X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পকে পরাজয়ের নেতৃত্বে মার্কিন মিডিয়া

আনিস আলমগীর
১০ নভেম্বর ২০২০, ১৫:১২আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২০, ১৬:২৫

আনিস আলমগীর মার্কিন মুল্লুকের কয়েকটি টিভি শো আমার প্রিয়। তার মধ্যে জিমি কিমেলের ‘জিমি কিমেল লাইভ’, জিমি ফ্যালনের ‘দ্য টুনাইট শো’, স্টিফেন কোলবার্টের ‘দ্য লেট শো উইথ স্টিফেন কোলবার্ট’ এবং ট্রেভর নোয়াহর কমেডি নির্ভর ‘দ্য ডেইলি শো’ অন্যতম। এই চার হোস্টের মধ্যে জিমি কিমেল ছাড়া বাকি তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুকরণ করতে পারেন চমৎকারভাবে। জিমি ফ্যালন শুধু অনুকরণ নয়, ট্রাম্প সেজে নানা কাণ্ড করে বেড়ান। এমনকি ট্রাম্পকে তার শোতে এনে তার বহুল আলোচিত চুল এলোমেলো করে দিয়েছিলেন এই জিমি ফ্যালন।
প্রশ্ন আসতে পারে হঠাৎ লেট নাইট শোর আলোচনা কেন? প্রসঙ্গটা আনলাম মার্কিন নির্বাচন এবং মার্কিন টিভিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে উত্থাপন নিয়ে। এক ফক্স নিউজ ছাড়া ট্রাম্পকে পাত্তা দিয়েছে এমন একটি মিডিয়া আমার চোখে পড়েনি গত চার বছর, হয়তো থাকতে পারে। শেষ বেলায় সেই ফক্সও ‘পাল্টি’ দিয়েছে রেজাল্ট মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অসহিষ্ণু আচরণের কারণে। তারাও বিজয়ী ঘোষণা করেছে ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনকে। আমরা আমেরিকার নানা সমালোচনা করি, কিন্তু নিজের দেশের প্রেসিডেন্টকে ব্যঙ্গ করে কোনও দেশের টিভিগুলো দিনের পর দিন অনুষ্ঠান করেছে, আমার চোখে বিশ্বে আর কোনও দৃষ্টান্ত নেই। কেউ যদি ভেবে থাকেন যে নতুন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে তারা কোনও ব্যঙ্গ করবে না, তা ভুল। ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলাকে তার বাইরে রাখেনি। তবে ট্রাম্প যে রকম এন্টারটেইনার ছিল তাদের শোর জনপ্রিয়তার জন্য, সেটা তারা মিস করবেন নিশ্চিত।
মার্কিন মিডিয়া যেই ট্রাম্পের এতো সমালোচনা করেছে, সেই ট্রাম্পও সমালোচনার কারণে কোনও মিডিয়ার ওপর মারাত্মক প্রতিশোধ নিয়েছেন, সাংবাদিককে ভুয়া মামলা বা সাংবাদিকতার বাইরে ব্যক্তিগত কোনও দোষ পেয়ে দ্রুততার সঙ্গে জেলে ঢুকিয়েছেন সে নজির নেই। যে সিএনএনকে ট্রাম্প সারাক্ষণ ফেইক নিউজ হিসেবে চিহ্নিত করতেন, সেই সিএনএনকেও তার অনুষ্ঠান কভার করা থেকে বঞ্চিত করেননি ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে সিএনএনকে নিষিদ্ধ করেননি। হয়তো আমেরিকা বলে ট্রাম্প সেটা পারেননি, বরং শেষ বেলায় এসে ট্রাম্পকে ‘নিষিদ্ধ’ করেছে মিডিয়া। মিথ্যা বলায় এমএসএনবিসি হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্পের বক্তৃতা লাইভ চলাকালে অনুষ্ঠান প্রচার করে বন্ধ করে দেয়। এনবিসি এবং এবিসি নিউজও তাদের লাইভ কভারেজটিতে প্লাগ খুলে নেয় ট্রাম্প মিথ্যা কথা বলছে বলে। মিডিয়া একদিনও তার পিছু ছাড়েনি।
বিরুদ্ধ শিবিরের সংবাদ মাধ্যমেকে ফেইক নিউজ বলে যে লোক ব্যঙ্গ করতেন সেই ট্রাম্প দেখা যাচ্ছে ১০টির মধ্যে চারটি মিথ্যা তথ্য সম্বলিত টুইট করতেন। ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুসারে ২০ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ২৭ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ১৩১৬ দিনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর কথা বলেছেন ২২ হাজার ২৪৭টি। প্রতি দুই মাস অন্তর সেটা আপডেট হতো। টুইটার ট্রাম্পের টুইটকে মিথ্যা বলে সরিয়ে দিয়েছে, হাইড করে দিয়েছে বা নীল রঙ চিহ্ন দিয়ে পাঠকদের বলেছে সন্দেহজনক তথ্য। ট্রাম্পের অনেক টুইটের শেয়ার এবং লাইক বাটন বন্ধ করে রেখেছিল। টুইট পাগল একটা লোককে টুইট করা থেকে বিরত রাখার যন্ত্রণা কী, সেটা ট্রাম্প থেকে কারও বেশি জানার কথা না। ট্রাম্প টুইটারকে বন্ধ করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। দেখেছেন হয়তো, টুইটার এবং ফেসবুকে কেউ মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে স্ট্যাটাস দিলে ফেসবুক এবং টুইটার তার নিচ দিয়ে তাদের পাওয়া খবরের লিংক জুড়ে দিয়েছিল যাতে পাঠকরা ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত না হয় এবং সঠিক খবর থেকে বঞ্চিত না হয়। তারা এই বিষয়ে মূলধারার সংবাদকে ফলো করতে উৎসাহ দিয়েছে।
কেন তারা এবার এটা করলো? কারণ গতবার হিলারি যখন মিডিয়ার মূলস্রোতের প্রচারণায় নিশ্চিত বিজয় ধরে রেখেছিলেন, ট্রাম্প সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় চালিয়েছেন পরিকল্পিত অপপ্রচার। শত শত ভুয়া অনলাইন পোর্টাল ট্রাম্পের পক্ষে নিউজ বানিয়েছে, ট্রাম্প সমর্থকরা তা ছড়িয়েছেন। গুগুল, ফেসবুক, টুইটার প্রস্তুত ছিল না এ ধরনের ভুয়া সংবাদ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। কিন্তু পূর্বের ব্যর্থতাকে মাথায় রেখে তারা সতর্ক ছিল এবারের নির্বাচনে।
মিথ্যা খবর ছড়াতে ট্রাম্প ক্যাম্প এতই বেপরোয়া যে টুইটার এবং ফেসবুকের মাধ্যমে নির্বাচনের ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে বাধা সৃষ্টির কারণে মার্কিন নির্বাচনের পরে রক্ষণশীলরা টুইটারের বিকল্প ‘পার্লার’ নামের তথাকথিত একটি ‘ফ্রি স্পিচ’ অ্যাপে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এখন। সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক ডাউনলোড করা অ্যাপ হয়ে উঠেছে পার্লার। পার্লারের প্রতিষ্ঠাতা জন ম্যাটজি জানিয়েছেন, অ্যাপ্লিকেশনটি এক দিনে দুই মিলিয়ন নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত করছে এবং সপ্তাহের শেষের দিকে তার দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারী চারগুণ বৃদ্ধি করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দুটি টকশোতে আর নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনি রাতে দুটি টকশোতে এই নির্বাচনে কে জিতবে, এমন দুরূহ প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে আমাকে। টিভি পর্দায় নির্বাচনে কে জিতবে জোর দিয়ে বলা সত্যি কঠিন ছিল, কারণ টিভি মিডিয়াকে এখন আর ইরেজ মিডিয়া বলার সুযোগ নেই যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সেসব বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার চান্স রয়ে গেছে এবং সত্য না হলে ক্রেডিবিলিটির সংকট তৈরি করতে পারে একজন সাংবাদিকের জন্য। কিন্তু আমি সরাসরি ডেমোক্র‌্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের নাম নিতে দ্বিধা করিনি, কারণ আমি আস্থা রেখেছিলাম নিজের ওপর আর মার্কিন মিডিয়ার ওপর। আমার আস্থা তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিল এই মার্কিন টিভিগুলো। নির্বাচনি খবরে আমি বেশি ফলো করেছি এবিসি নিউজকে। নির্বাচনের আগে একটি টিভি শোতে আমি এটাও বলেছি, যদি ট্রাম্প জিতে ধরে নিতে হবে বিশ্বে এখন মিডিয়া বলতে কিছু নেই। মিডিয়ার কোনও শক্তি নেই, যাকে আমরা বলছি ফোর্থ স্টেট, বলছি মিডিয়া হিরোকে জিরো আর জিরোকে হিরো বানাতে পারে।
শেষ পর্যন্ত মিডিয়ার শক্তি বৃথা প্রমাণিত হয়নি। ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে মিডিয়াকে তুলোধুনো করেছেন, কারণ এই মিডিয়ার জরিপ পূর্বাভাস দিয়েছিল তিনি জিতবেন না, জিতবেন হিলারি ক্লিনটন। হিলারির সময় জরিপ কেন কাজে দেয়নি, সেটা অন্য সময় বলবো। হিসাব করলে মিডিয়ার জরিপ কিন্তু এবারও ঠিকমতো হয়নি। যে ভোট ব্যবধান হওয়ার কথা মিডিয়ার জরিপে এসেছে, বাস্তবে ব্যবধান মোটেও বেশি নয় বরং খুবই ক্লোজ কনটেস্ট। মার্কিন সমাজ এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জীবনে দেখেনি। তার মানে মিডিয়ার হিসাবের বাইরে রয়ে গিয়েছিল রিপাবলিকান দলের বড় একটা নীরব ভোটার দল।
খেয়াল করে দেখুন ২০১৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে একের পর এক মিথ্যা বলে মিডিয়ার চোখে ভিলেনে পরিণত হয়েছিলেন ট্রাম্প। তার দৈনন্দিন কাজকর্ম, অমর্যাদাকর কথাবার্তা, অর্থলিপ্সা, যৌন কেলেংকারি, ভাঁড়ামোকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে সবার চোখে একটা ‘ক্লাউন’ বানিয়ে দিয়েছে মিডিয়া। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার ছেলেমেয়ে এবং মেয়ের জামাইয়ের অপকর্ম। ট্রাম্পের পরাজয়ের মিশন একদিনে হয়নি। বিগত চার বছর ধরে আস্তে আস্তে মিডিয়া সবার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ট্রাম্প একটা ‘স্টুপিড’, মিথ্যাবাদী, চূড়ান্ত বিচারে একটা ‘ক্লাউন’, যার কারণে সারা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মর্যাদা হারিয়েছে, আমেরিকানদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে যেকোনও মূল্যে উত্তরণ দরকার। রাষ্ট্রকে তার হাত থেকে উদ্ধার করা দরকার।
সেই কারণে জো বাইডেন তাই তার নির্বাচনি শ্লোগান করেছেন—‘উই মাস্ট রিস্টোর দ্য সোল অব আমেরিকা।’ মানে ট্রাম্প শাসনে আত্মাহারা দেশ ছিল আমেরিকা, তার আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে সবাইকে সচেষ্ট হবার আহ্বান ছিল তার শ্লোগানে। এক উগ্র শ্বেতাঙ্গরা ছাড়া বাকি সাদা-কালো-বাদামি সবাই মিলে পরাজিত করেছে অশুভ শক্তি ট্রাম্পকে। আর এর নেতৃত্ব দিয়েছে বাইডেন নয়, আমেরিকার শক্তিশালী মিডিয়া।
নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্ত হলেও আইনি ঝামেলা এখনও শেষ হয়নি। ট্রাম্প পরাজয় মেনে নিয়ে, বিজয়ীকে অভিনন্দন জানিয়ে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেননি। এখন অতীতের পরাজিত প্রেসিডেন্টদের অভিনন্দন বক্তৃতার ক্লিপের পর ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার দাবি এবং পরাজয় মেনে না নেওয়ার ক্লিপ জুড়ে প্রচার করছে মিডিয়া। নির্বাচনের পরও জাতিকে মিডিয়া দেখাচ্ছে ট্রাম্প হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী এবং শ্রেষ্ঠ জোকার। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন মিডিয়ার এই যুদ্ধ আরও কিছুদিন চলবে হয়তো।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ থেকে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী
আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ থেকে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী
আমার কোনও অনুশোচনা নেই: গার্দিওলা
আমার কোনও অনুশোচনা নেই: গার্দিওলা
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ