X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

কে শোনে কার কথা?

রেজানুর রহমান
৩০ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৪৪আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৪৫

রেজানুর রহমান দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের বিশ্লেষণ নিয়ে প্রচার হয় অনুষ্ঠানটি। প্রতিদিনই নতুন নতুন খবরের মুখোমুখি হই। ইতিবাচক, নেতিবাচক নানা খবর। পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার মতো একটা অপেক্ষা থাকে প্রতিদিন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম পড়ার আগে চোখ বুজে প্রার্থনা করি, আজ যেন কিছু ভালো খবর থাকে। ইতিবাচক খবর... প্রায় দিনই তেমন কোনও ইতিবাচক খবর চোখে পড়ে না। অধিকাংশ খবরই কেমন যেন আতঙ্কের। ভয়ের...প্রতিদিনই বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে থাকে করোনার খবর। সংক্রমণ বেড়েই চলছে। সতর্ক হোন। মাস্ক পরুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? অথচ শুধুমাত্র নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করলে করোনার সংক্রমণ থেকে শতকরা ৮০ ভাগ রেহাই পাওয়া সম্ভব। সে জন্যই সরকারি নির্দেশনা রয়েছে–‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’। রাস্তায় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে মাস্ক না পরার জন্য জরিমানা করা হচ্ছে। তবুও যেন হুঁশ হচ্ছে না কারোই। বরং মাস্ক পরা নিয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। পুলিশ দেখলে অনেকে তড়িঘড়ি করে মাস্ক পরেন। আর পুলিশ দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া মাত্রই মুখের মাস্ক খুলে অনেকেই নির্বিকারে ‘হি হি’ করে হাসেন। যেন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার মধ্যে জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। আহা! কী যে মজার সেই আনন্দ!

আমি নিকেতন (গুলশান) এলাকায় থাকি। এখানে নির্দেশ জারি করা হয়েছে মুখে মাস্ক বিহীন কেউ চলাফেরা করতে পারবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মাস্ক পরতে বলায় অনেকেই যেন মহা বিরক্ত। ভাবটা এমন, আমি মাস্ক পরবো কী পরবো না সেটা তো আমার ব্যাপার। আপনি বলার কে? নিকেতনে বাজার গেট বলে একটি এলাকা আছে। ছোট একটি গেট দিয়ে যাওয়া-আসা করা যায়। একদিন সকালে একটি অভিনব দৃশ্য দেখলাম। গেটের মুখে কর্তব্যরত প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। যাতে মুখে মাস্ক ছাড়া কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। আহারে বেচারা প্রহরী। কী কষ্টটাই না করছে। মুখে মাস্ক ছাড়া অনেকেই ভেতরে ঢুকতে চাইছে। প্রহরী বাধা দিতে গেলেই বাধছে বিপত্তি। তর্কে লিপ্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। ‘আমি মাস্ক পরবো না। তাতে তোমার কী?’

প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম ওই গেটের পাশে। হ্যাঁ, কেউ কেউ মাস্ক পরে ভেতরে ঢুকছেন। আবার কেউ কেউ যেন নির্বিকার। মাস্ক পরেনি এমন একজনকে দাঁড় করালো প্রহরী। অনুরোধের সুরে বললো, মুখে মাস্ক পরেন। মাঝ বয়সী লোকটি মহা বিরক্ত। আমি মাস্ক পরবো না। লোকটির কথা শুনে প্রহরী বললো, মাস্ক না পরলে আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না।

এবার লোকটি ক্ষেপে গেলো প্রহরীর ওপর। ভেতরে যেতে পারবো না মানে? অয় মিয়া তোমারে এখানে ডিউটিতে দিছে কে? জানো আমি কে? প্রহরী বেচারা তাকে আটকাতে পারলো না। বীরদর্পে চলে গেলো লোকটি। যেন মুখে মাস্ক না রাখতে পেরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাজটি করেছে সে।

প্রহরী এবার একজন তরুণকে আটকালো। তার মুকেও মাস্ক নাই। প্রহরীর কথা শুনে প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে একটি মাস্ক বের করে মুখে দিলো সে। প্রহরী খুশি হয়ে বললো, এবার যান...। ওই তরুণ কিছুদূর গিয়ে মুখের মাস্ক খুলে আবার প্যান্টের পেছনের পকেটে গুঁজে রাখলো। ভাবটা এমন, নিয়ম না মানার আনন্দই যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ।

প্রহরী এবার একজন বয়স্ক মানুষকে আটকালো। তার মুখে মাস্ক নেই। প্রহরী বললো, মাস্ক পরেন। লোকটি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, আমি তো ঘন ঘন পান খাই...তাই মাস্ক পরলে অসুবিধা। প্রহরী মুখে মাস্ক ছাড়া তাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। কিন্তু লোকটি মাস্ক পরবেনই না...অহেতুক তর্ক শুরু করে দিলেন।

মুখে মাস্ক পরবেন কী পরবেন না এটা কি এখন কোনও তর্কের বিষয়? নিজের ভালো তো পাগলও বোঝে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা কেন মাস্ক পরার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি না? অহেতুক তর্কে জড়াচ্ছি। মাস্ক পরা না পরা নিয়ে চোর পুলিশ খেলা খেলছি। কিন্তু কেন? দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সত্যি সত্যি শুরু হয়েছে। করোনা যাকে ধরছে তাকে যেন সহজেই ছাড়ছে না।

আমার এক সাংবাদিক বন্ধু কেরানীগঞ্জ এলাকায় থাকেন! প্রসঙ্গ তুলতেই আক্ষেপ করে বললেন, ঢাকার বাইরে যান দেখবেন করোনার কোনোই আতঙ্ক নেই। হাটে বাজারে, রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়েও কারও মুখে মাস্ক নেই। বরং আমরা যারা মুখে মাস্ক পরে থাকি তাদের নিয়ে ইয়ার্কি, ঠাট্টাও করা হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় প্রচণ্ড শীত জেঁকে বসেছে। শীত মানেই করোনা শক্তিশালী হয়ে ওঠা। অথচ শীতার্ত মানুষের মাঝে করোনার কোনও ভীতিই লক্ষ করা যাচ্ছে না। একটা কথা মনে রাখা দরকার। হঠাৎ করেই করোনার সংক্রমণ বোঝা যায় না। এই রোগটা তুষের আগুনের মতো। ভেতরে ভেতরে পড়তে থাকে। হঠাৎ দেখা যায় সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তখন আফসোস ছাড়া আর করার কিছুই থাকে না। শীতার্ত মানুষের মধ্যে এখনই হয়তো করোনার উপসর্গ বোঝা যাচ্ছে না। এমনও হতে পারে তুষের আগুনের মতো ভেতরে ভেতরে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। এজন্য আমরা কি সর্তক আছি? অথবা সতর্কতামূলক কোনও আগাম ব্যবস্থা কি গ্রহণ করেছি?

আজকের এই লেখাটির একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। প্রিয় পাঠক, করোনার ব্যাপারে মোটেই হেলাফেলা করবেন না। নিয়মিত মাস্ক পরলেই করোনার সংক্রমণ থেকে শতকরা ৮০ ভাগ মুক্ত থাকা সম্ভব। অথচ এক্ষেত্রেও চলছে হেলাফেলা। করোনার কারণে দেশের অনেক বিশিষ্টজন ইতোমধ্যে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, ড. এমাজ উদ্দীন আহমেদ, বিজ্ঞানী আলী আসগর, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সাদাত হুসাইন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, আজাদ রহমান, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বাবুল, রাজনীতিবিদ শাজাহান সিরাজ, ড. বোরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর, ভাষা সংগ্রামী ড. সাঈদ হায়দার, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ, সাংবাদিক রশীদুন্নবী বাবু, শিক্ষাবিদ সুফিয়া আহমেদ, শিশুসাহিত্যিক আলম তালুকদার, অনুবাদক জাফর আলম, কথাসাহিত্যিক মকবুলা মনজুর, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বদর উদ্দিন কামরান, নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের সহ অনেকের নাম স্মরণ করছি।

প্রতিদিনই আমাদের মাথার ওপর থেকে নির্ভরতার ছাদগুলো সরে যাচ্ছে। অথচ একটু সচেতন দৃষ্টিভঙ্গিই পারে করোনার এই দুঃসহ কাল থেকে মুক্তি দিতে। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত মাস্ককেই নির্ভরযোগ্য প্রতিষেধক ভাবা হচ্ছে। কাজেই হেলা ফেলা না করে নিয়মিত মাস্ক পরুন। অন্যকেও মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করুন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় সকল প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা অনেক। ধরা যাক, কোনও রাজনৈতিক আলোচনা সভার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী নেতা যদি ঘোষণা দেন যে মাস্ক ছাড়া কেউ সভায় উপস্থিত হতে পারবে না। তাহলেই দেখবেন কর্মীদের মধ্যে মাস্ক পরার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। করোনার এই দুঃসময়ে কথা ও কাজের মধ্যে অধিকতর সমন্বয় জরুরি। মুখে বললাম মাস্ক পরুন। ভিড় এড়িয়ে চলুন। অথচ ফুটবল খেলার ভিড় দেখানোর জন্য স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গ্যালারি উন্মুক্ত করে দিলাম। এটা এক ধরনের স্ব-বিরোধিতা। একটা বিষয় জোর দিয়েই বলতে চাই। এই দেশের ভালো-মন্দ অনেক কিছুই নির্ভর করে রাজনৈতিক চর্চা ও সিদ্ধান্তের ওপর। নেতা যা বলেন কর্মী সমর্থকেরা নেতার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাই করে। কাজেই নেতা যদি স্পষ্ট ঘোষণা দেন যে, আজ থেকে কোনও সভা-সমাবেশে মুখে মাস্ক ছাড়া কাউকে এলাউ করা হবে না। তাহলেই দেখবেন মুখে মাস্ক পরার অভ্যাস শুরু হয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, নেতা যেন নিজেও মাস্ক পরেন। তা নাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয়ের প্রতি জোর দিতেই চাই। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংকটে ছাত্র সমাজের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানান দুর্যোগে ছাত্র সংগঠনগুলোই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এবারই ব্যতিক্রম চোখে পড়ছে। করোনা সতর্কতায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা জরুরি। তাই বলে এক্ষেত্রে ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর কী কোনও ভূমিকাই থাকবে না? স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তো ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কথায় আছে ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। এবার সেই ইচ্ছেটাই যেন অনুপস্থিত! কিন্তু কেন?

শেষে নিকেতনের গেটে দেখা সেই তরুণের কথায় ফিরে আসি। সে পণ করেছে মাস্ক পরবে না। কেন? কারণ সে প্রভাবশালী ব্যক্তি। সে জন্যই সে প্রহরীকে হুমকি দিয়েছে, অয় মিয়া আমারে চেনো?

আসুন সকলে মিলে তার এই হুমকির বিরুদ্ধে কথা বলি–অয় মিয়া তুমি কোথাকার কোন....যে, তোমাকে চিনতে হবে। মুখে মাস্ক পরো মিয়া...মাস্ক পরো...নাইলে কিন্তু খবর আছে...

প্রিয় পাঠক, শীতের এই সময়টায় ঘর থেকে বের হলেই মাস্ক পরবেন প্লিজ...

দেশকে ভালোবেসে ভালো থাকুন সকলে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ