X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন ও আমার সময়কাল

আবদুল মান্নান
১৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০১

আবদুল মান্নান হাঁটি হাঁটি পা পা করে দক্ষিণ বাংলার প্রথম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৮ নভেম্বর তার প্রতিষ্ঠার বর্ণাঢ্য ৫৪ বছর পার করবে। ১৯৬৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও পড়ালেখার জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত করা হয় ১৮ নভেম্বর ১৯৬৬ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে অনেক মানুষের অবদানের কথা শোনা যায় কিন্তু যে মানুষটি দেশ ভাগের পূর্বে বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম দাবিটি তুলেন তাঁর নাম কখনও তেমন একটা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করেন না। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার কিংবদন্তিতুল্য চেয়ারম্যান মৌলভী নূর আহমদ, যিনি একনাগাড়ে ৩৩ বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন এবং প্রাইমারি শিক্ষাকে সবার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার পর মৌলভী নূর আহমদ পাকিস্তান গণপরিষদের একজন সদস্য হন চট্টগ্রাম থেকে। অন্যজন ছিলেন শিল্পপতি এ কে খান। পাকিস্তানের গণপরিষদেও তিনি চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির পুনরুক্তি করেন। আজকের এই দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যাদের অবদান ছিল, যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তাদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। স্মরণ করছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রকল্প পরিচালক ও উপাচার্য ড. এ আর মল্লিককে, যিনি চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সাহস দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টোফার কলম্বাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের অভিবাদন।
যে বিশ্ববিদ্যালয়টি মাত্র চারটি বিভাগ, দুটি অনুষদ, সাত জন শিক্ষক নিয়ে প্রিলিমিনারি ক্লাসে শ’খানেক শিক্ষার্থী ভর্তি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক নয়শত শিক্ষক, দশটি অনুষদ, ৫৪টি বিভাগ, পাঁচটি গবেষণা কেন্দ্র আছে। ছাত্রাবাস আছে আটটি আর ছাত্রীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা আছে পৃথক চারটি হলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় প্রফেসর আবদুল করিম, সৈয়দ আলি আহসান, প্রফেসর মোহাম্মদ আলি,  প্রফেসর জি মসিহ,  প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মাদ সিরাজুদ্দিন, প্রফেসর আসমা সিরাজুদ্দিন, প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, প্রফেসর আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেসি, প্রফেসর শামসুল হক, প্রফেসর এখলাস উদ্দিন, প্রফেসর মুহম্মাদ ইউনূস, প্রফেসর আলি ইমদাদ খান, প্রফেসর অনুপম সেন,  প্রফেসর হারুনুর রশিদ, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, শিল্পী মুর্তাজা বশির, ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ, প্রফেসর রফিউদ্দিন আহমদ, প্রফেসর সৈয়দ মোহাম্মদ আতহার, প্রফেসর হামিদা বানু, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, প্রফেসর জিয়া হায়দার প্রমুখ দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরা শিক্ষকতা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যশ ও খ্যাতি বয়ে এসেছেন। তাদের নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় গর্বিত।
চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে তা শুনেছি কিন্তু চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে এর বেশি কিছু জানা না থাকাতে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থরা ঠাট্টা করতো। মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমাদের শেষ বর্ষের পরীক্ষা হলো সম্ভবত ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। ফলাফল প্রকাশ হতে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমার শিক্ষকরা আঁচ করতে পেরেছিলেন আমার ফল ভালো হবে। বলে রাখলেন ফল বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এডহকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। উল্লেখ্য, বাণিজ্য বিভাগকে পৃথক অনুষদ করার যে আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭০ সালে শুরু হয়েছিল তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার ফলে আমাকে বিভাগের অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন ও স্নেহ করতেন। আমি ছিলাম এই বিভাগের প্রথম ছাত্রদের একজন।
পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে চলে যাই। ফলাফল নিয়ে তেমন কোনও টেনশন নেই। আসলে ছোটকাল হতে কোনও কিছু নিয়ে টেনশন করতে আমাকে কেউ দেখেনি। জুন মাসের দিকে পরীক্ষার ফল বের হলো। তাও জানতে পেরেছিলাম সপ্তাহ খানেক পর যখন আমার সহপাঠী মোসাহিদুর রহমান একটি পোস্ট কার্ডে এক লাইন লিখে পাঠালো ‘তুমি প্রথম’। বাবাকে সালাম করে খবরটা দেওয়ায় তিনি আমাকে দোয়া করে আমাদের সাইকেল পার্টস-এর দোকানের আলমারি খুলে সোনার নিভওয়ালা এক সেট দামি ক্রসপেন (বল পেনসহ) হাতে তুলে দিলেন। বাড়িতে গিয়ে মাকে বললে তিনি আমাকে প্রাণভরে দোয়া করলেন এবং মনে করিয়ে দিলেন আমাদের পড়ালেখার জন্য আমার বাবা কী পরিশ্রমই না করেন।
পরীক্ষার ফলতো বের হলো। তারপর কী করবো তার কোনও চিন্তা আমার মাথায় নেই। খাই দাই, সিনেমা দেখি, সার্কিট হাউজের সামনের মাঠে ফুটবল খেলি আর প্রায় প্রতিদিন সাহিত্যিক আবুল ফজল সাহেবের বাসা ‘সাহিত্য নিকেতন’-এ যাই তাঁর ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। তিনি আমাদের পাড়ায় থাকেন। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মনোনীত উপাচার্য। তাঁর দুই ছেলে আবুল মনসুর ও আবুল মোমেন আমার ছোটকালের বন্ধু। একদিন আবুল ফজল সাহেব আমাকে দেখে জানতে চাইলেন আমার ফাইনাল পরীক্ষা কখন? বলি শেষ হয়ে গেছে। ফলাফল? জানালাম প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। তিনি অনেকটা হুকুমের স্বরেই বললেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার দুই শিক্ষক প্রফেসর আবদুল্লাহ ফারুখ ও প্রফেসর হাবিবুল্লাহ স্যার খবর পাঠালেন যেন কালবিলম্ব না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই। তাদের বলে আসি ঢাকা আসার আমার তেমন কোনও আগ্রহ নেই। তাঁরা বেশ হতাশই হলেন।
আবুল ফজল সাহেব তাঁর ড্রাইভার ওসমানকে বললেন পরদিনই যেন তিনি আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরির আবেদনের ফরম এনে দেন। ওসমান আমার কাছ থেকে দরখাস্তের দাম বাবদ দশ টাকা চেয়ে নেন। ক’দিন পর তা পূরণ করে তার হাতে দেই যেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে দেন। আবার তাকে দশ টাকা দেই।
জুলাই মাসে সাক্ষাৎকার হলো। বোর্ডে আছেন উপাচার্য, বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সৈয়দ শামসুজ্জোহা আর আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর হাবিবুল্লাহ। তিনি আবুল ফজল স্যারকে বললেন, ‘আমাদের ছেলেটাকে আপনি নিয়ে নিলেন।’ জবাবে আবুল ফজল সাহেব বললেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিভাবান শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে। ৬ আগস্ট সাড়ে চারশত টাকা বেতনে যোগ দিলাম ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। সঙ্গে একশত টাকা চিকিৎসা অ্যালাউন্স আর ত্রিশ টাকা যাতায়াত। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় বাসে যাতায়াত করতাম সেই ত্রিশ টাকা দেওয়া হতো না। আর ছিল পনের দিনে কিছু রেশনের ব্যবস্থা। তা আবুল ফজল সাহেবের অবদান। অনেক শিক্ষক ছিলেন যারা কে.সি.ডি রোড থেকে ছেড়ে আসা ছাত্রদের বাসে যাতায়াত করতেন আর তারা ওই ত্রিশ টাকা পেতেন। শিক্ষকদের জন্য এসব বাসে ড্রাইভারের পাশে সিট সংরক্ষিত থাকতো। আমার যোগদানের বছরই বাণিজ্য অনুষদে অনার্স কোর্স চালু হয়েছিল। ভর্তি করা হলো মাত্র কুড়িজন ছাত্রকে। ক্লাস হতো বর্তমান স্কুল ভবনে (এখন আইইআর)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে সব স্মৃতি লিখতে গেলে আস্ত একটা বই হবে। চেষ্টা করছি লিখতে। তবে কিছু স্মৃতি সব সময় মনে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানী পদার্থবিদ আবদুস সালাম আসবেন। তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি দেওয়া হবে। ক্যাম্পাসজুড়ে বেশ সাড়া পড়ে গেলো। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের আমন্ত্রণে একাধিকবার প্রফেসর অমর্ত্য সেন এসেছিলেন। প্রফেসর নজরুল ইসলাম সব সময় সব অনুষ্ঠানে এমনকি তাঁর বাড়িতে আমাকে একসঙ্গে রাতের খাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ড. অমর্ত্য সেনের একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। শিল্পী সুলতানের প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এরশাদের সামরিক আইন ভেঙে শিক্ষকদের নিয়ে রাজপথে সামরিক আইনবিরোধী মিছিল করেছি। একটি ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অবরোধ করে রাখলে শহরে একটি বেসরকারি কলেজে প্রতীকী বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ক্লাস নিয়েছি। আজকাল অনেকে পদ-পদবির জন্য কত না তদবির করেন, তা অনেক সময় আমাকে লজ্জিত করে। আমার সৌভাগ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের মতো দুটি পদেই বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাকে কোনও তদবির ছাড়া পদায়ন করেছেন। তাঁকে যখন চ্যান্সেলর হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ জানালাম তখন তিনি এক কথায় রাজি। এসেছিলেন ১৯৯৯ সালে। সমাবর্তন শেষে একসঙ্গে দুপুরের খাওয়া খেয়েছিলাম।
সব শেষে অন্যতম একটা অর্জনের কথা বলে আজকের এই লেখা শেষ করি। ১৯৮২ সালের সিনেট অধিবেশনের একটা ঘটনা। তখন এরশাদের শাসনকাল। বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া তখনও নিষেধ। সেই সিনেট অধিবেশনে প্রথমবার অন্যদের সঙ্গে আমি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করি। পরদিন কোনও কোনও জাতীয় দৈনিক শিরোনাম করে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সভায় বঙ্গবন্ধুর নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপিত’। জীবনের অনেক প্রাপ্তির জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ঋণী। শুভ জন্মদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
রানা প্লাজার ভুক্তভোগীর আক্ষেপ‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ