X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরে কোথায় ছিলেন আজকের ধর্মীয় নেতারা?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:৪০আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:২২

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের মনোবল ভেঙে পড়ে। নিশ্চিত পরাজয় জেনে তারা আরও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বিভিন্ন স্থান থেকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারদের ধরে নিয়ে যায়। পরিকল্পিতভাবে বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী অনেক চিন্তাবিদকে তাদের বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান, স্বনামধন্য শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক তথা নানা পেশার পেশাজীবী। বিজয়ের প্রাক্কালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির ওই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর মুক্তিযোদ্ধারা রায়ের বাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের হাতে শহীদ বুদ্ধিজীবী অনেকের দেহাবশেষ খুঁজে পান। অনেক বুদ্ধিজীবীর দেহাবশেষ আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ সুন্দর পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য তারা হারিয়ে গেছেন।
প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে। তবে ১৪ ডিসেম্বরই কেবল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় বিষয়টি এমন নয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দিতে ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে সুপরিকল্পিতভাবে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। হত্যা করা হয় সম্ভাবনাময় ছাত্র, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের।
বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ। শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নয়; ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তারা অংশগ্রহণ করেন। তাদের লেখনী, কবিতা, গান, বক্তৃতা-বিবৃতি আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রেরণা জুগিয়েছিল সাধারণ মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসও তারা ছিলেন সমান সক্রিয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে তারা নতুন সৃষ্টিতে মাতোয়ারা হন। অনেক বুদ্ধিজীবীই দেশের মধ্যে অবস্থান করলেও নামে ছদ্মনামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য লেখেন বহু কবিতা, গান, কথিকা। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ ও রচনার কারণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওই অনুষ্ঠানমালাই সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা জোগায়।
দেশের ভেতরে অবস্থানকারী বুদ্ধিজীবীরা যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, অস্ত্র ও আশ্রয় প্রদান করে সাহায্য-সহযোগিতা করেন, তেমনই প্রবাসে অবস্থানকারী বুদ্ধিজীবীরাও প্রবাসী সরকারের নানা কাজে নিযুক্ত হন। তারা বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রচার মাধ্যমকে সচল রাখার জন্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, রেডিওতে বিভিন্ন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচার, প্রবাসী সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তারা পূর্ব বাংলা বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ, লেখক শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি প্রভৃতি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও অব্যাহত মিথ্যাচারের বিরুদ্ধেও তারা প্রচারণা চালান। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি যৌথভাবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে ‘বাংলাদেশ: দ্য ট্রুথ’ গ্রন্থ প্রকাশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
একাত্তরের জুনে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, নাট্যকার, চারু ও কারু শিল্পীরা মিলে ‘দ্য বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অফ দ্য ইনটেলিজেন্স’ গঠন করেন। ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে কাজ করেন। লন্ডনে অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে নিরলসভাবে কাজ করেন।
অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র লড়াইয়ের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের প্রচার-প্রচারণা পাকিস্তানিদের ওপর ছিল এক চরম আঘাত। বুদ্ধিজীবীদের প্রচার-প্রচারণার ফলে দেশে ও দেশের বাইরের জনমত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চলে যায়। এতদিন পাকিস্তানিরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করছে বলে যে প্রচারণা চালায় তার মুখোশ খুলে যায়। পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র দেশ-বিদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদেরও তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। হত্যা করে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাহিত্যিক সেলিনা পারভীনসহ এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে। বুদ্ধিজীবী তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা জায়েজ ফতোয়া দেয় এ দেশেরই অনেক ধর্মীয় নেতাসহ কিছু আলেম। যদিও আল কোরআনের সুরা মায়েদাহর ৩২ নম্বর আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘যদি কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে।’ ইসলাম ধর্মের নামে ফতোয়াবাজিতে ১৯৭১ সালে আল কোরআনের উপর্যুক্ত নির্দেশ উপেক্ষিত হয়েছিল বাংলাদেশে। এ দেশের ইসলামপন্থীদের প্রায় সবাই আল কোরআনের ওই আয়াত উপেক্ষা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে ওঠে। ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেও তা ছিল ইসলাম ধর্ম ও আল কোরআনের বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ওই বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে জিহাদি জোশে পাকিস্তানিদের সহযোগী হয় একাত্তরে। অনেকে সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা না করলেও তারা ছিলেন ‘নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে’। তাই সেদিন আল কোরআনের বিধান লঙ্ঘন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠলেও আলেম-ওলামাদের কাউকে ইসলাম ধর্মের ওই বিধান লঙ্ঘন করার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রকৃত ইসলামের বিধান তুলে ধরে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ইসলাম ধর্মের বিধান লঙ্ঘন করে যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের বিচারের দাবিতে তারা ছিলেন নীরব। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলাম ধর্মের বিধান লঙ্ঘন করে বুদ্ধিজীবীসহ এ দেশের নিরস্ত্র নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তা তুলে ধরে ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের সহযোগীদের বিচারের দাবিতে স্বাধীন বাংলাদেশে কখনও ইসলামপন্থীরা কোনও ভূমিকা রাখেননি। বরং এক্ষেত্রেও তারা একাত্তরের মতো ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বারবার যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় তৎপর হয়েছেন।
১৯৭১ সালে যদি এ দেশের ইসলামপন্থীরা সম্মিলিতভাবে উচ্চকণ্ঠে বলতেন, ইসলামের নামে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা নাজায়েজ। পাপের কাজ। তাহলে হয়তো ত্রিশ লক্ষ সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ হতে হতো না। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হারাতে হতো না। বাংলাদেশের কিছু আলেম ওলামাদের সেই দিনের নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা অথবা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার কারণে পাকিস্তানিরা সাহস পেয়েছিল বুদ্ধিজীবীসহ নির্বিচারে সাধারণ মানুষের হত্যা করার।
মনে প্রশ্ন জাগে, আজ যারা জিহাদি জোশ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য হয়নি বলে গলাবাজি, ফতোয়াবাজি করছেন- একাত্তরে তারা কোথায় ছিলেন? ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলেও তারা কেন নীরব ছিলেন? তাই আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, একাত্তর সালে যারা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের ইসলাম ধর্মের বিধান লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করেননি। একাত্তরে ইসলাম ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মাঠে নামেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের ফতোয়াবাজির অধিকার নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে সেই ফতোয়া দেবেন এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ