X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে জাতীয় চার নেতার পরিচিতি নাম সবই ভুল!

আশরাফুল ইসলাম, মেহেরপুর
০৮ ডিসেম্বর ২০২০, ২২:২৯আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:৪০

মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে প্রথম সরকারের ভাস্কর্য তৈরি হলেও এর পরিচয়লিপিতে ক্রম অনুসরণ করা হয়নি, জাতীয় নেতাদের নামের বানানেও আছে যথেচ্ছ ভুল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার হিসেবে অভিহিত মেহেরপুরের মুজিবনগরে তৈরি করা স্মৃতি কমপ্লেক্সে জাতীয় নেতাদের ভাস্কর্যের পরিচয় তালিকাটি ভুলে ভরা। এখানে জাতীয় নেতাদের যে ভাস্কর্যটি আছে তাতে নেতা আছেন ছয় জন আর সেটির পরিচয়লিপিতে পাঁচ জনের নামের বানান বা পদবিতে আছে ভুল। এছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানের ক্রম অনুসরণে ভুল হয়েছে। ফলে ভাস্কর্যের পরিচিতি অনুযায়ী এখন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী হয়ে আছেন এএইচএম কামারুজ্জামান আর এএইচএম কামারুজ্জামান হয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী! এছাড়াও জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীর নামের বানানেও ভুল আছে। ভুল করা হয়েছে ওই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের নামের বানানে এবং  মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানীর পদবিতেও। শত কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কাজ ৯ বছর আগে শেষ হলেও এই পরিচয়লিপিটি সংশোধনের কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ফলে এই দীর্ঘসময় ধরে মুজিবনগরে আসা দর্শনার্থীরা জাতীয় নেতাদের চিনতে ভুল করছেন আর তাদের নামের বানান জাতিকে দিচ্ছে ভুল বার্তা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার ঐতিহাসিক আমবাগানে প্রথম শপথ গ্রহণ করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই জায়গাটির সেসময়ে নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সরকারের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলেও আগেই তার দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ওই বছরের ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের এই প্রথম সরকার। কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি মেনে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণ করে সেবছরের ১৭ এপ্রিল এই মুজিবনগর আমবাগানে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে এখানে তৈরি করা হয় মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স । এই কমপ্লেক্সের ভেতর স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময় নিয়ে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় বিভিন্ন ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৭ এপ্রিল শপথ নেওয়া মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা। এই মন্ত্রিসভার ভাস্কর্যে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও  এএইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে আরও আছেন ওই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ভাস্কর্যের পরিচয়লিপিটি অত্যন্ত দায়সারাভাবে তৈরি করা হয়েছে। ফলে এখানে যাদের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে তার ধারবাহিকতা নেই পরিচয়লিপিতে। এ কারণে সব কয়জন নেতার মধ্যে সর্বাধিক উচ্চতার কারণে এম. মনসুর আলী আলাদাভাবেই চোখে পড়লেও তার নামটি লেখা হয়েছে সেই অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানের জায়গায়। ফলে এই তাদের দুজনের প্রতিকৃতিতে ক্রম অনুসরণ না করার ভুলে উভয়ের পরিচিতিই পাল্টে গেছে। এএইচএম কামারুজ্জামানের নামের বানানটিও ভুল। কামারুজ্জামানের বদলে লেখা হয়েছে কামরুজ্জামান। আর মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই অস্থায়ী সরকারের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এম. মনসুর আলী। তাঁকে সম্মানসূচক ক্যাপ্টেন উপাধি দেওয়া হলেও তার নামে থাকা ‘এম’ (মোহাম্মদ অর্থে) এই পরিচয়লিপিতে নেই–একজন জাতীয় নেতার পুরো নাম লেখার ক্ষেত্রে এটিও একটি ভুল। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং ন্যস্ত না হওয়া অন্য সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সুবিশাল দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই পরিচয়লিপিতে তার নামটিও বিকৃত বানানে লেখা হয়েছে তাজউদ্দিন আহাম্মদ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানীর নামের সামনে ‘কর্ণেল’ পদবি লেখা হলেও আধুনিক বানানরীতি অনুযায়ী এর বানান হবে ‘কর্নেল’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত ও ঘৃণিত হয়ে আছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তবে মুজিবনগর সরকারে তার উপস্থিতি ও দায়িত্বশীলতা অস্বীকার করার উপায় নাই। সে সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে সারা বিশ্বে স্বাধীন বাংলাদেশের নাম পরিচয় প্রকাশে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। এই ভাস্কর্যে তার প্রতিকৃতি আছে তবে নামের বানানটি ভুল। লেখা হয়েছে খন্দকার মোস্তাক আহম্মদ।   

মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে বেড়াতে আসা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফুল ইসলাম জানান, ‘এই ধরনের মারাত্মক ভুলে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের যারা এই জাতীয় চার নেতার অবয়বের সঙ্গে পরিচিত নন তারা এই ভাস্কর্য দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।’

মেহেরপুরের রাধাকান্তপুরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম মাস্টার জানান, একটা ভাস্কর্যে ছয় জনের প্রতিকৃতি, তার পাঁচ জনেরই নামের বানানে ভুল! যারা এই পরিচয়লিপিটি তৈরি করেছেন তাদের চোখে এসব ভুল ধরা না পড়াটা আক্ষেপের। প্রশাসনও এসব বানান ঠিক আছে কিনা সেদিকে কোনোদিন তাকায়নি মনে হচ্ছে। এত বছর ধরে এমন ভুলগুলো কারও চোখে না পড়াটা ভীষণ দুঃখজনক। আর যদি কারও চোখে পড়েও থাকে তারপরও সংশোধনের কোনও ব্যবস্থা না করাটা আরও হতাশাজনক।

এ বিষয়ে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, ‘এই প্রকল্পটি গণপূর্ত বিভাগ দেখাশোনা করে। তারপরও আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে সংশোধনের জন্য তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী