X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘চেতনা’ তুমি কী?

রুমিন ফারহানা
১২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:২৫আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৫০

রুমিন ফারহানা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি আমরা। নানা প্রস্তুতি, আয়োজন আর উত্তেজনা চারদিকে। একটা নতুন দেশের জন্ম, লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগ, সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন। কী ছিল সেই স্বপ্ন?
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দযুগল হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকার থেকে শুরু করে হালের উন্নয়ন এমনকি ভাস্কর্য পর্যন্ত সবকিছুই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে আবৃত। ক্ষমতাসীন দলের যেকোনও কাজের সমর্থন তৈরির ন্যারেটিভে যেমন কাজ করে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ তেমনি বিরোধী দল-মত-চিন্তার মানুষের যেকোনও বক্তব্য যা ক্ষমতাসীন দলের মনঃপূত নয়, তাই হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। গত এক যুগ ধরে সরকারের ভোটারবিহীন নির্বাচন, সীমাহীন দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী দল দমনসহ যেকোনও অপকর্মের মূল রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই চেতনা। সে কারণেই বিষয়টি জানা খুব জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কী? এটা কি ধোয়াটে বায়বীয় অস্পষ্ট কোনও বিষয়? এটা কি বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের একক সম্পত্তি? এটি কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার নাকি নিজ দলের সকল অন্যায্যতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার যুক্তি? 

একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনও বায়বীয় বিষয় নয়, আর তাই নিজ নিজ সুবিধামতো এর যথেচ্ছ ব্যবহার কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মুক্তিযুদ্ধের অপমান। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই চেতনার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। এই কলামের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কিছু অংশ দেখে নেওয়া যাক–  

যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল;
এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল;
এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩ মার্চ শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন;
এবং
যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন;
এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতিবহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; ...

‘…সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি’।...

সুতরাং ঘোষণাপত্র পড়লে কারও বুঝতে না পারার কথা না যে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এই প্রতিটি শব্দ বিশেষভাবে অর্থবহ আর ব্যাখ্যার দাবি রাখে।  

১. সাম্য

ঘোষণাপত্রের ইংরেজি ভার্সনে এই শব্দের স্থলে ‘Equality’ শব্দটি আছে, যদিও আমাদের কেউ কেউ এই শব্দটিকে ‘Equity’ হিসেবে বোঝেন।

‘সাম্য’ আমাদের বলে একটা রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব নাগরিক সিভিল রাইটস (বাক স্বাধীনতা, সংগঠন তৈরি, সভা-সমাবেশ-মিছিল করা, সরকারি দমন-পীড়ন থেকে মুক্ত থাকা, গ্রেফতার হলে নির্যাতিত না হওয়া, ন্যায়বিচার পাওয়া, ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার...ইত্যাদি), সম্পত্তির অধিকার, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করবেন।

২. মানবিক মর্যাদা

‘মর্যাদা’ আমাদের সমাজে খুব পরিচিত একটি শব্দ। এই রাষ্ট্রে এবং সমাজে একেক ব্যক্তি একেক রকম মর্যাদার অধিকারী। মানুষের শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, রাজনৈতিক পরিচয়– এসব সমাজে একেক জনের মর্যাদা তৈরি করে। আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজে এমনকি মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ও মর্যাদার তারতম্য সৃষ্টি করে। একজন নারী এবং পুরুষ এর আর সব দিকে একই অবস্থা থাকলেও একজন নারী এই সমাজে কম মর্যাদাবান হন।

মানবিক মর্যাদা ধারণাটি আন্তর্জাতিকভাবেই তৈরি হয়েছিল মানুষের এইসব আরোপিত মর্যাদাবোধকে সরিয়ে মানুষের নতুন ধরনের ‘মর্যাদা’ সৃষ্টি করা। একজন মানুষ, ‘মানুষ’ শুধুমাত্র এই কারণেই সে সমাজে মর্যাদার অধিকারী। এই মর্যাদা প্রতিটি মানুষের একেবারেই সমান– ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোত্র, পরিবার, আর্থ-সামাজিক/রাজনৈতিক অবস্থান কোনও কিছুর ভিত্তিতেই মানুষের এই মর্যাদার তারতম্য করা যাবে না।

এই ধারণার ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এর প্রথম দু’টি ধারা এরকম–

ধারা ১– সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত।

ধারা ২– এ ঘোষণায় উল্লিখিত স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোনও মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকের‌ই সমান অধিকার থাকবে।

কোনও দেশ বা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সীমানাগত বা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে তার কোনও অধিবাসীর প্রতি কোনোরূপ বৈষম্য করা হবে না; সে দেশ বা ভূখণ্ড স্বাধীন‌ই হোক, হোক অছিভুক্ত, অস্বায়ত্তশাসিত কিংবা সার্বভৌমত্বের অন্য কোনও সীমাবদ্ধতায় বিরাজমান।

৩. সামাজিক ন্যায়বিচার

একটা সত্যিকার উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি কার্যকর সমাজ অস্তিত্বশীল থাকতে হয়। সেই সমাজও রাষ্ট্রীয় অঙ্গ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে মানুষদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করবে। সমাজে বসবাসরত প্রত্যেকটি মানুষের সামাজিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সামাজিক ন্যায়বিচার কিছু বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে। এগুলো হলো–

মানবাধিকার– একটা সমাজে মানবাধিকার শুধু সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে না,সেসব সামাজিকভাবেও নিশ্চিত করতে হবে।

মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা– একটা সমাজে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। এই ক্ষেত্রে মানুষের কোনোরকম পরিচয় কোনোভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং নীতির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা– প্রায় সব সমাজের এক ধরনের নীতি হচ্ছে সমাজে তাদের বক্তব্যই বেশি গুরুত্ব এবং প্রাধান্য পায় যাদের ‘সামাজিক পুঁজি’ বেশি। এতে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। সেটা নিশ্চিত করার জন্য ‘মানবিক মর্যাদা’র আলোকে সব মানুষের ‘ভয়েস’ শোনা এবং সেটার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

ন্যায্যতা– সাধারণভাবে সমাজে সবকিছু সুষমভাবে বণ্টিত হওয়ার প্রবণতা থাকে না। ফলে কিছু মানুষ যেমন এগিয়ে যায়, তেমনি পিছিয়েও পড়ে। তাই সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সমাজকে সবার জন্য ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রকৃত প্রয়োজন অনুধাবন করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। এই লক্ষ্যে সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং প্রান্তিক মানুষদের জন্য নানারকম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সমাজকে নিশ্চিত করতে হবে।

এই সবকিছুকে একসঙ্গে খুব সুন্দরভাবে বলা হয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে। দেখে নেওয়া যাক সেটি– ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা– যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’

প্রশ্ন আসতে পারে, যদি সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে ঘোষণাপত্রের প্রথম পাঁচটি অনুচ্ছেদ কেন এই কলামে যুক্ত করা হলো? এই প্রথম পাঁচটি অনুচ্ছেদ পড়লে এটা বুঝতে কারও বাকি থাকে না যে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর যদি তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার মসৃণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো, তাহলে বাংলাদেশকে অন্তত ওই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো হতো না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জেতার পরেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকদের এই টালবাহানা করাকে ঘোষণাপত্রে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এমনকি অনানুষ্ঠানিকভাবেও স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি, বরং ছয় দফার ভিত্তিতে একটা কনফেডারেশন তৈরি করে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা দূর করার স্বপ্ন দেখিয়ে ভোট চাওয়া হয়েছিল। যেকোনও প্রসঙ্গে ’৭০ সালের নির্বাচনের কথা আসলে আমার আজও অবাক লাগে ইয়াহিয়ার মতো একজন ঘৃণিত সামরিক স্বৈরশাসকের অধীনেও একটা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হয় যেখানে বঞ্চিত-শোষিত পূর্ব পাকিস্তানের কোনও দল ১৬২ টি আসন পেয়ে ব্রুট মেজরিটি হয়! অর্থাৎ ওপরে লিখিত অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্যই হলো গণতন্ত্র এবং জনরায় মেনে নেওয়া, সেটা যাই হোক না কেন।

এই ঘোষণাপত্র পরিষ্কার বলে দেয় যে সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার প্রয়োগ, নিজের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং বিনা প্রতিবাদে সেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে জনরায়কে মেনে নেওয়া এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তা না হলে একটি দেশ ভেঙে নতুন দেশ তৈরি হতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ