত্যার মতো জঘন্য কাজে শামিল হয়? ধর্মীয় শিক্ষার কোথাও কি তাহলে একটা বড় ধরনের শূন্যতা বা বিভ্রান্তি রয়ে গেছে? ধর্মের উদ্দেশ্যই যেখানে মানুষকে আরও বেশি মানবিক ও সহনশীল করা, সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ শুনলেই  মানুষ কেন হিংস্র হয়ে উঠবে? 

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশের সঙ্গেও উত্তেজিত জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রশ্ন হলো, শুধু কি ধর্মীয় অনুভূতিই এসব ঘটনার অনুঘটক, নাকি এর পেছনে ব্যক্তিগত বিরোধসহ সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয়ও যুক্ত থাকে? লালমনিরহাটে আসলে কী হয়েছিল? কোনও একটি পক্ষ কি এসব ঘটনার দ্বারা কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করতে চেয়েছিল বা বড় কোনও ইস্যু তৈরি করে বা দেশকে অস্থিতিশীল করে কেউ কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল?

৪.

মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। অন্যকে আহত করে কথা বলার নাম যেমন বাকস্বাধীনতা নয়, তেমনি কেউ কিছু একটা বললেই তাতে ধর্মের অবমাননা হয়ে গেলো, এমন সরলীকরণও সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। 

কিছু লোক সচেতনভাবেই অন্যের ধর্ম বা তাদের অবতার কিংবা নবীর সমালোচনা করে, বিষোদ্গার করে আনন্দ পান। কিছু লোক ধর্মের সমালোচনা করে নিজেকে অধিকতর আধুনিক প্রমাণের চেষ্টা করেন। অথচ তিনি এটা উপলব্ধি করেন না,  তার এই স্ট্যাটাসে বা লেখায় সেই ধর্মের মানুষ আহত হতে পারেন। সুতরাং হিন্দুদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া বা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া যেমন অপরাধ, তেমনি অন্যের ধর্মের (যে ধর্মই হোক) সম্বন্ধে এমন কিছু বলা, যাতে অন্যরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন, আহত হতে পারেন, সেরকম কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন প্রকাশ করতে হবে—সেটিও ভাবা দরকার। 

বাস্তবতা হলো, ব্যক্তিজীবনে মানুষ ধর্মের অনুশাসনগুলো ঠিকমতো পালন না করলেও নিজ ধর্মের কোনও বিষয়ে ভিন্ন মত শুনলেই তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। নিজে অন্যায় করে, ঘুষ খায়, মানুষ ঠকায়, মিথ্যা বলে—অথচ কেউ যখন কোনও ধর্মীয় নেতা বা ধর্মের কোনও বিষয় নিয়ে সমালোচনা করে, তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। অনুভূতিতে আঘাতের মামলা করে। মুরতাদ ঘোষণা করে ফাঁসির দাবি জানায়। অথচ ব্যক্তি জীবনে সে নিজেই ধর্মকর্মের ধারেকাছে নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয় সেখানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু ছিল না। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে তাতে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করেন। অজুহাত হিসেবে বলা হয়, এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান, তাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই বিধান করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রধর্ম করার আগে এ দেশের মানুষ কি কম মুসলমান ছিলেন বা সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার পরে এ দেশের মানুষ কি অধিকতর ঈমানদার হয়েছে? স্বয়ং মহানবীও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেননি। অথচ আমাদের শাসকেরা নিজেদের মহানবীর চেয়ে বড় মুসলমান মনে করেন। 

দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, উপাসনালয় ভাঙচুরের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ থাকলেও কী কী কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা যেতে পারে তা বলা নেই। ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। ধর্মীয় অনুভূতির কোনও সংজ্ঞা এখনও দেশের প্রচলিত আইনে অস্পষ্ট। এমনকি অধুনালুপ্ত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং হালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায়ও বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

আর এই অপরাধের শাস্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ড। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা এই আইনে নেই। যে কারণে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগকেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে এবং মামলাও করা যাচ্ছে। সুতরাং, রাষ্ট্রের নাগরিকরা কোন কথা বললে বা ঠিক কোন কাজগুলো করলে সেটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে বিবেচিত হবে, সেটি আইনের দ্বারা সুস্পষ্ট করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ভিন্ন মত পোষণের দায়ে কাউকে যাতে প্রাণ দিতে না হয়, সেরকম আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। 

লেখক: সাংবাদিক



/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ