X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস: হাসপাতালে এত মৃত্যু কেন?

জাকিয়া আহমেদ
১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০০আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০০

করোনায় মারা যাওয়া এক ব্যক্তির মরদেহ দাফনের কাজ করছেন আল মদিনা যুব ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা। সরকারি হিসাবে করোনায় মৃতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়ালো। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে ৩৪ জনের মৃত্যু শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো সাত হাজার ২০ জনে। শনিবার (১২ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত ৩৪ জনের মধ্যে ৩২ জন মারা গেছেন হাসপাতালে আর দুইজন বাড়িতে।স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যায়, গত একমাসেরও বেশি সময় ধরে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যাই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মৃদু সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে কেউ ভর্তি হচ্ছে না। হাসপাতালে সেসব রোগীরা আসছেন যাদের সংক্রমণ-লক্ষণ তীব্র। যখন একেবারেই ভর্তি না হলে হচ্ছে না তখন মানুষ ভর্তি হচ্ছে। ততদিনে সংক্রমণ তীব্র হচ্ছে আর কোভিডে তীব্র সংক্রমণ থাকলেই মৃত্যু হার বেশি।

দেশে প্রথম গত ৮ মার্চ প্রথম তিনজন করোনাতে আক্রান্ত রোগীর কথা জানায় সরকার। তার ১০ দিন পর গত ১৮ মার্চ করোনাতে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথা জানায় সরকার। এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন চার লাখ ৮৯ হাজার ১৭৮ জন।

সংক্রমণের হার আগস্টের পর থেকে স্থিতিশীল হলেও সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে তা ওঠানামার মধ্যেই আছে। এর আগে মে মাসের পর করোনার সংক্রমণের হার অধিক মাত্রায় বাড়তে থাকে। একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণের হার ৩১ শতাংশ দাঁড়ায়। এরপর ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও তা কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি আসে। কিন্তু বর্তমানে তা আবারও ১৬ শতাংশের কাছাকাছি। অক্টোবরের প্রথমে সংক্রমণের হার অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত ছিল ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এরপর অক্টোবরের শেষে তা দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫০-তে। নভেম্বরের শুরুতে হার ছিল ১৩ দশমিক ৪৭ এবং শেষে হার ১৪ দশমিক ৭৯।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনা সংক্রমণের পর বিশ্বজুড়েই করোনাতে আক্রান্ত বাড়তে থাকে। এর প্রেক্ষিতে গত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারি ঘোষণা করে। বিশ্বজুড়ে নানা দেশে লকডাউনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, কয়েকটি জায়গা লকডাউন ঘোষণা করে সরকার।

দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর দিকে ধীরে ধীরে হলেও মে মাসের মাঝামাঝিতে এসে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে, জুনে এসে তার অবনতি হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মৃত্যু। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, সেটা তুলে নেওয়া হয় ৩১ মে।তারপর থেকেই করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে, ঠেকানো যায়নি এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

করোনাতে শূন্য মৃত্যু লক্ষ্যমাত্রা রেখে কাজ করা দরকার মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাতে কেন এবং ঠিক কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যু হচ্ছে তার পর্যালোচনা দরকার, তাতে অন্তত কিছু মৃত্যু কমানো সম্ভব হতো বা হবে। একইসঙ্গে মৃত্যু কমানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠন করা পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি করোনাতে মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে বলেছিল, করোনাতে শূন্য মৃত্যুর টার্গেট নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এজন্য গত ১৭ জুন তারা একটি লিখিত প্রতিবেদন দেন, যেখানে কাজটি কীভাবে করতে হবে তার কিছু দিক-নির্দেশনা ছিল।

করোনাতে মৃত্যু নিয়ে কাজ করে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এ হাসপাতালের ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ৩০০ পার হয়েছে। কিন্তু এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২০২ জনের মৃত্যু নিয়ে তারা বিশ্লেষণ করে। সেখানে দেখা যায়, নারী ৫৩ জন আর পুরুষ ১৪৯ জন। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগ পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। এছাড়াও গৃহবধূ ছিলেন ৪২ শতাংশ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারী ছিলেন ২২ শতাংশ, বাকিরা ছিলেন অন্যান্য পেশার।

এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ ছিলেন ৬১ থেকে ৭০ বছরের বয়সীরা, ৫৮ শতাংশ ছিলেন ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সের আর ৭০ থেকে ৮০ ছিল ২৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ ছিল ২২ শতাংশ আর ৪০ বছরের নিচে ছিলেন বাকিরা। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে নারী ছিলেন ৫১ বয়স থেকে ৬০ বছর বয়সীরা ছিলেন বেশি।কিন্তু পুরুষ মারা গেছেন ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে।

হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, নারীরা তুলনামূলকভাবে কম বয়সে মারা গেছেন করোনায়, আমাদের দেশে যদিও নারীদের গড় আয়ু বেশি কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক আমাদের স্টাডিতে নারীদের ৫১ থেকে ৬০ বছরের নারীদের মৃত্যু বেশি পাওয়া গেছে।

আর কোমরবিডিটি অর্থাৎ অন্যান্য জটিল রোগের আক্রান্তদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ছিল উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস। ১৩১ জনের উচ্চ রক্তচাপ, ১২৫ জনের ডায়াবেটিস ছিল, সিকেডি অর্থাৎ, হৃদরোগ আর তারপর ছিল অ্যাজমা। শ্বাসকষ্ট নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছিলেন এই হাসপাতালে, তারপর জ্বর-কাশি, ডায়রিয়া নিয়ে রোগীরা এসেছেন।

বেশিরভাগ রোগী মারা গিয়েছেন শূন্য দিন অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই দিনের ভেতরে। অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার ভেতরেই বেশিরভাগ রোগী মারা গেছেন—জানান অধ্যাপক ডা. রুবিনা ইয়াসমিন। তাদের মধ্যে ২৫ জন মারা গেছেন ‘জিরো আওয়ারে’ অর্থাৎ হাসপাতালে আসার পরই যোগ করেন তিনি। আর এর বড় কারণ হিসেবে রোগীরা হাসপাতালে না আসা, স্বীকার না করার মতো কারণগুলো রয়েছে বলেন অধ্যাপক রুবিনা ইয়াসমিন। তবে এখন এই ট্রেন্ড কমেছে। আর যারা মারা গিয়েছেন তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে একইসঙ্গে আক্রান্তদের সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৮৫ জন।

জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন এখন মৃদু সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে কেউ ভর্তি হচ্ছে না। হাসপাতালে রোগীরা আসছেই যাদের সংক্রমণ-লক্ষণ তীব্র। আর কোভিড তীব্র সংক্রমণ থাকলেই মৃত্যু হার বেশি। কারণ মানুষ এখন আর বাধ্য না হলে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না। এজন্য যারা মারা যাচ্ছেন, তারা হাসপাতালেই মারা যাচ্ছেন।

একইসঙ্গে বৃদ্ধ এবং অন্যান্য রোগে যারা আগে থেকে আক্রান্ত করোনাতে তাদের মৃত্যুহার বেশি। আর শীতের দিনে হাঁপানি, ধুলার জন্য অ্যালার্জিসহ নানা সমস্যা বেড়ে যায়। একইসঙ্গে করোনাতে আক্রান্ত হলে তাতে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতে করে লক্ষণ তীব্র হয়ে যায়। মানুষ আর এখন করোনাতে আক্রান্ত হলেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না, যার কারণে হাসপাতালের বেড খালি থাকলেও মৃত্যুর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারাই মারা যাচ্ছেন বেশি—বলেন ডা. জাহিদুর রহমান।

হাসপাতালে কেন মৃত্যু বাড়লো জানতে চাইলে পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাড়িতে থেকে যারা চিকিৎসা নেন তাদের লক্ষণ-উপসর্গ অতিরিক্ত হয় না বা অতিরিক্ত হবার মতো অবস্থা রোগীরা বুঝতেই পারে না।

যার কারণে আমাদের রিকমেন্ডশন ছিল, বাড়িতে রোগীদের ম্যানেজমেন্টের একটা গাইডলাইন থাকা দরকার। কিন্তু তিন থেকে চার দিনের মতো জ্বর থাকছেই, জ্বরের সঙ্গে কাশি নাও থাকতে পারে, কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হলে আর অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের সে রোগ—যেমন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া—এ তিনটি লক্ষণের যে কোনও একটি দেখা দিলেই বাড়িতে থাকা উচিত না। এটা সরকার করলো না, সরকার মানুষের ওপরে ছেড়ে দিলো, কিন্তু এটা করা উচিত ছিল। যার কারণে রোগী হাসপাতালে আসছে একেবারে শেষ সময়ে কিন্তু সেসময় আর তাকে ফেরানোর পথ থাকে না।  কিন্তু শুরুতে যদি হাসপাতালে আসতো তাহলে এই রোগীদের কাউকে কাউকে হয়তো বাঁচানো যেত।

হাসপাতালে আসা রোগীদের ভেতরে কেন এত মৃত্যু হচ্ছে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন হাসপাতালে যাচ্ছে সবাই—এটা একদিক দিয়ে ভালো দিক মন্তব্য করে বলেন, বাড়িতে মৃত্যুবরণ করা বরং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য কৃতিত্ব নয়। তবে হাসপাতালেও মৃত্যু সংখ্যা আরও কমানো যাবে যদি সবাই সময়মতো হাসপাতালে যায়।

তবে প্রতিদিন যত সংক্রমিত হবে তাদের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যোগাযোগ করতে হবে।আইইডিসিআর এটা করছে কিন্তু জনবল কম থাকার কারণে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না—বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, রোগীদের আগে থেকেই ফলো আপে রাখলে তাদেরকে পরামর্শ দেওয়া যায়, ঝুঁকিপূর্ণদের হাসপাতালে যেতে হবে আগে। তারও বড় কথা হচ্ছে, সংক্রমণ যত কমানো যাবে, ততোই মৃত্যুহার কমবে। সংক্রমণ কমানোর জন্য আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশন একেবারেই ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। এটা কেবল সাধারণ মানুষের বিষয় নয়, কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের উদ্যোগের বিষয়।

তিনি বলেন, বিমানবন্দরে আসা বিদেশযাত্রীদের নিয়ে যত্নবান হলেও দেশের ভেতরে যারা সংক্রমিত হচ্ছেন তাদেরকে আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন করা, সোশ্যাল সার্পোটসহ খোঁজখবর নেওয়ার দিকেও আরও যত্নবান এবং মনোযোগী হতে হবে। কারণ, সংক্রমণ বেড়ে গেলে মৃতের সংখ্যা বাড়বে।

 

/এমআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন