X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌমিত্র: তোমার আগুন আকাশের চেয়ে বড়ো

আহসান কবির
২০ নভেম্বর ২০২০, ১২:১৫আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২০, ১২:১৭

আহসান কবির এক একদিন
নদী জেগে ওঠে ডমরু বাজিয়ে
তোমারও ঘুম ভাঙ্গাতে চায়
বসন্তের গানও সেদিন বুঝি বলতে চায়
যেদিন থাকবো না সেদিনও ভালোবেসো
স্মৃতিও এক একদিন সত্যি হয়ে ওঠে।

–এক একদিন—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা শেষ কবিতা।

পুরনো দিনের মতো নতুন করেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভালোবাসার সময় শুরু হয়েছে। বিজয়ের রথ ছিল তার হাতে। তিনি যেখানে গেছেন সেখানেই বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছেন। সব খেলা কিংবা যুদ্ধে বিজয় আসে না। ক্যানসার আর করোনা অজানা আততায়ী হয়ে এসেছিল যেন। এ কারণে বলে যেতে পেরেছিলেন—

‘আমার মধ্যে বিসর্জনের অন্ধকার আছে। সেটা এক আততায়ীর মতো বসে আছে। সে আমাকে ধরতে পারবে না। অতএব পালাও। দে ছুট’।..ছুটতে ছুটতে অজানা আততায়ীকে সারপ্রাইজ দিয়ে সৌমিত্র চলে গেছেন রহস্যময় ‘ফেলুদা’ হয়ে। জানি না যেখানে গেছেন সেখানে তার আর সত্যজিৎ রায়ের ‘মিশন-১৫’ শুরু হবে কিনা! হিসেব বলছে সত্যজিৎ রায়ের চৌত্রিশটির মধ্যে চৌদ্দটি ছবির ‘নায়ক’ এই সৌমিত্র!

নায়ক শব্দটা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে বাঙালির ‘সাংস্কৃতিক অহংকার’ সত্যজিৎ রায় যখন ‘নায়ক’ ছবিটা করেন তখন তার নিয়মিত নায়ক সৌমিত্রকে সেই ছবিতে নেননি। নিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। প্রশ্নটা উঠেছিল তখনই। সৌমিত্র কি নায়ক নন? কথিত আর্ট ফিল্মের অভিনেতা? এই প্রশ্নের উত্তর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের পত্রিকায় কয়েকবার দিতে হয়েছিল তাকে। তিনি বলেছিলেন—নায়ক ছবির জন্য উত্তম কুমারই ঠিক ছিলেন। মনে রাখতে হবে সত্যজিৎ কখনও ‘মিসকাস্ট’ করতে পারেন না! ‘অপু ট্রিলজী’র সময়কাল থেকেই বাংলা ছবির দর্শক নাকি মোহামেডান- আবাহনী  বা মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল কিংবা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের মতো দুই ভাগে বিভাজিত হয়েছিল, এখনও নাকি আছে। একদল কুমার (উত্তম) আর অন্যদল বাবু’র (সৌমিত্র) সমর্থক!! আলোচনার টেবিলে, পত্রিকার রিপোর্টে কিংবা টেলিভিশনের টকশোতে অভিনয় জগতের এই দুইজন নাকি অপরিহার্য ছিলেন!

আসলেই বাংলা ছবি আর মঞ্চের জন্য সৌমিত্র ছিলেন প্রায় অপরিহার্য অভিনেতা। তার অভিনয় দিয়ে তিনি প্রমাণ করতেন তিনি কখনও ‘মিসকাস্ট’ নন। মঞ্চেও তিনি ছিলেন সমান দাপুটে। ভাগ করে নিয়েছিলেন অভিনয়ের মাত্রা। সত্যজিৎ বা জীবনধর্মী গল্পে কেমন হবে তার অভিনয়, কেমন হবে চিরায়ত বাংলা কিংবা বাণিজ্যিক ছবিতে! নিজেকে ছবির চরিত্রের মতো করে অপরূপভাবে ভাঙতে পারতেন। তিনি জানতেন অপরূপভাবে ভাঙা গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনও সখনও! সৌমিত্র নিজেকে সীমাহীন ভাঙতেন, অপরূপভাবে কোনও চরিত্র গড়ার জন্য। আর তাই চলচ্চিত্র কিংবা জীবনবোধের জায়গা থেকে অপুরা ফিরে আসে, ফিরে আসে চেতনার জায়গা থেকে উদয়ন মাস্টার! তিনি চরম বিপর্যয়ের মুখেও বলতেন—ফাইট এ’ড ফাইট সৌমিত্র! সাঁতারের কোচ হিসেবে ক্ষিতিদার চরিত্রটা তেমন লড়াকু। সব লড়াকু হয়তো শতায়ু হন না, যেমন হননি সৌমিত্র। হয়তো করোনা তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। ঘরে-বাইরের স্বদেশী সন্দীপের সেই ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানের বিপরীতে তার চলে যাওয়াটা হয়তো স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। জীবনযুদ্ধে পরাজিত অপুর পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে উড়িয়ে দেওয়ার সেই দুঃখময় বহিঃপ্রকাশও স্বপ্নভঙ্গের মতো ফিরে ফিরে আসে জীবনে। সৌমিত্র থাকবেন না, কিন্তু অপুরা বারবার ফিরে আসবে জীবনে। ক্রান্তিকাল কিংবা জগদ্দল পাথরের মতো দুঃশাসন যখন চেপে বসবে রাষ্ট্রময়, উদয়ন মাস্টারের ছাত্ররা তার চেতনা বুকে নিয়ে ঠিকই নামবে রাস্তায়। হাঁক দেবে—দড়ি ধরে মার টান/রাজা হবে খান খান। রাজা এসেছে রাজা গেছে, সৌমিত্রর তাতে কিছু যায় আসেনি।

আজ্ঞাবহতার বার্তা নিয়ে মাথা নত করেননি কারও কাছে। কখনও হতে চাননি কোনও দল বা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে নতজানু। একসময়ে মনে হতো কিং লিয়ার-এর চরিত্রটা তার করা হবে না। মঞ্চে অসাধারণভাবে সেটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন সম্ভবত এই ভেবে যে ক্ষমতার রাজারা চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু অভিনয়ের রাজারা জন্ম নেয় মঞ্চে  কিংবা পর্দায়, বেঁচে থাকে মানুষের চেতনা আর স্মৃতিতে। সৌমিত্র সাহেবের বুকের ভেতর বাস করা অভিনয়ের পাখিটা হয়তো কাঁদছে এখন। সে আর কোনও রাজার বুকে ঠাঁই নিতে পারবে না! রাজা যায় রাজা আসে, শুধু সৌমিত্র’র মতো রাজারা থেকে যান হৃদয়ের নরম নদী হয়ে।

নদী শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে যায়। নদী সৃষ্টি হবার আগে জন্মের জানান দেয় উৎস। আইনজীবী বাবার ঘরে জন্মালেও নাটক যেন রক্তে মিশে ছিল। বাবা নাটক পাগল ছিলেন। আদি বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ায় ‘রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ’  থেকে সামান্য দূরে, কয়া গ্রামে। সে কারণে কিনা জানা না গেলেও সারাজীবনে সৌমিত্রর রবীন্দ্র নির্ভরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কলেজ জীবনে শিশির ভাদুড়ির নাটক দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আজীবন অভিনয়ের সঙ্গেই থাকবেন। সত্যজিতের সঙ্গে দেখা হবার পর তার জীবনের বাঁক বদল ঘটেছিল। সত্যজিতের ‘অপুর সংসারে’ অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিলেন। তার দ্বিতীয় ছবিও ছিল সত্যজিতের, নাম ‘দেবী’। নায়িকা ঠাকুর বাড়ির সদস্য শর্মিলা ঠাকুর। দেবীর সমান্তরালে তপন সিংয়ের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এ অভিনয় করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। অপু বা দেবীর সৌমিত্রের সঙ্গে ক্ষুধিত পাষাণের সৌমিত্রের ছিল আকাশ পাতাল ফারাক। তিনি নিজেকে সহজাতভাবে আলাদা করতে পারতেন! সত্যজিতের ‘অভিযান’, ‘অশনি সংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, চারুলতা, জয়বাবা ফেলুনাথ’ এবং ‘গণশত্রু’তে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। যুগলবন্দিতা কিংবা বন্ধুত্বের বন্ধনের চেয়েও এই দুজন মানুষের সম্পর্কের সেতু ছিল সৃষ্টিশীলতা। মঞ্চ  কিংবা সিনেমার বাইরে টেলিভিশন নাটক ও ধারাবাহিকেও কাজ করেছেন সৌমিত্র। জীবনের প্রথম কাজ ছিল বেতারে। আর সবচেয়ে ব্যতিক্রম ছিল কবিতা আবৃত্তি ও সাহিত্যের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। সমালোচকদের চোখে উত্তীর্ণ সাহিত্য পত্রিকা ‘এক্ষণ’ সম্পাদনা করতেন নির্মাল্য আচার্য্যর সঙ্গে। ‘এক্ষণ’-এর প্রচ্ছদ এঁকে দিতেন সত্যজিৎ রায়। এক্ষণের জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহেরও কাজ করতেন সৌমিত্র! শেষ জীবনে ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকেছিলেন। পুরো জীবনটা ব্যয় করেছেন শিল্প-সাহিত্য-নাটক-সিনেমা-মঞ্চ কিংবা বেতারের জন্য। তার অভিনয়ের জীবনটাও বোধ করি কালোত্তীর্ণ কবিতার মতো।

সত্যজিতের ছবির বাইরেও আরও প্রায় ২৮৭টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। তপন সিংয়ের ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে ভিলেনের অভিনয় করেছিলেন, যার নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। অতি অভিনয় কিংবা মেলোড্রামার আশ্রয় নেননি, স্বাভাবিকতার চূড়ান্ত মাত্রা দিয়ে এই নেগেটিভ চরিত্র তুলে ধরেছেন, বুঝিয়েছেন ভিলেন মানেই যাত্রা ঢঙ্গের অতি অভিনয় নয়। গড়পড়তা বাণিজ্যিক ছবিতে যেমন সফল ছিলেন, সফল হয়েছিলেন মনে রাখার মতো ছবিগুলোতেও। সত্যজিতের বাইরেও তার অভিনয় করা সাত পাকে বাঁধা, নৌকাডুবি, প্রাক্তন, ঝিনু গোয়ালার গলি, পুনশ্চ, বরুনবাবুর বন্ধু বা অসুখের মতো ছবি রয়েছে। বাংলা ছবির স্বর্ণালি দিনের সোনা ঝরানো ছবিগুলোর উৎসবমুখর দিনে সৌমিত্র ছিলেন শিল্প ও সুন্দরের পূজারি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে তার বিজয়রথ থেমে গেছে। অপু, উদয়ন পণ্ডিতরা থেকে যাবেন কিন্তু ‘অরণ‌্যের দিনরাত্রি’র গল্প আর শোনা হবে না। প্রাক্তন-এর মতো ট্রেনযাত্রা হবে না, হবে না বিদেশিনীকে গান শোনানো আর। বেলাশেষে আর ফেলুদার মতো রহস্যভেদ করা হবে না! ফেলুদার হাত ধরে গণশত্রুকে খোঁজ করা হবে না! শেষমেশ তার হাসিটাই থেকে যাবে!

তার প্রয়াণে যেন থমকে দাঁড়ালো সময়। তিনি থামলেন। থামতে জানতে হয়। বব ডিলান, ম্যারাডোনা কিংবা ক্রিকেটার আজহারউদ্দীনরা থামতে শেখেননি সময়মতো। সৌমিত্র দেখিয়ে গেছেন কখন থামতে হবে, কখন কবিতা বা ছবির সঙ্গে গেরস্তালি করতে হবে। তিনি কয়েকবার বলেছেন—‘বসন্ত নয় আমার দরোজায় প্রথম কড়া নেড়েছিল অবহেলা’। তিনি সব অবহেলাকে রাস্তায় ফেলে সাফল্যের শিল্পিত সোপানে ওঠার পথ দেখিয়ে গেছেন। নিজেকে খুব সামান্য মানুষ ভেবে বলতেন—‘বেঁচে আছি কয়েকটা ভালো কাজ করার জন্য! সবসময় ভালো চরিত্রের সন্ধানে থাকতেন। ভালো চরিত্র পাওয়ার বাসনা কি কমেছে—এর উত্তরে বলতেন—‘ওটা কমবে আমি মাটি নিলে’!

তিনি মাটি নিয়েছেন। কখনও নতজানু হননি। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, এমনকি বিদেশি পুরস্কারও ছিল তার ঝুলিতে। শেষকৃত্যের সময় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের বিউগলের করুণ সুর আর গান স্যালুট দেখে কান্নাকাতর একজন সৌমিত্র ভক্তের উক্তি ছিল—পুলিশের বহু কার্যকলাপ আমার ভালো লাগে না। এখন এই গানস্যালুটকে মনে হচ্ছে শিল্পের কান্না। সৌমিত্র সাহেবকে হারানোর বেদনা বুক থেকে চোখের জল হয়ে ঐ দূর আকাশে মিশে যাচ্ছে। বিদায় উদয়ন পণ্ডিত! কবি শ্রীজাতও তেমনই বললেন—

দাহ মুছে যাক, দহন জাগুক দাগে

মহীরুহ গেলে নতজানু হয় ঝড়ও

ছাই উড়ে যেতে এক মুহূর্ত লাগে

তোমার আগুন আকাশের চেয়ে বড়ো!

 

লেখক: রম্যলেখক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ