X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’

সালেক উদ্দিন
১০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:৩০আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:৫২




সালেক উদ্দিন ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এই দিনে কিছু লিখতে হলে স্বাভাবিকভাবেই লেখতে হয় জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের ইতিহাস। লিখতে হয় পৃথিবীর সকল মানুষের সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের কথা। সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ , ব্যক্তি নিরাপত্তা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা লিখতে হয়। সর্বোপরি লিখতে হয় বিশ্ব মানবাধিকারের কথা। তা না লিখে যদি লিখি ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’ তবে কিছুটা বেখাপ্পাই লাগে। তারপরেও এখনকার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মনে হচ্ছে বহুল প্রচলিত এই বাক্যটি বড়বেশি সময় উপযোগী।







গেলো বছর এই দিনে বাংলা ট্রিবিউনে  ‘মানবাধিকার ও রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার অধিকার’ শিরোনামে লিখেছিলাম। লিখেছিলাম পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার কর্তৃক তাদের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ওপর ধর্ষণ নির্যাতন গণহত্যার কারণে দফায় দফায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা সে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথা। সেই লেখায় রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কর্মতৎপরতা স্থান পেয়েছিল। অতি স্বাভাবিক কারণেই স্থান পেয়েছিল রোহিঙ্গাদের এমন বিরাট এক জনগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের মতো একটি দেশের হিমশিম খাওয়ার কথা। মানবাধিকারের দাবিতেই বিশ্ববাসীর মতো আমরাও রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের প্রত্যাশা করেছিলাম, পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূম রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলেছিলাম। আশা পোষণ করেছিলাম যে, জাতিসংঘসহ বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনসমূহ, সর্বোপরি বিশ্ব পরিচালনা করে এমন ক্ষমতাধর দেশগুলোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অসহায় রোহিঙ্গাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠী হয়তো তাদের আবাসভূমি রাখাইনে ফিরে যেতে পারবে।  

শঙ্কামুক্ত ছিলাম না বলেই হবে হয়তো লেখাটির শেষ অংশে উল্লেখ করেছিলাম, ‘বলতে দ্বিধা নেই এই পৃথিবী পরিচালিত হয় গুটিকয়েক শক্তিধর দেশের ইশারায় এবং ইচ্ছায়। সেই রকম কোনও শক্তির হাতছানিতে রাখাইনের রোহিঙ্গারা যদি গণহত্যার বিচার না পায়, যদি শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করেও নাগরিকত্বের গৌরব নিয়ে তারা যদি নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে না পারে, জাতিগত অধিকার ফিরে না পায়, মানবাধিকার নিশ্চিতকল্পে যদি কফি আনান পরিষদের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না হয়, তবে বিশ্ব মানবাধিকার শব্দটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয় বলেই প্রমাণিত হবে।’

আশঙ্কা এবং বাস্তবতা প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে এই মুহূর্তে। আর তাইতো এক বছর পরেও বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের  দিনে এই লেখায় সেই পুরনো প্রসঙ্গটিই নতুন করে টেনে আনতে হলো।

মানুষের রক্তে ভাসমান রাখাইনের  মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত নির্যাতনে জানে বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে বানের পানির স্রোতের মতো পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্ব বিবেকের কাছে  প্রশংসিত হয়েছিল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে মামলা হয়েছিল, ওআইসি সমর্থনে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে  মামলা হয়েছিল।

এত কিছুর পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন  সংক্রান্ত সম্প্রতি জাতিসংঘের এক উদ্যোগে চীনের ভেটো এবং আমাদের তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের ভোটদান থেকে বিরত থাকার ঘটনায় সকল অগ্রগতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। বিষয়টি যে কথা মনে করিয়ে দেয়  তা হলো,  জাতিসংঘ যতই মানবাধিকারের কথা বলুক তারা তাদের পৃষ্ঠপোষক দেশের ইচ্ছার বাইরে পৃথিবীতে কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘন  থামাতে পারেনি। তারা চীনসহ কয়েকটি ভেটোদানের ক্ষমতাধারী দেশের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। তারা এমন একটি নীতি লালন করে যে সারা বিশ্ববাসী মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে চিৎকার করে মরলেও ভেটোদানের ক্ষমতা আছে এমন একটি দেশ যদি ভেটো প্রদান করে তবে তা সেখানেই থেমে যায়। অর্থাৎ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার বিশ্ববাসীর জন্য জাতিসংঘ সেই অভিভাবক যার কোনও ‘মুরোদ’ই নেই।  ‘মুরোদ’ নেই ঠিক না, মুরোদ আছে তারা যাদের ‘পোষ্য’ সেসব দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় পৃথিবীর দুর্বল দেশগুলোর ওপর মানবাধিকারের অপবাদ চাপিয়ে দেওয়ার, তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা রকমের মারাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের। অন্তত জাতিসংঘের অতীত ইতিহাস তাই বলে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ১২ লাখেরও অধিক সংখ্যক রোহিঙ্গা বাস করছে। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এই শরণার্থী রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের ওই এলাকার স্থানীয় অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায়,  স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ও জীবিকা হারাতে বসার উপক্রম হয়, রোহিঙ্গাদের দ্বারা ইয়াবাসহ এলাকায় মাদকের ব্যাপক বিস্তার মোট কথায় সামাজিক অবক্ষয়ের কবলে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আধুনিক জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা দিয়ে ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে। তাদের বসবাসের জন্য  সেখানে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১৪৪০টি বসতঘর তৈরি, রান্নাঘর, পানীয় জলের সুবিধা, নারী পুরুষের জন্য পৃথক শৌচাগারসহ জীবনধারণের সার্বিক সুযোগ সুবিধার সৃষ্টি করা হয়। স্থাপন করা হয় তিনটি মসজিদ, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, ২টি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ইত্যাদি। তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত রাখা হয় নৌবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য, সিসিটিভি সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। খেলাধুলা শরীরচর্চার বিষয় কোনোটাই বাদ যায়নি সেখানকার ব্যবস্থাপনায়।

তারপরও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে জাতিসংঘের আপত্তির শেষ নেই। তাদের ভাবখানা এরকম যে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো মানবাধিকারবহির্ভূত কাজ। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে, মিয়ানমারে শত শত রোহিঙ্গা নর নারীকে উলঙ্গ করে চোখ বেঁধে ব্যায়নট দিয়ে রক্তাক্ত করা, জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্যে দেশের সেনাবাহিনী দিয়ে রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নির্বিচারে গণহত্যা- গণধর্ষণের নরক রচনায়ও কি মানবাধিকার হরণ নয়? মিয়ানমারের অত্যাচারে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা নর-নারী- শিশু বানের জলের মতো বাংলাদেশ আশ্রয় দেওয়ার পর জনবহুল একটি  দেশের এই বিশাল বোঝা অপসারণ করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যর্থতা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না?

জাতিসংঘ নিজের এই ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে যখন বলে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর মানবাধিকারবহির্ভূত কাজ তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সরকারকে বলতে হয়, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের থাকার পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘ ব্যর্থ। তাই ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর নিয়ে তাদের আপত্তি অযৌক্তিক। বলতে হয়, তিন বছরেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা নিতে না পারা জাতিসংঘের মুখে এমন কিছুই মানায় না।’ যথার্থ বলেছে বাংলাদেশ সরকার। তাদের উচিত মানবাধিকারের ভুয়া বুলি আওড়ানো জাতিসংঘের কথা না শুনে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।  
সার্বিক বিবেচনায়  বিশ্ব মানবাধিকার দিবসেও যদি বলি পৃথিবীর সাধারণ জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’ তাহলে খুব বেশি বলা হবে কি? না, অন্তত মানবাধিকারের দায় মেটাতে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা মাথায় নিয়ে গুঁজো হয়ে পড়া আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সেটাই সঠিক। রোহিঙ্গাদের জন্যে আমরা যেটা করছি সেটাই মানবাধিকারের প্রকৃত উদাহরণ।

এবারের বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো বড় বড় বুলি না আওড়ে যদি রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে তবে সেটাই হবে মানবাধিকার দিবসের উল্লেখ করার মতো একটি মন্ত্র।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ