X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের অবসান হোক

আনিস আলমগীর
০৩ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩১আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩৩

আনিস আলমগীর ঢাকায় লালবাগের নির্বাচনি এলাকার ভোটার ছিলাম আমি দীর্ঘদিন। সেখানে আওয়ামী লীগের হাজী সেলিম এবং বিএনপির নাছির উদ্দীন পিন্টুর জন্য আওয়ামী লীগের ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, বিএনপির ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ও মীর শওকতকে সংসদীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে হয়। পিন্টুর অকাল মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু হাজী সেলিম তার অবস্থান লালবাগে সুদৃঢ় করে ফেলায় আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত লালবাগ স্থায়ীভাবে হাজী সেলিমকে ছেড়ে দেয়। দলীয় আশীর্বাদ মাথার ওপর থেকে সরে না যাওয়ার কারণে ২০১৪ সালে দলীয় নমিনেশন না পেয়েও তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান, তখন ঐক্যজোটের হয়ে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন মোস্তফা মহসিন মন্টু।
হাজী সেলিম বলুন আর পিন্টু বলুন কেউই সুনাম সুখ্যাতি নিয়ে এলাকায় গড়ে ওঠেনি। এমপি হিসেবেও তারা সুনাম অর্জন করতে পারেননি। মীর শওকতের হাত ধরে বিএনপিতে আসা হাজী সেলিমের দাপট বিএনপিতে পিন্টুর চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপির নির্বাচনি টিকিট চেয়ে ব্যর্থ হয়ে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করবেন আশা ছিল তার, কিন্তু আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে যান হাজী সেলিম। আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেন হাজী সেলিম এবং ধানের শীষে মনোনয়ন পান ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। হাজী সেলিম আগে থেকে পৌর কমিশনার হিসেবে নির্বাচন করে আসছিলেন এবং তখন থেকে তার ক্যাডার বাহিনী ছিল।

কৃষক মাস্তানদের সুসংগঠিত করে মারাঠার শিবাজীদের উত্থান যেভাবে হয়েছে, লালবাগে হাজী সেলিম-পিন্টুদের উত্থানও ঠিক সেভাবে হয়েছে। আসলে তারা ছিল রাখাল সর্দার। সে সময়ের মুঘল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিবাজী ক্ষুদ্র মারাঠা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন আর আধুনিক জামানায় হাজী সেলিমরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। আর নিজের অর্থবিত্ত গড়ে তোলার পথ সুগম করে বিত্তশালী হয়েছেন।  

পত্রিকায় দেখলাম ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর বিরোধপূর্ণ ও সরকারি জায়গাজমি বা নদীতীর দখল করেই ক্ষান্ত হননি হাজী সেলিম, যেখানেই চোখ পড়েছে সেটাই দখল করে নিয়েছেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন নিদর্শনও। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে গত বছরও ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে পরিচিত চকবাজারের শতবর্ষেরও বেশি পুরনো জাহাজবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম।

এভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদ বাড়িয়ে তুলেছেন। পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অসংখ্য বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া পায়রা বন্দরসংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ভূসম্পত্তি কিনেছেন তিনি। হাজী সেলিমের পরিবারের এসব অবৈধ সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হাজী সেলিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে মার্কেট তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কাগজপত্র নেই বলে হাজী সেলিম কিনে নিয়েছেন—এই দাবিকে মেনে নিতে হচ্ছে। আমাদের সরকার তা দেখেও অন্যায় প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

বাবার পানের ব্যবসা, নিজের কোল্ড ড্রিংকসের এজেন্সি—এসব দিয়ে শুরু করে খালেদা জিয়ার সরকার আর শেখ হাসিনার সরকার—এই দুই সরকারের সময় রকেট গতিতে হাজী সেলিমদের উত্থান হয়েছে। এদের উত্থানের পেছনে বহু মানুষ মজলুম হয়েছে। এসব করতে গিয়ে তাদের নিজের জীবনেরও কোনও নিরাপত্তা ছিল না। আমরা দেখেছি হাজী সেলিমকে আনসার পরিবেষ্টিত হয়ে নিজের গাড়িতে চলাফেরা করতে। পদে পদে বডিগার্ড। ছেলেরও বডিগার্ড নিয়ে চলতে হয়। নিজের জীবনের নিরাপত্তাও তারা বিঘ্নিত করে তুলেছে।

নাছির উদ্দীন পিন্টু ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এই অভিযোগে জেল খাটতে খাটতেই মারা গেছেন। হাজী সেলিম, পিন্টুদের মতো ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রশ্রয় দিয়েছে আর তারা অর্থবিত্তের জন্য অনেক লোককে সর্বহারা করেছেন। রাজনীতিতে হাজী সেলিম, নাছির উদ্দীন পিন্টুদের উত্থানের পেছনে দেশের দুই বড় দলের সহযোগিতা ছিল। বিএনপি ঘরানার মানুষ নাছির উদ্দীন পিন্টুর মৃত্যু হয়েছে। আওয়ামী ঘরনার মানুষ হাজী সেলিমকে কোনও ঝামেলা পোহাতে হয়নি। তিনি নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে থেকে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। সরকারি সম্পত্তি যেখানে পেয়েছেন নিজের দখলে এনেছেন, মেঘনা ঘাটে ১৮ বিঘা সরকারি জমি দখল করে টাইগার সিমেন্টের ফ্যাক্টরি গড়েছেন।

সরকারি দলের কারা কারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অন্যের সম্পত্তি দখল করছেন, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করছেন সরকার ভালো করেই জানে। এদের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি না। শুধু দেখি কোনও একজন বেকাদায় পড়লেই সরকার তাকে নিয়ে সতর্ক হচ্ছে, দুদক সম্পত্তির খোঁজ করছে। এর আগে কোনও তৎপরতা নেই। অথচ জনগণ যেমন জানে সরকার জানে কারা রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন করছে।

হাজী সেলিম বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন উত্তরাধিকারী হিসেবে তার ছেলে শিক্ষানবিস কাল অতিবাহিত করছে। কয়েকদিন আগে তার ছেলে ইরফান সেলিম রাস্তায় তার গাড়ির সঙ্গে ধাক্কার জেরে মোটরসাইকেল আরোহী সামরিক বাহিনীর এক নবীন অফিসারকে মেরে দাঁত ফেলে দিয়েছেন। ইরফান সেলিম দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরও। তার বাবা হাজী সেলিম আওয়ামী লীগের নেতা আর সংসদ সদস্য, তার শ্বশুরও নোয়াখালী আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি আর সংসদ সদস্য শাশুড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান। তার রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত। ইতোমধ্যে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন। তার সহযোগী যারা ছিল তারাও রিমান্ড আর জেলখানায় ঘোরাফেরা করছে। ইরফানকে যে সাজা দেওয়া হয়েছে সেটা উচ্চ আদালতে থাকবে কিনা এটাও সন্দেহ করে মানুষ।

আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে অনুরোধ করবো তারা যেন দলে হাজী সেলিমদের অবস্থানের কথা বিস্মৃত হয়ে সুষ্ঠু ও শক্ত বিচারের ব্যবস্থা করে। ক্ষুদ্র ঘটনাও বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিতে পারে। অতীতে সেরূপ নজির রয়েছে আর যেসব আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি সরকারি জমি দখল করে রেখেছে তা যেন দ্রুত উদ্ধার করা হয়। আওয়ামী লীগে হাজী সেলিম আর সম্রাটের কদর নাকি জনসভায় লোক সমাবেশ ঘটানোর জন্য। আওয়ামী লীগের মতো দলকে এখনও যদি লোক সমাবেশের জন্য হাজী সেলিম ও সম্রাটদের মতো নেতাদের লালন-পালন করতে হয়, তাহলে তো বড় সমাবেশ না করাই উত্তম।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ