X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দস্তয়ভস্কি, আপনাকে

বিপাশা বিনতে হক
০৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:১৭আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:১৯

দস্তয়ভস্কি, আপনাকে ক্লেশ-তকলিফ-বহন-সহন—আপনার রচিত চরিত্রেরা দর্শনগতভাবে 'ভোগান্তি'কে (এই শব্দটা বাকিগুলোর সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করছি) যেভাবে ধারন করেছে; বলা হয় যে সাহিত্যে তেমনটার তুলনা পাওয়া দায়। কেমন একটা অস্থির জটিলতার ধাঁধা পৌনঃপুনিকভাবে আপনার চরিত্রেরা লালন করে; এরা একদিকে ইউটোপিয়ান সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ আর অন্যদিকে অর্থডক্স খ্রিস্টীয় ধর্মবাদের টানাপোড়েনে নিষিক্ত। অনেকটা কি আপনার মতোই?

আপনি ঘুরে ফিরে একই ধরণের ক্লেশের গল্প বলেছেন—কখনো তা ঐতিহাসিক সনদ নিঃসৃত, আবার দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া তকলিফের নারকীয় কেচ্ছা অবলীলায় ঠাঁই পেয়েছে আপনার লেখাজোখার বুনোটে। এই যেমন ধরুন, ‘দ্য ইডিয়ট’-এ একজন লোকের দুইজন নারীকে হত্যা করার বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এ-ও সেই একই কথা; একটা অধ্যায়ে একটি বুড়ো ঘোড়াকে অমানুষিক নির্যাতনের সাবলীল বিবরণ দিয়ে গেছেন। আপনার গল্পের স্বর বহুমাত্রিক, তারা একসঙ্গে নাটকের পর নাটক সাজিয়ে যায়; আর সবগুলো কাহিনিকে যে সুতোয় বেঁধে যে মালাটি আপনি রচনা করেন, তার চাপা অন্তঃপ্রবাহী স্রোতটি ‘ভোগান্তি' ছাড়া আর কিছুই নয়। 

      নিজের সমস্ত সৃষ্টিজুড়ে হয়তো আপনি ভোগান্তিময় ‘দ্বৈতসত্তায়’ দোদুল্যমান ছিলেন; যার একদিকে ছিল সনাতন খ্রিস্টীয় অনুভূতি আর অন্যদিকে কল্পলোকের (ইউটোপিয়ান) সমাজতন্ত্র। দুটো মতবাদই কিন্তু ভীষণ সূক্ষ্মভাবে ভোগান্তির পক্ষে সাফাই গেয়েছে; নিজের মতো করে এর ইলাজের ব্যবস্থাও বাতলে দিয়েছে। হতে পারে, ব্যক্তিজীবনে আপনিও হয়তো এ দুটোর মাঝে সমঝোতায় আসতে চেয়েছেন। এ দুটোর টানাপোড়েনে বারবার বসেছেন জুয়ার টেবিলে, পালিয়ে বেড়িয়েছেন নিজ দেশ থেকে—আপনার চেয়ে বেশি দেনায় জর্জরিত যাযাবর পাওয়া দায়!

      প্রথম জীবনে আপনি নিহিলিস্ট ছিলেন, মাঝবয়সে ঈশ্বরে মন বসতে শুরু করে; আর শেষ বয়সে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তুমুল দ্বন্দ্বে নাচার হয়ে পড়েন। জানা যায়, আপনি সারাজীবন সবচেয়ে বেশি ভেবেছেন ঈশ্বর বলে কেউ আছেন কি নেই—আপনার প্রতিভা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, অধ্যায়ন—কোনোকিছুতেই আপনি এর উত্তর পাননি। জীবনের শেষভাগে এসে স্বীকার করেছেন, আপনার চরিত্র কারমাজভের মতো, আপনিও বুঝি জানেন না ঈশ্বর আছেন কি নেই। ধরুন আপনার ‘ব্রাদার কারমাজভ’; এই মহাকাব্যিক উপন্যাসের কথা, ১৮৭৮ সালে আপনি এটি লিখতে শুরু করেন, শেষ করেন আপনার মৃত্যুর ঠিক তিন মাস আগে। এ লেখা শুরুর আগের দশ বছর আপনি আস্তিকতা-নাস্তিকতা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আনার লেখায় আমরা জানতে পারি, আপনার নাকি আস্ত একখানা গ্রন্থাগার ছিল ‘ঈশ্বর’ বিষয়ে!       

      চলুন, জুয়ার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আপনার কথা দিয়ে শুরু করি, ‘কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব যে তুমি বেঁচে থাকবে, আর তোমার কোনো গল্প থাকবে না?’ আসলেই তাই; প্রতিটি লেখা শুরুর আগে আপনি জুয়া খেলতেন এবং হেরে যাওয়ার পর যে বেদনাবোধ জাগত—সেই কাঁচা ক্ষত থেকেই লিখতেন। তাহলে কি আপনি খারাপ মানুষ ছিলেন? বেশ বিভ্রান্তিকর একটি প্রশ্ন—কীভাবে আপনি খারাপ ছেলে হন যখন আপনার বাবার অত্যাচারে তার প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে থাকে; কোচওয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করে কয়েকজন তাকে হত্যা করে। বাবার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু আপনার মধ্যে একধরণের অপরাধবোধের জন্ম দেয়, যেন আপনি নিজেই অপরাধী! ধীরে ধীরে এক অসুস্থ মনঃবিকার জেঁকে ধরলো আপনাকে। শোক-আঘাত-উত্তেজনার সংস্পর্শে এলেই আপনি আর নিতে পারতেন না, ঘন ঘন দেখা দিত মৃগীরোগ। এঞ্জিনিয়ারিং একাডেমি থেকে পাশ করে সামরিক বিভাগে ডিজাইনারের চাকরি নিলেন। আপনার গল্পটা যেন এমন—নিঃসঙ্গতার ক্লান্তি ভুলতে আপনার পা আপনা-আপনি চলে যায় জুয়ার টেবিলে—যা হবার তাই হয়, শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে রিক্ত পা টেনে ফিরে আসেন ঘরে।

      আপনাকে নিপাট ভালো মানুষ বলতে ইচ্ছে করে! অথচ মহান শিল্পীদের উদ্ভট জীবন আমাদের টানে—তাদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার কথা জেনে আমরা যেন থৈ পাই না। আমাদের বিভ্রান্তি বেড়ে যায়, ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিজীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তার শিল্পের ব্যাপারে আদৌ কি কিছু বিবেচনা করার আছে? এই যেমন ধরুন বোদলেয়ারের কথা, যিনি বলেছিলেন তার হৃদয় নেই। বালজাক এ বেশ্যালয় থেকে সে বেশ্যালয়ে ঘুরে বেড়াতেন। লেনিনের কথায় আসি; ‘এপ্রিল থিসিস’ লেখা শেষে তার ঘরে একুশ লিটার ভদকার খালি বোতল খুঁজে পাওয়া গেলো! শোনা যায় র‍্যাবো নাকি ড্রাগস না নিয়ে লিখতেই পারতেন না! কিন্তু তাদের সৃষ্টিগুলো পড়ার সময় এসব পাগলামি কি আদতে প্রভাব ফেলে পাঠকের মনে? বোধ হয় না।

      আসলেই আপনি ঔপন্যাসিকদের ঔপন্যাসিক। গুরুদের গুরু। আপনার গল্পেরা বিষাদে মোড়া, সর্বগ্রাসী বিষন্নতায় মন ছেয়ে দেয়; আর একই সঙ্গে পাঠকের মানসিক উৎকর্ষ সাধন করে। যেন আপনি মেনে নিয়েছেন যে ভোগান্তি জীবনযাপনের একটি প্রধান শর্ত। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে জীবনের পথচলা ফুরোবার নয়; আর ভোগান্তি (এর আগাপাশতলা নিয়ে) যেহেতু একটি ধাঁধা—জীবনযাপনের একটা বড় দায়বদ্ধতা হলো এই ধাঁধাঁ মেলানোর চেষ্টা করে যাওয়া। আর, উত্তর না মিললেই বা কী? উত্তরটা জরুরি না, জরুরি বুঝি উত্তরের খোঁজ।

      আপনারচরিত্রদেরদিয়েভোগান্তিথেকেনিরাময়েরব্যবস্থাপত্রধরিয়েদিয়েছেন—এর উপশম হতে পারে মানুষের জন্য মানুষে অবিরাম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা; আর নিজেকে অকম্পিতভাবে সার্বজনীন, স্বার্থহীন, আমিত্বহীন, নিখুঁতভাবে নৈতিক চরিত্রে গড়েপিটে নেওয়া। আবার, এভাবে নিজেকে রূপান্তরের চেষ্টার শুরুতে এও ধরে নিতে হবে, নিখুঁত রূপান্তর, (যা খানিকটা ঐশ্বরিক) তা এই মর্ত্যের ধুলোকাদায় নাও হতে পারে। বস্তুত, এগুলো জেনে-মেনে দুনিয়াবী ভোগান্তির পর (ইহজীবনে বা পরলোকে) উত্তম প্রতিদানের আশা-নিরাশার দোলাচালে থাকাই হয়তো মানবীয় চরিত্রের মহত্তম প্রকাশ।

      হ্যাঁ, জীবনের শেষ প্রান্তে আপনি বলেছেন, দ্বিধাদ্বন্দ্বের অগ্নিকুণ্ডে অঙ্গার হয়ে আপনি বিশ্বাসে পৌঁছেছেন। জানি, এই বিশ্বাস কোনো সনাতনী ধর্মীয় বিশ্বাস না, আবার সুনির্দিষ্ট আদর্শিক কোনো বিশ্বাস না; এ আপনার মনের একান্তে পুঞ্জীভূত বিশ্বাস; ভোগান্তির নির্মম রসে জারিত হয়ে যা আপনাকে দিয়ে আনমোল যত সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছে।

      আপনার ‘ভোগান্তি’র সঙ্গে অযাচিতে তুলনা চলে আসে বাংলাদেশের কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে, জীবনজুড়েযিনিনিজেওছিলেনদুর্দশারকরুণরসেসিক্ত। আর কথা না বাড়িয়ে তার ‘আটবছর আগের একদিন’ কবিতাটি আপনাকে শোনাতে ইচ্ছে হলো:

শোনো

তবু এ মৃতের গল্প; কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,

সময়ের ঊর্ধ্বতনে উঠে এসে বধূ

মধু—আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে;

হাড়-হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে

এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।'

জন্মদিনের প্রাক্কালে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি? ভোগান্তির অন্তর্নিহিত সত্যটা কী? ভোগান্তি নিজেই?

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!