X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালির বিজয়ের ইতিহাস

আহমদ রফিক
১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

বাঙালির বিজয়ের ইতিহাস ভারতবর্ষ বহুমাত্রিক বিচিত্র দেশ—বহু জাতি, বহু ভাষী, বহু ধর্ম-বিশ্বাসী মানুষের বসতি এখানে দীর্ঘকাল থেকে। কাজেই বহু মত-পথের বৈচিত্র্য এখানে যথেষ্ট জটিলতা সৃষ্টি করেছে। করেছে বৈচিত্র্যও। বিশেষ করে আধুনিক যুগের রাজনীতি আরো বেশি জটিল ও কুটিল। আধুনিক যুগে ‘বিজয়’ শব্দটিকে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হলে সে শিরোপাটি বিদেশি ইংরেজ জাতি সেটার অধিকারী—ষড়যন্ত্রে, অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতায়, বিদেশির চাতুর্যে ও বিচক্ষণতায় ও অস্ত্রশক্তির জোরে।

বিদেশি শাসকের স্বৈরাচার, নিপীড়ন, শোষণ স্বভাবতই দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় প্রতিবাদী রাজনীতিকে কেন্দ্র করে, শাসকের বিরুদ্ধে সংঘাত, সেখানে প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে বিদেশি শাসক বিতাড়ন। এক কথায় দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার—চলে লাগাতার স্বাধীনতা সংগ্রাম—স্বদেশি আন্দোলনে অনেক রক্তপাত, অনেক আত্মদান, একাধিক ধারার স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান যে যার ধারায় লড়াই চালায়—নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, বিপ্লবী আন্দোলন, চরমপন্থা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি।

তবু চাতুর্যে শাসন চলে ১৯০ বছর। তার কারণ ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়—হিন্দু মুসলমানকে নিয়ে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির সাফল্যে তাদের দীর্ঘ শাসন পরিচালনা। মহাবিদ্রোহের পর থেকে মর্লি-মিন্টো সংস্কার, মন্টেগু সংস্কার, শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫-এ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ, বিদ্বেষ, স্বতন্ত্র নির্বাচন ইত্যাদির মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয় ইংরেজ শাসক তাদের চাতুর্যের মাধ্যমে।

দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভিন্নতা, আনুষ্ঠানিক ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে সংঘাত তথা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রাজনৈতিক বিষাক্ত করে তোলে—ভ্রাতৃহত্যা, সংঘাত, স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।

তবু স্বাধীনতার প্রবল টানে, ছাত্র আন্দোলন, ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট, কৃষক বিদ্রোহ, শেষ পর্যন্ত নৌ-বিদ্রোহের মতো ঘটনাবলি শাসকের উপনিবেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তে বাধ্য করে। সমঝোতার চেষ্টা চলে শাসকের পক্ষে—১৯৪২-এ ক্রিপস সমঝোতা মিশন, শেষ পর্যন্ত কেবিনেট মিশন, অবশেষে মাউন্ট ব্যাটন মিশনের মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। পরাধীনতামুক্ত দেশ (১৯৪৭, আগস্ট), সংখ্যালঘু মুসলমানের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ অর্জন করে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় স্বাধীনতা, অর্থাৎ ‘বিজয়’।

এই দ্বিতীয় বিজয় নিখুঁত ছিল না। প্রথমত দেশ বিভক্ত সাম্প্রদায়িক ও দ্বিজাতি রাজনীতির বিভ্রান্তিতে হয়েছে সাম্প্রদায়িক রক্তস্নান। বিভাজিত ভূখণ্ডের নাম হিন্দু-প্রধান ‘ভারত’ এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র ভূমি ‘পাকিস্তান’। জিন্নাহর জেদ এবং কংগ্রেসের অনুদারতার কারণে এই রাজনৈতিক অঘটন। তবু মানুষ দুই পারেই খুশি এই ‘বিজয়’-এ।

 

দুই.

আগে বলা হয়েছে ইংরেজ শাসকের কুটিলতা এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে, ভাগ করো নীতিতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে ভারতের বিভাজন—দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুটিলতায় বঙ্গীয় মুসলমানের শ্রেণিগত দুর্দশা—বিশাল সংখ্যক দরিদ্র নিরক্ষর কৃষক শ্রেণি, বিশাল হিন্দু জমিদার শ্রেণি। বিপুল বৈষম্য, যা ভারত বিভাগ ও দাঙ্গা হাঙ্গামার মূল কারণ, অন্যতম কারণ হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষের বীজতলা। এসব কারণে হিন্দু-মুসলমানের বৈষম্যের ভিত্তিও ভারত বিভাগের অন্যতম কারণ।

তাই অঘটন। কিন্তু বঙ্গীয় মুসলমান পাকিস্তান অর্জন করে মহাখুশি—এটা তাদের জন্য এক মহাবিজয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বঙ্গীয় মুসলমানের একাট্টা ভোটে অর্থাৎ মুসলিম লীগ দলের বিজয়ে ভারত ভাগ এবং বঙ্গ ভাগ এবং পাকিস্তান অর্জন—পশ্চিম প্রান্তে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্বাঞ্চলে পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান)—বঙ্গীয় মুসলমানের স্বতন্ত্র ভূমি।

কিন্তু বিজয় স্থায়ী হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয়, শাসন শক্তি, ঘটে সামরিক শক্তির প্রাধান্য। রাজধানী করাচি। যত বিদেশি অনুদান, সব ব্যবহৃত হয় রাজধানীর উন্নতিতে, করাচি বন্দরের উন্নতিতে (চট্টগ্রাম বন্দরের নয়)। যত শিল্পাঞ্চল সবই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে। পূর্ববঙ্গে যা কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান—চটকল, বস্ত্রকল এবং অন্যান্য শিল্প সংগঠন সবই অবাঙালি মালিকানার—আদমজী, ইস্পাহানী এবং অন্যান্য অবাঙালি মালিক, ছোটখাট দু-একটা শিল্প বাঙালির।

এভাবে পূর্ব পশ্চিমে অর্থনৈতিক, শিল্প, পরিবহন, সার্বিক উন্নয়ন সবই পশ্চিম পাকিস্তানে—এক কথায় পূর্ব-পশ্চিমে বিপুল বৈষম্য। বিষয়টি শিক্ষিত, সচেতন, মননশীল বাঙালির নজরে পড়ে, দেখা দেয় প্রতিক্রিয়া। সে প্রতিক্রিয়া শিক্ষিত শ্রেণি থেকে সঞ্চারিত হয় রাজনৈতিক মহলে, ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য মহলে, এমনকি শিক্ষিত শ্রেণিতে— সেখানে বৈষম্য—বৈষম্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কারিগরি প্রতিষ্ঠানে, যেমন মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।

এই বৈষম্য চেতনা ক্রমে প্রসারিত হয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিতে, এমনকি কর্মী, শ্রমিক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে।

বিষয়টি রাজনীতি থেকে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পশ্চিমের অবাঙালি কেন্দ্রিয় সরকার তা গ্রাহ্য করে না। কারণ সামরিক শক্তিতে বিশ্বাসী। তারা শক্তি দিয়ে বাঙালিকে পদানত রাখে। পরিণামে পূর্ববঙ্গে ছাত্র, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এমনকি শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী বৈষম্য সচেতন হয়ে প্রবল আন্দোলনে নামে।

আবারও নির্বাচনে (১৯৭০) বাঙালি জাতীয়তাবাদের একাট্টা বিজয়, এটা অভাবিত ছিল পশ্চিমের জন্য। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক শক্তির বর্বর প্রয়োগ—বাঙালির বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধ্বংস, নারী ধর্ষণ—কিন্তু মিত্র শক্তির সহায়তায় শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন—পূর্বাঞ্চলে পাক শক্তির পরাজয়। এবার তৃতীয় বিজয়—স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়—নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে এভাবে বিজয়ের এক ধারাবাহিকতা বিদেশি শক্তি থেকে স্বদেশি শক্তির। ষোলোই ডিসেম্বর রেসকোর্স মাঠে পাকবাহিনীর পরাজয়ের স্বাক্ষর নিয়াজির। ত্রিধাবিভক্ত হলো ভারতীয় উপমহাদেশ।

একাধিক দ্বন্দ্বের মধ্যে এই বিজয়ের ইতিকথা। প্রথমত ইংরেজ বনাম ভারতীয়, পরে বাঙালি বনাম অবাঙালি— পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশ।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়