X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, রক্ত দিয়ে রক্ষা করবে’

উদিসা ইসলাম
১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:০০আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:০০

‘জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, রক্ত দিয়ে রক্ষা করবে’ (বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা।)
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত ও কাজের মূল্যায়ন করেছিলেন। তিনি সেদিন আবারও দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করবে। বাংলাদেশ আছে, থাকবে। তাকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বন্ধুরা প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক করে নাই। বাংলার মানুষকে ভালোবাসি বলেই রাজনীতি করেছিলাম। আর হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠে গিয়েছিলাম। আর যদি একদিন দেখি বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে না, প্রধানমন্ত্রিত্বে লাথি মেরে আবার জনগণের কাছে চলে যাবো। বাংলার মানুষ আমাকে জাতির পিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে ছোট জিনিস। কিন্তু আমি বাধ্য হয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রিত্ব নিতে। কারণ, আমার গুদামে চাল ছিল না, আমাদের পোশাক ছিল না, আমার রাস্তাঘাট কিছুই ছিল না।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে। যুদ্ধবন্দি আর যুদ্ধাপরাধী এক জিনিস নয়, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে কিনা সেটা বড় কথা নয়। আমরা পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেবো কি দেবো না সেটা ভাববার আছে। আমার ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে, এক কোটি লোককে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। তারা তিন কোটি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। রাস্তাঘাট ছারখার করে ভেঙে দিয়েছে। আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে। সান্ধ্য আইন জারি করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে কী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে পারেন?’

সেদিন সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। উদ্দীপনা প্রাণস্পন্দন আর উন্মাদনায় যে মঞ্চে সভা অনুষ্ঠিত হয়, বিজয় দিবসের প্রধান অনুষ্ঠান সেখানে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আবার ১৯৭১-এর ৭ মার্চ এই ময়দান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন।

‘জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, রক্ত দিয়ে রক্ষা করবে’

নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ
নিরপেক্ষতার সঙ্গে ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ডাকাতি, রাহাজানি ও ছিনতাইকারীদের দমনের জন্য তিনি চরম ব্যবস্থা গ্রহণের ম্যানডেট জনগণের কাছ থেকে গ্রহণ করেন।

শ্রমিক-কৃষকদের প্রতি
শ্রমিকদের কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তারা এ পর্যন্ত যা পেয়েছে উৎপাদন বাড়ালে আরও বাড়বে। না বাড়ালে কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কৃষকের প্রতি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, লাখ লাখ টন বিদেশ থেকে প্রতিবছর আমদানি করা যাবে না। নিজ হাত দিয়ে দেশকে স্বাবলম্বী হতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যারা কাজে ফাঁকি দেন ও দুর্নীতির আশ্রয় নেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করেন। আমাদের নীতি পরিষ্কার। বাইরের হস্তক্ষেপ আমরা চাই না। অন্যদের ব্যাপারে করতেও রাজি নই।

জনগণ শান্তিতে ঘুমাতে চায়
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দুষ্কৃতকারী, ডাকাতি, রাহাজানি ঘটায় যারা সেই সমাজ বিরোধীদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সংকল্প ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘আজ ডাকাতরা গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করছে, তাদের হাতে অস্ত্র রয়েছে। মানুষ আমার কাছে খাবার চায় না, তারা শান্তিতে ঘুমাতে চায়। আবার ভয় দেখায় দুষ্কৃতকারীরা, শহরে-গ্রামে চুরি ডাকাতি করে আবার মাঝে মাঝে অস্ত্রের ভয় দেখায়। এদের নির্মূল করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধের ব্যাপারে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

এ মাসের মধ্যে প্রত্যেক মহকুমায় রক্ষীবাহিনী যাবে। দুষ্কৃতকারীদের ধরার ব্যাপারে জনগণের সহযোগিতা করতে হবে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন। চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্তে যেমন সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, তেমনি ডাকাতদের খতম করার জন্য দরকার হলে গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনী পাঠানো হবে।

আটক বাঙালি প্রসঙ্গে
পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চার লাখ বাঙালিকে পাকিস্তান বন্দি করে রেখেছে। তারা কোনও অন্যায় করেনি। দুনিয়া অন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের যেসব অবাঙালি রয়েছে তাদের মধ্যে দেড় লাখ জানিয়েছে তারা বাংলাদেশে থাকতে চায়। আড়াই লাখের বেশি অবাঙালি বলেছে তারা পাকিস্তানে যাবেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব অবাঙালি পাকিস্তান যেতে চায় তাদের পাকিস্তানে পৌঁছে দেওয়া এবং পাকিস্তান থেকে আটক বাঙালিদের বাংলাদেশি ফিরিয়ে আনার জন্য রেডক্রসের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’

‘জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, রক্ত দিয়ে রক্ষা করবে’

জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আবার ভোট চান
বিশাল জনতা হাত তুলে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানালে তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন দিয়েছি। ক্ষমতায় আসার পর এত তাড়াতাড়ি কেউ নির্বাচন দেয় না। আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছিলেন। ইচ্ছে করলে ৫ বছর আমি ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। আমার দল ক্ষমতায় থাকতে পারতো। কিন্তু আমরা পরিষদ বাতিল করে নির্বাচন দিয়েছি।’

সমালোচকদের প্রতি
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘রামের ধনুক আমার সহ্য হয়। কিন্তু হনুমানের ডাক আমার সহ্য হয় না। কিছু সংখ্যক দুধের বাচ্চাদের দাঁত ভাঙতে শুরু করেছে, তাতে মাঝে মাঝে আমি অসহ্য হয়ে উঠি। সমালোচনা নয়, কাজ করুন। অনেকে বক্তৃতা করেন কী হলো, এটা হলো না, ওটা হলো না, সেটা হলো না। কিন্তু কোত্থেকে হবে? ভারতবর্ষ যদি আমাকে আড়াই কোটি মণ খাবার না দিতো তবে আমি এ দেশের লোককে বাঁচাতে পারতাম না।’

১৯৭০ সালে জলোচ্ছ্বাসের সময় ভোলার সন্দ্বীপ-হাতিয়া, পটুয়াখালী, নোয়াখালীর কয়েক লাখ লোক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার সময় আমিও তখন বিরোধী দল করতাম। সরকার কী সাহায্য দিয়েছে না দিয়েছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিনি। এমন কোনও দিন নেই যে দ্বীপে আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিয়ে কাজ করিনি। অন্যকে দুর্নীতিবাজ বলেন যখন, তখন মেহেরবানি করে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে নেন। আপনাদের কী ছিল আমি জানি, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবো।’
কণ্ঠে হতাশাও ছিল
বঙ্গবন্ধুর বলেন, ‘আমাকে বলা হয় কঠোর হবার জন্য, কিন্তু আমি কাকে মারবো? ৪৪ জন পরিষদ সদস্যকে আমি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করেছি। ইতিহাসে তার নজির নেই। আওয়ামী লীগ কর্মীকে বের করে দিয়েছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দিলে তারা হিরো হয়ে যায়। চুরি করেছে, ধরতে গেলে অন্য দলে যোগ দেয়। তাদের কাছে অস্ত্র পাওয়া গেছে, অন্য দলে গিয়ে বিপ্লবী সেজেছে। এরা বিপ্লবী নয়, এরা রাজাকার।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কেবল বলা হয় জুলুম হয়েছে জুলুম হয়েছে। জুলুম তারা দেখেননি। জুলুম হয়েছে আমাদের ওপর। আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে, খুন আর ডাকাতির আসামি করা হয়েছে। তারা দেখে নাই জুলুম কাকে বলে। আমি জুলুম করতে চাই না।’

/এসটি/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ভূমিহীনমুক্ত হচ্ছে সাতক্ষীরার ৬ উপজেলা, প্রস্তুত ৩৬৪টি ঘর
‘প্রধানমন্ত্রীর উপহার বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছে’
রাহমানের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’, ভিডিও করলেন মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা