X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘নতুন রাজাকার’: সৌহার্দের বিনিময়ে ঔদ্ধত্য

আনিস আলমগীর
১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:২২আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:২৪

আনিস আলমগীর তালেবানরা যখন আফগান যুদ্ধকালে আমাকে গ্রেফতার করেছিল—তাদের প্রশ্ন ছিল আমি কান্দাহারে কেন এসেছি। জবাবে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। তোমাদের ওপর আমেরিকানরা যে অন্যায় যুদ্ধ চালাচ্ছে, বাংলাদেশিরা তাতে ক্ষুব্ধ, আমি তোমাদের খবর লিখতে এসেছি।
কমান্ডারকে যখন ইংরেজি থেকে পশতুন ভাষায় ট্রান্সলেট করে জানানো হলো এ কথা–সে আমাকে অবাক করে জানতে চাইলো, বাংলাদেশ কোথায়? আমার বক্তব্যের সত্যতা নিয়েও তার প্রশ্ন। তার সহকর্মীরা তাকে বাংলাদেশ চেনালো, আর একজন সাক্ষী দিলো—হ্যাঁ পাকিস্তানি পত্রিকায় ছবি দেখেছি বাংলাদেশের মোল্লারা আমাদের পক্ষে মিছিল করেছে।
ঘটনাটি আমাকে একটি শিক্ষা দিয়েছিল যে, সমাজের কোনও ক্ষুদ্র মতও দমন করার প্রয়োজন নেই। সবার মত প্রকাশের অধিকার থাকা একটি সুস্থ সমাজের জন্য জরুরি। কোনও একটি ইসলামি গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি মিছিল আমার বন্দিদশা থেকে মুক্তিতে সহায়তা করেছে, অথচ আমি আজও জানি না তারা কারা। সে কারণে আমি কারও মতকে দমন করতে বলি না কখনও। আমাদের মৌলবাদী গোষ্ঠী যেমন তাদের মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জঙ্গি হয়ে ওঠে, তারচেয়ে কোনও অংশে আমি কম দেখিনি আমার প্রগতিশীল বন্ধুদের মৌলবাদী আচরণ করতে।

হাইকোর্টের সামনে বাংলাদেশের মানচিত্রকে ঢেকে ভাস্কর্যের নামে কুৎসিত থেমিসের মূর্তি স্থাপনের সময়ও আমি এটা দেখিছি। আমি তখন দৈনিক মানবকণ্ঠের সম্পাদক। আমিই প্রথম কলাম লিখেছিলাম অহেতুক বিতর্ক এড়াতে ওই কুৎসিত মূর্তি সরাতে—যে ভাস্কর্যের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক নেই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তখন টিটকারি করেছিল—আমি ‘হেফাজতি’ হয়ে গেছি কিনা। হেফাজত বিরোধিতা করেছে বলে আমাকে কুৎসিত এক ভাস্কর্যের পক্ষ নিতে হবে—এর নামতো প্রগতিশীলতা নয়। আসলে আমাদের কোনও গোষ্ঠীরই ধৈর্য নেই–পরের মতটি শোনার, পছন্দ না হলে এড়িয়ে যাওয়ার। আমরা আছি তুমি ‘হ্যাঁ’ তাই আমি ‘না’- নীতিতে।

দু’সপ্তাহ আগে বাংলা ট্রিবিউনে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য এবং ওলামায়ে কেরাম’ শীর্ষক কলামে বলেছিলাম বঙ্গবন্ধুর জীবনে এমন কাজ করে গেছেন তার অমরত্বকে রক্ষা করার জন্য ভাস্কর্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যদি মনে করে জাতির পিতার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভের জন্য তার নান্দনিক একটি ভাস্কর্য থাকা দরকার, তখন সেটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করাটা বেদনাদায়ক ঘটনা। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা পর্যন্ত এখন একজোট হয়ে সে কথা বলেছেন—বঙ্গবন্ধুকে অপমান করা মানে সংবিধানকে অবহেলা করা, কারণ সাংবিধানিকভাবে তিনি এই রাষ্ট্রের জন্মদাতা এবং জাতির পিতা। ২৯ ক্যাডারের সমন্বয়ে গড়া সরকারি কর্মকর্তারা সাফ বলে দিয়েছেন, জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুকে তারা অসম্মান করতে দেবেন না। আমি ধন্যবাদ জানাই তাদের প্রত্যেককে, এটাই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।

যারা বিরোধিতা করছেন তাদের উদ্দেশে আবারও বলি—মেনে নিলাম ইসলামে ভাস্কর্য নিষিদ্ধ। আপনারা আপনাদের ঈমানি দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার রাষ্ট্র সেটা মানবে কি মানবে না—রাষ্ট্রের কর্তাদের দায়। আখেরাতে তারাই জবাব দেবেন। ঘটনা এখানেই শেষ করতে পারি আমরা। মনে রাখতে হবে এটা আখেরি জামানা। আলেম-ওলামারা একসময় নারী নেতৃত্ব হারাম বলেছেন, কালক্রমে মেনে নিয়েছেন। আখেরি জামানায় এমন অনেক কিছুর সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে, ভাস্কর্যসহ অনেক কিছু মেনে নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত পরিহার করতে হবে ইসলামপন্থীদের।

কিন্তু আমরা কী দেখছি! মাওলানারা হুমকি দিচ্ছেন এখন না পারলেও দেশে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলবেন। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ১৪০ মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থিত জনবিরল বামিয়ান উপত্যকায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ মিটার উচ্চতায় একটি পর্বতগাত্রে খোদাই করা প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো দুটি বুদ্ধমূর্তি ভেঙে তালেবানরা তাদের দেশ-জাতিকে কী দিয়েছে, বিশ্বকে কী বার্তা দিয়েছে—সেই শিক্ষাতো আমাদের চোখের সামনে আছে। তাহলে এসব আস্ফালনের কী মূল্য আছে!

বাংলাদেশের আলেম সমাজ দীর্ঘদিন সমাজে বঞ্চিত ছিল। ইসলামি শিক্ষা একটা পশ্চাৎপদ শিক্ষা বলে সব শ্রেণির মানুষের কাছে মর্যাদা পায়নি—এখনও এই শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ সমাজে সুবিধাবঞ্চিত, হতদরিদ্র শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১৪ লাখ এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে উপেক্ষা না করে তাদেরকে দেশের মূল স্রোতে আনার ব্যবস্থা করলেন, যাতে তারাও যুগোপযোগী শিক্ষা পায়, শিক্ষা শেষে সার্টিফিকেট কাজে লাগাতে পারে। হেফাজতের ব্যানারে ইসলাম রক্ষার নামে শেখ হাসিনাকে যারা গতিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছিলেন তাদেরকেই তিনি কাছে টেনে সৌহার্দের হাত বাড়িয়েছেন। আলেম-ওলামারাও তাকে কওমি জননী আখ্যা দিয়েছে। তাহলে সৌহার্দের বিনিময়ে এখন ঔদ্ধত‌্য প্রদর্শন কেন! বাংলাদেশের প্রায় তিন লাখ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন পরের গলগ্রহ হয়ে জীবন চালায়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আলেম-ওলামারা তো একজন ধর্মপ্রাণ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসব বিষয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা উচিত!

পত্রিকায় দেখলাম হেফাজতে ইসলামের ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটিতে জামায়াতসহ অধিকাংশই ২০ দলীয় জোটের নেতা। জমিয়তে উলায়ামে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কমপক্ষে ৮০ থেকে ৯০ জন নেতা এই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। যে সংগঠনের এতো নেতা রাজনৈতিক দলের হোমরা চোমরা, সেই হেফাজতের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধিতা যে ধর্মের আড়ালে রাজনীতি নয়, সেটা কীভাবে বিশ্বাস করবে জাতি!

এর আগে হাইকোর্টের সামনে থেমিস ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন হেফাজতসহ ইসলামি দলের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সরিয়ে দিয়েছেন। সেটাতো জাতীয় ঈদগাহের সামনে এই ধরনের মূর্তি থাকার প্রয়োজন কোথায় সে বিবেচনায়; এমনতো নয় যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ভাস্কর্য বিরোধী। আলেম সমাজের দাবিকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মান দেওয়ার অর্থতো এই নয় যে তিনি তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এখন দেশ থেকে ভাস্কর্য উচ্ছেদ আন্দোলনে শামিল হবেন। এমন আবদারও কি তাকে মেনে নিতে হবে যে জাতির পিতার ভাস্কর্য নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদেরকে আশকারা দেবেন!

এখন প্রশ্ন আসে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রের ওলামায়ে কেরামকে যে সম্মান দিলেন, যে মর্যাদার আসন দিয়ে পাশে বসালেন, গুরুজনদের পায়ে ছুঁয়ে সালাম করে একটি সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করলেন, সেটা নষ্ট করেছে কে? ওলামায়ে কেরাম—নিজেরাই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ১২ বছর’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির নানা দিক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদেরকে আমরা কী বলি? তাদেরকে আমরা কী ডাকি? তাদেরকে আমরা রাজাকার ডাকি। একাত্তরে ছিল জামায়াত আর এখন হেফাজতও সেই নতুন রাজাকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

অবশ্য বিলম্ব না করেই খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক, একই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন, ভাস্কর্য বিরোধিতার সঙ্গে রাজাকার হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। আক্ষরিক অর্থে নিলে তার বক্তব্য ঠিক, কিন্তু কার্যকারণ বিশ্লেষণ করলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথাই সত্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার যেমন দরকার হচ্ছে না, তেমনি ‘নতুন রাজাকার’ হওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের রাজকারদের নৃশংসতার সহযোগী হওয়ার দরকার নেই। একাত্তরে ইসলামের দোহাই দিয়ে রাজাকাররা যেমন তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে, ‘নতুন রাজাকাররাও’ এখন তাই করছে। এরা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চিন্তায় নেই, জনগণের হাজারও সমস্যায় পাশে নেই, শ্রমিকের মজুরি বাড়ার সংগ্রামে নেই, কৃষকের সমস্যায় ধারে কাছে নেই, শিক্ষাকে যুযোপযোগী করায় নেই। কিন্তু রাষ্ট্র চালানোর জন্য ইসলাম কায়েম করতে চায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ