X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শহিদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু

বাশার খান
১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:০০আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:০২

শহিদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে বেদনার দিন। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালির আলোর পথের দিশারী শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, সাংবাদিক ও লেখকসহ পেশাজীবীদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর-আল শামস বাহিনী দ্বারা সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুধু ১৪ ডিসেম্বরই নয়, এটি ২৫ মার্চ রাতে শুরু করে পুরো নয় মাসব্যাপী চালানো হয়। চূড়ান্ত আঘাতটি ছিলো বিজয়ের আগমুহূর্তে, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার নীল নকশা ও পরিকল্পনাপ্রসূত এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঢাকার বাইরের বুদ্ধিজীবীরাও, বিশেষ করে জেলা ও মহকুমার শিক্ষকরা। সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে বাঙালিদের মেরুদণ্ড যাতে শক্ত ভীতের উপর দাঁড়াতে না পারে সেজন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন অসংখ্য শিক্ষককে হত্যা করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল বাসস-এর বরাত দিয়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮৬৬ জন শিক্ষককে হত্যা করে। পঙ্গু করে দেওয়া হয় ২১ জন শিক্ষককে।

শহিদ বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে স্বাধীনতা পরবর্তী স্ব-স্ব খাতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারতেন। এটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সত্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি ব্যহত করার জন্যই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়।

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও দেশ গঠনে তাঁদের অভাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি গণবাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘...বর্বর হানাদার শত্রুরা আমাদের সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করার জঘন্য প্রচেষ্টায় মেতেছিল। যেসব মনীষীরা আমাদের সমাজের উন্নতির পথ নির্দেশ করতে পারতেন সেইসব বুদ্ধিজীবী এবং দক্ষ জনশক্তিকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমরা অনেক অমূল্য প্রাণ হারিয়েছি। শুধু এই বিরাট ক্ষতি পূরণ করলেই হবে না, উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের নয়া দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।’ (সূত্র: ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পাদিত, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, পৃষ্ঠা—২৫)

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ-পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারানির্যাতনও ভোগ করেছেন। তাঁদের কারো কারো সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বুদ্ধিজীবীদের কেউ আবার বঙ্গবন্ধুর সহপাঠীও ছিলেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের এই অনবদ্য অবদানের কথা বঙ্গবন্ধুর স্মরণ করেন শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং আবেগঘন ভাষায়। ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর মীরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি আজো আমার মনে পড়ে। তাঁদের চেহারা আমার চোখের সামনে ভাসে। তাঁদের অনেকের সাথেই আমি পড়েছি। অনেকের সাথে আমি দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলাম। তাঁদের লেখা আমি পড়তাম। রাজনীতিতে অনেকে আমাকে সাহায্য করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদের লেখনী দিয়ে তাঁরা বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পাক দস্যুদের কারাগার থেকে বেরিয়ে আমি আর তাঁদেরকে দেখতে পাইনি।’ (দৈনিক বাংলা, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২)

শহিদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেমন মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে অত্যন্ত নৃশংসভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল তেমনি দস্যু বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বুদ্ধিজীবীদেরকেও হত্যা করেছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। ন্যাক্কারজনক ওই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোনো সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজে কল্পনাও করা যায় না। তাদের এই নৃসংশতা হার মানায় বন্য হায়েনার আক্রমণকেও। বুদ্ধিজীবীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...ইহারা ডাক্তারের হৃদপিণ্ড টেনে বের করে, সাংবাদিকের হাত কেটে ফেলে, ইঞ্জিনিয়ারের মগজ বের করে হত্যা করে। এমন নৃশংভাবে মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার ইতিহাসে নেই। (সূত্র: ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২) বক্তৃতাকালে সেদিন অঝোরে কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর আবেগময় প্রকাশকে ইত্তেফাকে তুলে ধরা হয় এভাবে, ‘...বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার সময় তাঁহার কণ্ঠ কান্নায় স্তব্ধ হইয়া যাইতেছিল এবং গণ্ডদেশ দিয়া অফুরন্ত অশ্রুধারা বহিতেছিল।’

নৃশংসতার ধরন নিয়ে আমি বীরাঙ্গনা বলছি গ্রন্থের লেখক এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী পরিবার ও সমাজচ্যুত বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের কাজে যুক্ত অন্যতম ড. নীলিমা ইব্রাহীমের মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, ‘...শুধু হত্যাকর্ম নয়, কত বীভৎস্য পাশবিকতার সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে তা শুধু আমাদের ঘৃণা নয়, মানব চরিত্র সম্পর্কেও সন্দিহান করে তোলে। যারা একবারে গুলিতে নিহত হয়েছে তারা ভাগ্যবান। কারও দেহ থেকে রক্ত শোষণ করে জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিয়ে তাঁকে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। কারও চোখ তুলে নেয়া হয়েছে, কারও বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে নেয়া হয়েছে—এর বর্ণনা দিতে হলে মানব ইতিহাস কলঙ্কিত হবে। মানুষের মানব পরিচয় মুছে যাবে।’ (বাংলার বাণী, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২)

শহিদ বুদ্ধিজীবীরা লেখনী দিয়ে লড়াই করেছেন। চেয়েছেন বাঙালিদের অধিকার। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ তথা স্বাধীন বাংলাদেশ। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যে আদর্শের জন্যে জীবন দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে না। যতদিন বাংলা মানুষ পেট পুরে খেতে না পারবে, দেশ থেকে অত্যাচার-অবিচার দূর না হবে, আর শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম না হবে, ততদিন শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে না।’ (সূত্র : দৈনিক বাংলা, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২)

শহিদ বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের নিজ নিজ পেশায় ছিলেন আলোকবর্তিকা। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশগড়ায় তাঁরা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারতেন। দেশ গঠনে তরুণ-যুবাদের নতুন উদ্যমে তৈরি করতে পরামর্শ দিতে পারতেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এবং তাঁদের অভাব বঙ্গবন্ধুর মনে কতটা ক্ষত তৈরি করেছিল—তা অনুমান করা যায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় ভাষায় ও আবেগে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু আবেগঘনভাবে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি, শহিদদের স্বজনদের ধরে অঝোরে কেঁদেছিলেন।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মোহনায় শতাধিক পাইলট তিমি আটক
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মোহনায় শতাধিক পাইলট তিমি আটক
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি