X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

যাদের ইশারায় আলুর কেজি ১৬০ টাকা

শফিকুল ইসলাম
১৭ নভেম্বর ২০২০, ১৫:০০আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২০, ১৬:১৫

আলুর আড়ত (ফাইল ছবি) নিজের ও বর্গা মিলিয়ে মোট সাত একর জমিতে আলু চাষ করেছেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন। ফলন ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মাঠ থেকে পরিপক্ব আলু তুলতে আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন। কিন্তু সেই সময় দিতে রাজি নন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিনই এসব ব্যবসায়ী এসে মাঠের আলু এখনই তুলে ফেলতে তাগাদা দেন তোফাজ্জল হোসেনকে। ভালো দাম দেওয়ারও টোপ দেন তারা। তাদের প্রলোভনে পড়ে অনেকটাই অপরিপক্ব আলু মাঠ থেকে তুলে ওইসব ব্যবসায়ীর কাছে প্রতিকেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তোফাজ্জল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সেই নতুন আলু ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে। এসব মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী আলুসহ বিভিন্ন প্রকার নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অস্থির করছেন বাজার। মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা বিক্রি করছেন অপরিপক্ব আলু। আর এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই সেই আলু রাজধানীতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। যা খুচরা ব্যবসায়ীরা ১৩০ টাকা কেজি দরে কিনে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে।

এ বছর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সর্বশেষ সংযোজন পণ্য হচ্ছে আলু। এ বছর আলুর দাম বৃদ্ধির কোনও কারণ খুঁজে পায়নি কেউই। তারপরও দেশের মানুষ অসহায় এই সিন্ডিকেটের কাছে।

কারা এই মধ্যস্বত্বভোগী?

রাজধানীর কাওরানবাজারের আব্দুল লতিফ। প্রায় সারাদিনই কিচেন মার্কেট এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন তিনি। রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত আব্দুল লতিফ ‘নেতা লতিফ’ নামেই পরিচিত। বিভিন্ন দোকানে-আড়তে গল্পগুজব করেই অলস সময় পার করেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনিও একজন মধ্যস্বত্বভোগী। এই মৌসুমে আলু কেনার জন্য মুন্সীগঞ্জে ও বগুড়ায় তার লোকজন রয়েছে।

পেঁয়াজের সময় তার লোকজন চলে যায় ফরিদপুর ও পাবনায়। তারাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে খোঁজখবর দেন। তারাই ওইসব পণ্য মাঠ থেকে কিনে রাজধানীতে পাঠান। বিনিময়ে কিছু কমিশন দেন তাদের। যা তিনি এখানে বসেই পাইকারদের কাছে নিজের মতো নির্ধারিত দামে বিক্রি করেন।

এ বছর আলু ও পেঁয়াজের ব্যবসা করে ভালো মুনাফা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। শুধু আব্দুল লতিফই নন, কাওরানবাজারে এমন ছয় থেকে সাত জন মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন যারা নির্ধারণ করে দেন, তাদের আনা পণ্য আলু বা পেঁয়াজ কত দরে বিক্রি হবে। তারা যে দামে পণ্য আড়তে দেন, সে হারেই বাড়তে বাড়তে অত্যাচারের পর্যায়ে চলে যায় দাম। এভাবেই কৃষকের কাছ থেকে ৬০ টাকার নতুন আলু ১৬০ টাকায় কিনছেন ভোক্তারা।

জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ বলেন, ‘অনেক টাকা খাটাই। লোকজন কাজ করে। কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের লাগানো ফসল আগেভাগে তোলার জন্য পীড়াপীড়ি করি। কৃষকদেরও ভালো দাম দেই। এখন পুরান আলুর কেজি ৫০ টাকা। সেই হিসেবে নতুন আলু ১৬০ টাকা হলে মন্দ কিসে? কৃষকও লাভবান হলো, তাদের কল্যাণে আমরাও কিছুটা মুনাফা পেলাম। আর ক্রেতারা স্বাদ নিলো নতুন আলুর।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঠেঘাটে যাওয়া লাগে না। খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য এই যন্ত্রটাই (হাতে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে) যথেষ্ট। আমার লোকজন পণ্যের ছবি তুলে পাঠায়। দেখে পছন্দ হলে সরাসরি কৃষকের সঙ্গে কথা বলে দাম ঠিক করি। তার পরে ট্রাকে মালামাল চলে আসে কাওরানবাজারে। সময়মতো নির্ধারিত আড়তে ট্রাক থেকে মাল খালাস হয়। টাকা পেয়ে যাই বাংকের মাধ্যমে। সমস্যা কী?’

যাদের ইশারায় আলুর কেজি ১৬০ টাকা
রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কাওছার মিয়া বলেন, ‘শীত পড়তে শুরু করেছে মাত্র। নতুর আলুর সিজন শুরু হয়নি। তবে এ বছর সিজনের আগেই বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করেছে। সামর্থ‌্যবান ক্রেতাদেরও আগ্রহ রয়েছে নতুন আলুর প্রতি। তাই বিক্রির জন্য আনি। বিক্রিও হয়ে যায়। পুরান আলুর কেজি ৫০ টাকা। সেখানে নতুন আলু বিক্রি করি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা দরে। গত বছরও নতুন আলু ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। সে সময়ে পুরান আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকা। এ বছর ৫০ টাকা। পুরান আলুর দাম এবছর বেশি বলেই নতুন আলুর দামও স্বাভাবিক নিয়মে বেড়েছে। এছাড়া অন্যান্য বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে নতুন আলু বাজারে এলেও এ বছর নভেম্বরেই চলে এসেছে। ফলে দাম কিছুটা বেশি।‘

কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা। বছরে দেশে আলুর চাহিদা কমবেশি ৭৫ লাখ থেকে ৮০ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর দেশে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মাঠে আলু চাষ করেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ চাষি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন হয় এক কোটি আট লাখ টনেরও বেশি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, ‘কোনও সংকট নাই দেশের আলুর বাজারে। সরবরাহেও কোনও জটিলতা তৈরি হয়নি। তারপরেও এই কৃষিপণ্যটির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক কেজি আলুতে ২০ টাকা থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেছে এই সব অসৎ ব্যবসায়ী। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং নানা কারসাজির কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন একটা কাজ। এ বছর আলুর বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা। এখনও প্রান্তিক কৃষকের হাতে আলু এসে পৌঁছায়নি। আলুর দামের কারণে বাজারে অন্য সবজির দামও চড়া। এ কারণে নিম্নআয়ের মানুষদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘নতুন আলু উঠতে শুরু করেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন পুরান সব ধরনের আলুর দামই কমে আসবে। এর সঙ্গে অন্যান্য সবজির দামও কমতে শুরু করবে। বাজারে আলুর অসম দামের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।’

/এফএস/আপ-এনএস/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী