X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপন মজুমদার : দূরে থেকেও আপন

দাউদ হায়দার
০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:২৫আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:২৮

স্বপন মজুমদার : দূরে থেকেও আপন
আরব্য রজনীর নতুন অনুবাদ বেরিয়েছে, প্রথম সংস্করণ, কলকাতারই এক প্রকাশনা সংস্থা থেকে, বহু পাতায় শাদাকালো, রঙিন ছবি। আহামরি অঙ্কন নয়। কিন্তু ঝকমকে। অফসেটে ছাপা। নজর কাড়ে।

আমাদের জুনিয়র (তুলনামূলক সাহিত্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) অরিন্দম ভট্টাচার্য, ক্লাসশেষে, কলেজ স্ট্রিটের কোনো এক বইয়ের দোকানে কাজ করেন, অন্য এক প্রকাশনায় প্রুফ দেখেন। যা আয় তা দিয়েই জীবন নির্বাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফী, হস্টেলের ভাড়া, খাওয়া। ওঁর এক সহপাঠিনীর কাছে জানা গেল অরিন্দম রাত জেগে বই পড়েন এবং ফরাসি ভাষাও শেখেন।

এ-ও জানা গেল, অরিন্দম ক্লাসের সহপাঠী/সহপাঠিনী, সিনিয়র এমনকি মাস্টারমশাইদের মজার মজার নামকরণ, পদবি যুক্ত করেন।

চেপে ধরলুম একদিন। ব্যাগ থেকে ‘আরব্য রজনী’ বের করে একটি ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার ছবি?’ ছবির নিচে ক্যাপশন, খলিফা হারুন-অর-রশিদ। গোঁফ, পরিপাটি মসৃণ দাড়ি। নিখুঁত। আর চেহারা? অরিন্দমই বললেন, ‘হুবহু স্বপন (মজুমদার) স্যারের মতোন।’ এখানেই শেষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে (প্রায় সব বিভাগেরই করিডোরে), নোটিশ বোর্ডের পাশে পয়লা এপ্রিলে (‘এপ্রিল ফুল’ হিসেবে খ্যাত) সিনিয়র ছাত্রছাত্রী, মাস্টারদের নামকরণ ও বিচিত্র কার্টুন এঁকে—সবই মজাচ্ছলে, ছেলেমি—স্বপন মজুমদার হয়ে গেলেন খলিফা হারুন-অর-রশিদ।

বছর তিরিশ আগে প্যারিসে এক রেস্তরাঁয় অরিন্দম ভট্টাচার্যের সঙ্গে দৈবাৎ দেখা। সঙ্গে ফরাসি স্ত্রী, দুই কন্যা। অন্য টেবিল থেকে অরিন্দম এসে পরিচয় ঝালাই করলেন, তুলনামূলক সাহিত্যের স্মৃতিচারণে (ছাত্র থাকাকালীন, পড়েছেন দুই বছর) জানান, কার্টুন অঙ্কন এবং স্বপন মজুমদারের নতুন নামকরণ ওঁরই। আমরাও মাঝেমধ্যে বলতুম, আজ হারুন-অর-রশিদ ইস্ত্রি-করা ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি, ধুতি পরেছেন।

তখনও তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হইনি, স্বপন মজুমদারকে প্রথম দেখি আবু সয়ীদ আইয়ুবের ৫ নং পার্ল রোডে, পার্ক সার্কাসের বাড়িতে। পরিচয় করিয়ে দেন আইয়ুবের স্ত্রী গৌরী আইয়ুব। জানলুম, আইয়ুবের স্নেহভাজন।

আমরা দেখেছি, আইয়ুবের কিছু বইয়ে স্বপন মজুমদারের নাম। বিশেষত বইয়ের প্রুফ দেখায় স্বপনকে স্মরণ করেছেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে।

স্বপন নানা কাজে ব্যস্ত। লেখক। গবেষক। বহু প্রতিষ্ঠানে যুক্ত। নাটকেও নিবেদিত। সুবীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে বিলেতি নাটক, স্বদেশি যাত্রা নিয়ে বই লিখেছেন। এখনও প্রামাণ্য, মূল্যবান গ্রন্থ। গবেষণায় অপরিহার্য।

ছিলেন নাট্যদল বহুরূপীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কিত। শম্ভু মিত্রের ঘনিষ্ঠ। স্নেহসিক্ত। বহুরূপী পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদেও। সম্পাদনায় যুক্ত। ওঁর স্ত্রী নমিতা বহুরূপীর নাটকে অভিনয় করেছেন। নমিতার অভিনীত একটি নাটক দেখেছিলুম। সম্ভবত কুমার রায় পরিচালিত নাটকে। স্মরণ হচ্ছে না নাটকের নাম। পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়। নাটক শেষে স্যারই (স্বপন মজুমদার) পরিচয় করিয়ে দেন। মেকআপ ছাড়াই চমৎকার সুন্দরী।

অধ্যাপনা ব্যতিরেকে স্বপন মজুমদারের নাটকেই প্রেম ছিল বেশি, এ কথা শুনেছি নাট্যজন (নাট্যকার, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) চিত্তরঞ্জন ঘোষের মুখে। দুজনেই নাটকে মশগুল। তো, সখ্যসম্পর্ক অধিক, অধ্যাপনার বাইরে। পোশাকে স্বপন যতটা কেতারদুরস্ত, চিত্তরঞ্জন ততটা নন। একটু ঢিলেঢালা। অতি সাধারণ। এ-ও লক্ষ করেছি চিত্তবাবু ছাত্রছাত্রীর যতটা কাছের, আপন, ঘরোয়া, বন্ধু-মরুব্বি, স্বপনবাবুর দূরত্ব যোজন-যোজন। ছাত্রছাত্রীকে স্নেহ করনে অবশ্যই, ক্লাসের বাইরে কুশলাদি প্রশ্নও, কিন্তু মনে হতো, আপনতায় গভীরতা কম। হতে পারে, নানা কাজে, নানা চিন্তার বলয়ে আবিষ্ট। ক্লাসে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা কে কে নিয়মিত নাটক দেখো?’ এক ছাত্রী বলেন, ‘স্যার, নাটক দেখার টাকা নেই।’ মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা, ‘কোন নাটক দেখতে চাও?’ ছাত্রী লা-জবাব।

আমাদেরই আরেক অধ্যাপক কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত বলছিলেন একবার, ‘স্বপন কূটনীতিকও।’ খোলাসা করেন, ‘ফিজিতে ভারতীয় দূতাবাসে কালচারাল অ্যাটাসি। যদিও পদটি অকূটনৈতিক। সৌজন্যমূলক। সাংস্কৃতিক বিদ্বজনের।’

কলকাতার দূরদর্শন যখন চালু হয়, স্বপন মজুমদার শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের অন্যতম উপদেশকও। পঙ্কজ সাহার কাছে শুনেছি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা, তুলনামূলক সাহিত্য, ইতিহাস বিভাগে বহুমান্য, বহুল খ্যাতিমান অধ্যাপক। ভুলছি না ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিভাগেও। যেমন জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিহাস বিভাগে শিপ্রী সরকার, অমলেন্দু দে, প্রমুখ। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অমিতাভ ভট্টাচার্য তো কিংবদন্তি। ইন্দিরা গান্ধির একান্তজন। সত্তর দশকের কথা বলছি।

ইতিহাসের অধ্যাপককুল ছাত্রছাত্রীর গুরুজন নিশ্চয়, কতটা ‘বন্ধুতুল্য’ বলতে অপারগ। শুনেছি, অমলেন্দু দে বহু ছাত্রছাত্রীর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বাড়িতে যেতেন। বাংলার চিত্তরঞ্জন ঘোষও যেতেন। মহুয়া সিংহের বাড়িতে যেমন। রণজিত কার্লেকার (ইংরেজির অধ্যাপক) তুলনামূলক সাহিত্য, ইংরেজির ছাত্রীদের ইয়ারদোস্ত। বলেন একদিন, ‘জয়েন করো’, রণজিত হয়ে গেলেন বন্ধু।

তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী সুবীর রায়চৌধুরী, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহ, সান্নিধ্য, ঐকান্তিকে যতটা ধন্য, গরিয়ান, আড্ডায়, খোশগল্পে এমনকি পানীয়ে অবিভাজন, বাকি অধ্যাপক নিছকই অধ্যাপক। সীমাহীন দূরত্বে।

তুলনামূলক সাহিত্যের সেই গৌরব নেই, সেই অধ্যাপককুলও নেই। শেষ ছিলেন শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও ছেড়ে বরুণদের প্রতিষ্ঠানে। বাকিরা অনুল্লেখ্য।

তুলনামূলকে যখন পড়তুম, সব অধ্যাপকই ‘বাবু’ (নামের শেষে)। বিভাগীয় প্রধান কবি নরেশ গুহ ‘নরেশবাবু’, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ‘প্রণববাবু’, অমিয় দেব ‘অমিয়বাবু’। স্বপন মজুমদার ‘স্বপনবাবু’। সুবীর, মানবেন্দ্র ‘দা’ (দাদা)। নবনীতা দেবসেন ‘দিদি’।

অনেকেই জানেন, দৈনিক আজকাল-এর দ্বিতীয় পর্যায়ে, গৌরকিশোর ঘোষের সম্পাদনায় পরে স্বপন মজুমদারের নিবিড়তা। নিয়মিত লিখতেন। আগেও লিখতেন। একটি ঘটনা উল্লেখের লোভ হচ্ছে। রবীন্দ্রানুষ্ঠান বার্লিনে। বিশ্বভারতীর উপাচার্য, বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের ডিরেক্টর (স্বপন মজুমদার), পবিত্র সরকার, প্যারিস থেকে গায়িকা শর্মিলা রায় পোমো এসেছেন। অনুষ্ঠান শেষে জমজমাট আড্ডা। স্বপন মজুমদার উপাচার্যকে ‘স্যার’ সম্বোধন করছিলেন। পবিত্রদা এক কোণে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তোর মাস্টার স্বপনের কাণ্ড দেখলি?’ বলি, একদা কূটনৈতিক ছিলেন।

স্বপন মজুমদারের আরো পরিচয়, দে’জ, প্যাপিরাস প্রকাশনের প্রথম দিকের পয়লা উপদেষ্টা। দুই প্রকাশনের রমরমার মূলে তাঁর অবদান। স্যার স্বপন মজুমদারের সঙ্গে শেষ দেখা ২০০৬ সালে। কলেজ স্ট্রিটে। বললেন, ‘চলো কফি হাউজে।’ গেলুম।

তিনি দূর থেকেও আপন।

 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন