X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর দেখানো বন্ধুত্বের পথ ধরেই চলতে হবে

জিয়া আরেফিন আজাদ
১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৩:২২আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৩:২৫

জিয়া আরেফিন আজাদ বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের স্বরূপ কী হবে—এ নিয়ে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী পর্যায়ে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা যায়। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের গুরুত্বটা সকলেই স্বীকার করেন। তবে বন্ধুত্বের জন্য কীভাবে কতটা চেষ্টা করা যায় সে বিষয়ে উপলব্ধিগত তারতম্য রয়েছে। আমরা সকলেই জানি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দুই দেশের জনগণ একই উৎস হতে জীবনধারণের পানি সংগ্রহ করে, একই ইতিহাস ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে, বৈদেশিক যোগাযোগের জন্য একই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে–আরও বহু বিষয় রয়েছে যা রাষ্ট্রীয় সীমানার ছেদরেখা দ্বারা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।
তবে আমাদের দুই দেশেই কিছু মানুষজন আছেন যারা ঐক্যের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে পার্থক্যের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসতে চান। যে বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায় সেগুলোকে নিয়ে রাজনীতি করতে চান। উপমহাদেশে এই রাজনীতির ধারা চালু করেছেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্না। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়তার সমর্থক ছিলেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে নিজ কর্মসূচির পক্ষে কার্যকরভাবে সংযুক্ত করতে না পেরে রাজনীতিতে তিনি গুরুত্ব হারাতে থাকেন। ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ কিংবা নেতিবাচকতা যেটাই বলি সেটাকে তিনি সমগ্র জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। ১৯৪০-এ মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর কাউন্সিলে বক্তৃতায় ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের অধীন নির্বাচিত কংগ্রেস অধ্যুষিত প্রাদেশিক সরকারগুলো সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন–

আমরা অনেক কিছু শিখেছি। যার ফলে আমরা এখন খুবই আশঙ্কাগ্রস্ত এবং আমরা কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি মনে করি কাউকে খুব বেশি বিশ্বাস না করা সকলের জন্যই বিচক্ষণ একটি সিদ্ধান্ত। (ডিএফপি, পাকিস্তান ডকুমেন্ট; ইংরেজি হতে অনুদিত)

সমাজ ও রাজনীতিতে কোনও অর্জনই রাতারাতি আসে না। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতাবিহীন একটি রাষ্ট্রকে তিনি দুই-তিন বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে চূড়ান্তভাবে বিচার করতে গিয়েছেন। পাকিস্তানের অপরিহার্যতা ব্যাখ্যা করতে ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রোতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন—

হিন্দু ভারত ও মুসলমান ভারতকে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন হতে হবে। কারণ এই দুই জাতি সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র এবং কিছু কিছু বিষয়ে তাদের সম্পর্ক চরম দ্বান্দ্বিক। পার্থক্যের কিছু উদাহরণ দিই—আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, স্থাপত্য, সংগীত, উপাস্য, আইনশাস্ত্র, বর্ষপঞ্জি, আমাদের সমগ্র সামাজিক বিন্যাস এবং আমাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ পৃথক। এক ভারতের স্বপ্ন সম্পূর্ণ অলীক কল্পনা। এক ভারতের অর্থ হলো এটা মুসলমানদেরকে ব্রিটিশের অধীন থেকে বর্ণ হিন্দুদের দাসে পরিণত করবে। (বিবিসি ডকুমেন্টারি; ইংরেজি থেকে অনুদিত)

এমন আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। কংগ্রেস পার্টি বা সমকালীন রাজনৈতিক সংগঠনের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি এই অঞ্চলের মানুষ ও তাদের জীবনধারা সম্পর্কে চরম একপেশে মন্তব্য করেছেন। এসব প্রচারণায় ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে মি. জিন্নাহর অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে যেমন বৈচিত্র‌্য রয়েছে তেমনই সেই বৈচিত্র‌্যের মধ্যে এর ঐক্যের সুরটিও রয়েছে। নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের জনক সেটি দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

স্বাধীন ভারতে বর্ণ হিন্দুদের নিকট মুসলমানদের নিপীড়নের সম্ভাবনায় জিন্নাহ আচ্ছন্ন ছিলেন। জিন্নাহর পাকিস্তানে যোগেন মণ্ডলের নেতৃত্বে বাংলার শূদ্র হিন্দুগণ সমর্থন দিয়েছিল। সেই যোগেন মণ্ডলকে লজ্জাজনকভাবে পাকিস্তান ত্যাগ করে কলকাতায় আশ্রয় নিতে হয়। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পার্থক্যের বিষয় ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। ফেডারেল সরকারের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা রাখার বিরোধিতা থেকেই মুসলিম লীগের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায়। অথচ পাকিস্তান কায়েমের পর সেই স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নেই জিন্নাহ ও তার অনুসারীরা চরম অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে গেছে। জনগণের রাজনৈতিক অভিব্যক্তিকে একপেশে দৃষ্টিতে দেখেছেন বলেই ভারতবর্ষের মানুষের বৈচিত্র‌্যকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা।

এর বিপরীতে আমরা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাপানি সাংবাদিক নাগিসা ওশিমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন—

দুইশো বছরের শাসনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু হয়েছে বাংলাদেশের মাটি থেকে। প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয় বাংলাদেশের মাটি থেকে। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয় বাংলাদেশের মাটি থেকে। বাঙালিরা গর্বিত জাতি। আপনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা শুনেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তিনিও বাংলাদেশের মানুষ। আপনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানেন, তিনি বাংলাদেশের সম্পদ। জনাব সোহরাওয়ার্দী, তিনিও বাংলাদেশের মানুষ। জনাব এ কে এম ফজলুল হক, তিনিও বাংলাদেশের। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীরা সব বাংলাদেশের ছেলে। এই বাংলার জমি পৃথিবীর সুন্দরতম একটি ভূমি। আমাদের বাংলা ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাষা। বাংলা ভাষার গান খুবই সুন্দর। আপনারা যেমন শিল্পবোধসম্পন্ন জাতি তেমনি বাঙালিরাও অত্যন্ত শৈল্পিক একটি জাতি। তাদের গান, তাদের নাচ, তাদের সংস্কৃতি, তাদের পোশাক, তাদের আন্দোলন- প্রতিটিতেই তাদের স্বাতন্ত্র‌্য ও সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। (‘রহমান, ফাদার অব বেঙ্গল’ ডকুমেন্টারি হতে)

দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একজন জাতীয়তাবাদী নেতার ‘রোমান্টিক’ ভাবনার পরিচয় ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। তার ভাষায় অতিশয়োক্তি থাকতে পারে কিন্তু সেটি কাউকে খাটো করে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারি হয়েও তিনি ভারতীয় সংগ্রামের বৃহত্তর প্রেক্ষিতকে সাবলীলভাবে ধারণ করেছেন। নেতাজি সুভাষ বোস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিত্বের কৃতিত্বে তিনি গর্ববোধ করেছেন। অনুশীলন চক্রের বিপ্লবী কার্যকলাপকে তিনি হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। যৌথ সম্পদের চেতনায় তার বাংলাপ্রীতি আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করেছে।

ঠিক এই জায়গাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা মিল খুঁজে পাই আরেক মহান নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভুটান প্রভৃতি রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি বহু দেশের জনপ্রতিনিধি ও সমাজকর্মীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে লড়াই করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চ এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল সমীকরণকে নিজ ক্যারিশমায় বাংলাদেশের সংগ্রামের অনুকূলে নিয়ে আসার কৃতিত্ব একজন একক ব্যক্তির। তিনি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। 

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের গভীরতা ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে শ্রীমতি গান্ধীর সম্যক ধারণা ছিল। এই সংগ্রামের নেতৃত্ব সম্পর্কে তার আস্থা ছিল। তার চেয়েও বড় কথা হলো একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি জানতেন, একটি সংগ্রামী জাতির মর্যাদাবোধ কতটুকু। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে, এর নেতৃত্বকে তিনি যে সম্মান দেখিয়েছেন তা তুলনাহীন। সেই কারণেই আমরা দেখি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম এর স্মৃতিতে আমরা জেনেছি শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন—

‘এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই।’ (তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা; পৃ: ৬৯)

শ্রীমতি গান্ধী তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তারই প্রতিফলন আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে। আমীরুল ইসলাম আরও বলেছেন—

যখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ভারতের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিল এবং ভারতের সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া ছাড়া উপায় নেই, সেই সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব শ্রীমতি গান্ধীকে বললেন যে, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য ঢুকবার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং কীভাবে সৈন্য ঢুকবে তার একটা ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সেই ভিত্তি ছাড়া বাংলাদেশে ঢোকা যাবে না। (প্রাগুক্ত; পৃ: ৮৭)

আমরা সবাই জানি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ এসেছিল যৌথ কমান্ডের অধীন। যৌথ কমান্ডের সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্নেল পদমর্যাদার এম. এ. জি ওসমানীকে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার সমমর্যাদায় নিয়ে এসে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনী যখন ফ্রান্সে প্রবেশ করে তখনও এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়ের বিষয়ে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও এমন সমমর্যাদার চুক্তি সাধিত হয়েছিল শ্রীমতি গান্ধীর গণতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাকে বিশ্বনেতার মর্যাদা প্রদান করে। কিন্তু তিনি ছিলেন বিনয় ও সারল্যের প্রতিমূর্তি। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন সেদিন দুপুরে দিল্লির প্যারেড গ্রাউন্ডে তাকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। লাখো জনতার সেই সভায় ইন্দিরা বলেন—

শেখ সাহেব তার জনসাধারণকে দু’টো ওয়াদা করেছিলেন। এক, জীবনভর তিনি তাদের সঙ্গে থাকবেন এবং তাদেরকে একটি নতুন দেশ উপহার দেবেন। তার শরীর যদিও জেলে বন্দি ছিল কিন্তু তার আত্মাকে কেউ বন্দি করতে পারেনি। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের প্রেরণার উৎস। তাই তারা সাহসের সাথে লড়াই করেছে আর আজ তারা স্বাধীন। আর তারা সেই আদর্শ নিয়েই লড়াই করেছে যে আদর্শ আমাদের দেশকে বরাবর প্রেরণা দিয়ে এসেছে। আমিও আমার জনগণকে তিনটি ওয়াদা করেছিলাম। এক, যে শরণার্থী এসেছে তাদের সকলে ফিরে যাবে। দুই, আমরা সর্বতোভাবে মুক্তিবাহিনীর সহায়তা করব এবং বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবো। তিন, শেখ সাহেবকে আমরা অতি অবশ্যই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করব। আমরাও আমাদের তিনটি ওয়াদাই পূরণ করেছি। (এপি ভিডিও ক্লিপ হতে; হিন্দি থেকে অনুদিত)

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন—

আমার ভাই ও বোনেরা, বাংলাদেশ ও ভারত পাশাপাশি বাস করবে শান্তিপূর্ণভাবে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের মধ্যে বন্দি ছিলাম দু’দিন আগেও। শ্রীমতি গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন জায়গা নাই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে এবং তার সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি লোকের খাওয়ার বন্দোবস্ত ও থাকার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন, আমি জানি, ভারতবর্ষের মানুষও দুঃখী আছে সেখানে। তারাও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরও অভাব-অভিযোগ রয়েছে। তা থাকতেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে, আমার লোকরে সাহায্য করার জন্য-চিরদিন আমরা তা ভুলতে পারবো না। ... আমি বিশ্বাস করি সেকুলারিজমে। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোশালিজমে। আমাকে প্রশ্ন করা হয়, “শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির সাথে আপনার আদর্শের এত মিল কেন?” আমি বলি, “এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির মিল।” (এপি ভিডিও ক্লিপস)

১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ১০ লাখ মানুষের সমাবেশে সেই একই কথার পুনরুক্তি করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের পতিত আদর্শ থেকে আমাদের সুস্পষ্ট ও স্থায়ী পার্থক্যের জায়গাটা তিনি পরিষ্কার করেন—

পথের ভিখিরি হচ্ছে তার কথা বলবে না। দুঃখী মানুষের গায়ে কাপড় নাই, তার কথা বলবে না। হিন্দুত্ব আমার দুশমন। হিন্দুস্তান কেন আমার দুশমন হবে? ভারতবর্ষ কেন আমার দুশমন হবে?  তারা তো আমাদের ভাই। তাদের সঙ্গে আমরা ভাই হিসাবে বাস করব। (এপি ভিডিও ক্লিপস)

জিন্নাহর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধীর উদাহরণ আনার কারণ হলো ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের বেঞ্চমার্ককে শনাক্ত করা। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর তৈরি রোডম্যাপই আমাদের বেঞ্চমার্ক। ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই নেতা একত্রিত হয়েছেন তাদের আদর্শের কারণে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের জন্য তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। নিজ রাষ্ট্রের দারিদ্র‌্যকে উপেক্ষা করে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন যে নেতা তিনি কেবল ভারতের নেতা নন, তিনি আমাদের নেতা।

৩১ অক্টোবর তার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। আগামী ১৭ নভেম্বর তার জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার গভীর কৃতজ্ঞতায় এই নেতাকে স্মরণ করে। ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবর্ষ পালনের সময় আমাদের দাবি ছিল রাজধানীর একটা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক তার নামে উৎসর্গ করার। ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রীমতি গান্ধীকে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নৌকার আদলে সেখানে একটি মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়ার শাসনে সেটি ভেঙে ফেলা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ইন্দিরা মঞ্চ’টি পুনর্নিমাণের দাবিও আছে। শ্রীমতি গান্ধীর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিকে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হোক।

বাংলাদেশের উচিত হবে এই দিনে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা। ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মান প্রদর্শন করার মাধ্যমে তাকে কিংবা ভারত রাষ্ট্রকে সম্মানিত করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করা হবে তা হলো, গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক সৌহার্দ্যের বাণীকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষিকী উদযাপনের মধ্যে এই কর্মসূচিগুলো সন্নিবেশ করা প্রয়োজন।

এই উপমহাদেশ একটি ঐতিহাসিক ভূমি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের রূপরেখা চূড়ান্ত করার কাজটি আমাদের মহান নেতারা ইতোমধ্যে সমাপ্ত করেছেন। আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করা। ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সাংস্কৃতিক ঐক্যকে অস্বীকার করে দ্বান্দ্বিক পথে গিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র পথ হারিয়েছে। প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে তারা কখনও যুক্তরাষ্ট্র, কখনও সৌদি আরব, কখনও বা চীনের কাছে বন্ধুত্ব খুঁজেছে। যে দাসত্বের ভীতি তাকে বিপথগামী করেছে সেই দাসত্বে সে আরও বেশি করে বাঁধা পড়েছে। আমাদেরকে সাহস করে বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর পথে যেতে হবে। বন্ধুত্বের পথে অন্তরায় কী, নির্মোহভাবে তা খুঁজে বের করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধীর অনুসৃত নীতিতে জনসাধারণের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর অন্যথা হলো আমাদের রাষ্ট্রের মৌল আদর্শ থেকে বিচ্যুতি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ।

ই মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ