X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বুদ্ধিজীবী দিবসের চেতনা

লীনা পারভীন
১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৫৯আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:০১

লীনা পারভীন ফেসবুকে শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন, বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে কলাম লেখা কি কেবলই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদেরই দায়? অন্যরা কেন লেখে না?
তার এই পোস্টটি আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। আসলেই তো! পত্রপত্রিকায় সবকিছু নিয়েই অনেকের লেখা আসে, এমনকি ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ নিয়েও প্রচুর লেখা ছাপা হয়, কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর নিয়ে বেশিরভাগ লেখাই আসে স্মৃতিচারণমূলক, যা লিখে থাকে সেইসব শহীদের সন্তানেরা, যাদের পিতা বা মাতাকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। কী ছিল সেইসব বুদ্ধিজীবীর অন্যায়? এই তো যে—তারা বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন ছিলেন? নিজের দেশকে ভালোবাসা কি অন্যায়? নিজের দেশের মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে শামিল থাকা কি অপরাধ? তাহলে কেন তাদেরকে সেদিন এতটা অত্যাচারের মধ‌্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল?

আর অল্প কিছুদিন পরেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবো। একই বছর হতে যাচ্ছে জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষেরও উৎসব। বছরব্যাপী যে কর্মযজ্ঞ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটি আজ ব্যাহত মরণঘাতী এক ভাইরাসের কারণে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শপথকে কি আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি? ভুলে যেতে কি পারি জাতির সেইসব সন্তানকে, যাদের বিনা অপরাধে গুলি করে, অত্যাচার করে মেরে ফেলেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী?

ক্ষমা করে দেবো কি পাকিস্তানিদের সাহায্য করা এদেশের সেইসব এজেন্ট রাজাকার আলবদরকে?

আমি এখানে যুদ্ধের গল্প শুনতে বা শুনাতে আসিনি। আমার বিবেক আজকে আমাকে প্রশ্ন করছে কতটা সফল আমরা বুদ্ধিজীবীদের চেনাতে? এই প্রজন্ম কি আসলেই জানে—কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর? কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কবি, লেখক, চলচ্চিত্রকার, সংগীতকার, চিকিৎসক, সাহিত্যিকদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা?

মূলত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই কালরাত থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা বিভিন্নভাবে এই জাতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল দিনটি আমাদের ইতিহাসের পাতায় কালরাত হিসেবে চিহ্নিত, কারণ সেই রাতে পাকিস্তানি সেনারা তাদের এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যদের সহায়তায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিনা উসকানিতেই। এলোপাতাড়ি গুলিতে হত্যা করেছিল হাজারো নিরীহ মানুষকে। তারপর জেগে উঠলো বীর বাঙালি। প্রতিরোধ গড়ে তুললো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের লড়াই, ময়দানের লড়াইয়ে অংশ নিলো আনকোরা সাধারণ মানুষেরা যাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, কিন্তু ছিল বুকভরা দেশপ্রেম আর দেশকে শত্রুমুক্ত করার কঠিন প্রত্যয়।

গোটা নয় মাসের যুদ্ধে তারা এদেশকে মেধা ও সংস্কৃতির দিক থেকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। জাতিসত্তাকে আঘাত হানার জন্য চালিয়ে ছিল নারী ধর্ষণের মতো অপরাধ। জেনোসাইডের সংজ্ঞা আমরা অনেকেই জানি না। শাব্দিক অর্থে জেনোসাইডকে আমরা গণহত্যা বলছি, কিন্তু ১৯৭১ সালে কেবল লাখো মানুষের প্রাণই কেড়ে নেওয়া হয়নি। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল আমাদের পরিচয়, আঘাত হেনেছিল আমাদের সংস্কৃতির ওপর। মেধাশূন্য করে দিতে চেয়েছিল এই জাতিকে, যাতে করে ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারি আমরা। নয় মাস সময়টা খুব লম্বা না হলেও পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা ছিল অনেক লম্বা বা সুদূরপ্রসারী।

শেষ মুহূর্তে যখন তারা বুঝতে পারলো যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঠেকানো আর সম্ভব নয়, তখনই চালিয়েছিল তাদের ঘৃণ‌্য অস্ত্রটি। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করবে যার মাথার খোল থাকবে, কিন্তু মগজ থাকবে না। যার অবয়ব থাকবে, কিন্তু তাতে প্রাণ থাকবে না, নতুন সৃষ্টি থাকবে না। থাকবে না বেড়ে ওঠার স্পৃহা, জন্মাবে না এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

এইতো ছিল সেদিনের সেই পরিকল্পনা। ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় পেলাম, কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর নিয়ে গেলো আমাদের এই জাতির অনেক সূর্য সন্তানদের। পরিবারগুলোকে করে দিলো পিতৃ, মাতৃহীন। অসহায় সন্তানেরা জানলোও না তাদের পিতা/মাতাদের কেন কেড়ে নেওয়া হলো? বুদ্ধিজীবীরা কেউই কিন্তু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, মিছিলের মুখ ছিলেন না অনেকে। সম্মুখ যুদ্ধেও অনেকে অংশ নেননি। অথচ স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে হত্যা করেছিল শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক এমন অনেককেই।

এই যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা, সেদিন তাদের সহায়তাকারী অনেকেই পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের মসনদে বসেছে বিভিন্নভাবে। দেশের প্রধান থেকে মন্ত্রী, এমপি হয়েছে অনেকেই। কারা ছিল সেইসব চক্রান্তকারীর দল? কাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে খুনিরা ক্ষমতায় এসেছিল। কারা খুন করেছিল আমাদের জাতির পিতাকে? কী লাভ ছিল তাদের? এসব প্রশ্নের মাঝেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের অধ্যায়। নতুন প্রজন্মের মাঝে এই অধ্যায়গুলোকে উন্মোচিত করতে হবে কোনোরকম লুকোচুরি ছাড়াই।

তৎকালীন বিএনপি ও এরশাদ সরকারের আমলে আমাদের বুদ্ধীজীবীদের পরিবারগুলোকে কেন সরকারি বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, কেন তাদেরকে রাস্তায় বসানো হয়েছিল–সামনে আসা উচিত সেইসব আলোচনাও।

তাই, বুদ্ধিজীবী দিবসে কেবল স্মৃতিচারণেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। আলোচনায় আসতে হবে ইতিহাসের সবটাই। ’৭৫ পরবর্তী প্রতিটি শাসনামলে কেমন করে মুক্তিযুদ্ধকে আলোচনায় আনা হয়েছিল, কারা বিকৃত ইতিহাস রচনাকারী আর কারা ইতিহাসকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেছে, সেইসব আলোচনাকে যদি আমরা আলোতে না আনি তাহলে অসম্পূর্ণ থাকবে আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করার চেষ্টা।

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস অমর হোক।

 

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ