X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আরব বসন্তের সূর্য উঠেই ডুবে গেলো

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:০২আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:০৪






সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা দশ বছর কিংবা এক দশক। আরব দুনিয়ার মানুষ কি মনে রেখেছে তিউনিসিয়ার গ্রামীণ যুবক সিদি বুয়াজিদের মোহামেদ বুয়াজিজির কথা? আরব বসন্তের আঁতুড়ঘর তিউনিসিয়া। এক স্বাভাবিক শুক্রবারে এই সবজি বিক্রেতা প্রতিদিনের মতো রাস্তায় তার রুটি রুজির সংগ্রাম করছিলেন পুলিশের রক্তচক্ষু আর ঘুষ চাহিদার সামনে। হঠাৎ এই যুবক চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন ‘যথেষ্ট’। পুলিশ সদস্যরা বেশি ঘুষ দাবি করলে এর বাইরে আর কিছু বলার ছিল না তার। কিন্তু পুলিশ তার কথা মানেনি। দিনটি ছিল ২০১০-এর ১৭ ডিসেম্বর। পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে সবজি দোকানদার বুয়াজিজি প্রকাশ্যে গায়ে আগুন লাগিয়ে জুলুমবাজদের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। দমন-পীড়ন, দুর্নীতি আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গোমড়ানো তিউনিসিয়াসহ পুরো আরব বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় বুয়াজিজির আত্মহত্যা।




চারদিন পর মারা যায় বুয়াজিজি। তাঁর শহর সিদি বুয়াজিদের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ গর্জে উঠলো। দিন দশেক ধরে দেশের সর্বত্র বিক্ষোভ এবং সরকারি বাহিনীর সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ চললো। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেলো যে, তিউনিসিয়ার স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট বেন আলী পালিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নিলো। সেটা ছিল ১৪ জানুয়ারি। শাসক দলের স্পিকার ক্ষমতায় এলেন এবং বেশ কয়েকটি দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু জনতা তাতে খুশি হলো না। তারা ওই জমানার পুরোপুরি বিলুপ্তি এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে গোঁ ধরে রইলো। জনতাই জিতলো। ২০১১-এর অক্টোবরে সংসদীয় ভোট হলো। কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষ দলকে সঙ্গে নিয়ে এনহাদা ইসলামি পার্টি কোয়ালিশন সরকার গড়লো।

তিউনিসিয়ার সেই বসন্ত বিক্ষোভ ডানা মেললো আরও অনেক আরব দেশে। জানুয়ারিতে যখন তিউনিসিয়ার জনতা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো, সেই সময় মিসরের মানুষও গণতন্ত্রের দাবি তুললো। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে সব স্তরের মানুষ জমায়েত করে বললো, ‘হোসনি মুবারক, তোমার দিন শেষ। তুমি বেন আলীর পথ ধর’। সারা দেশ কায়রোয় জড়ো হলো। ২৫ জানুয়ারি যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা চলল ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেদিনই হোসনি মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

খুব দ্রুতই তা অন্য সব আরব দেশে ছড়িয়ে পড়লো। তিউনিসিয়া, মিসরের পাশাপাশি লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, সিরিয়া, মরক্কো, জর্ডানে স্বৈরাচারী ও পারিবারিক একনায়কতন্ত্রী সরকারকে উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ রাস্তায় নামলো। লিবিয়ার কুখ্যাত শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির অপসারণের দাবিতে উত্তাল হলো গোটা দেশ। ২০ অক্টোবর টিভি চ্যানেলগুলো সারা বিশ্বকে দেখাল, স্বৈরাচারী গাদ্দাফিকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মারছে জনতা।

এই আরব বসন্তের বলি হয়েছিলেন ইয়েমেনের একনায়ক আলি আবদুল্লা সালেহ। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিল ইয়েমনি জনতা। ২৩ নভেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হয়েছিলেন সালেহ।

কিন্তু দশ বছর পর এসে সবার কোথায় হারিয়ে গেলো সেই বসন্ত? আরবে কোনও বসন্ত আর আছে কি? এখন আরবের আকাশে রাশিয়া, ফ্রান্স, আমেরিকা এমনকি তুরস্ক বা সৌদি আরবের যুদ্ধবিমান। ইসলামি দেশগুলোর নিজেদের ভেতর কতই না উন্মাদনা। যে উম্মাহর কথা বলে মুসলিম বিশ্ব তার ছিটেফোঁটাও কি আর অবশিষ্ট আছে? আজ ইয়েমেনের নাগরিক মরে সৌদি বিমানের বোমার আঘাতে। কত শিশু, কত নারী, কত অতি সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছে আইএস তার হিসাব কেউ জানে না।  

ইয়েমেনের কথা কেউ বলে না। সবার দৃষ্টি সিরিয়ায়। ধর্মনিরপেক্ষ এই আরব রাষ্ট্র আজ সব দেশের লোভের নজরে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার-আল-আসাদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় বিদ্রোহ হলো ’১১-এর মার্চে। বিক্ষোভ, আন্দোলন প্রথমে প্রাদেশিক শহরগুলোতে হলেও কিছু দিনের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়লো দেশের বড় শহরগুলোতে। দেশ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। সংখ্যাগুরু সুন্নিদের সমর্থনে এগিয়ে এলো সৌদি আরব ও আমেরিকা আর প্রেসিডেন্ট আসাদের সমর্থনে ইরান ও রাশিয়া। আসাদের ট্যাংক রুখতে বিরোধীরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠন করে প্রত্যাঘাতের পথে পা বাড়ালো। শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। এখনও চলছে। হাজারে হাজারে সিরিয়ান উদ্বাস্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থী। এই সিরিয়াতেই আজকের বিশ্বের ত্রাস আইএসআইএস-এর ঘাঁটি হলো। সিরিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ এবং ইরাকের বেশ কিছু এলাকা আইএস-এর দখলে গেলো। আইএস এখন অনেকটাই কোণঠাসা, কিন্তু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামেনি।

আজ দশ বছর পর এসে দেখা গেলো  আরব বসন্ত স্থায়ী হতে পারেনি। গণতন্ত্রের যে আশা জাগিয়েছিল আরব ভূখণ্ডে সেটা আসেনি। একনায়কতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম, সফল হয়নি। যোগ্য রাজনৈতিক দল না থাকায় উগ্র ইসলামি গোষ্ঠীগুলো জায়গা দখল করে নিলো। যে তিউনিসিয়া আরব বসন্তের জন্ম দিয়েছিল, সেখানেই আইএস একের পর এক হামলা চালায়। আরব ভূমির বিভিন্ন প্রান্তে যে আইএসআইএস হত্যালীলা চালায়, সেই সংগঠনেও তিউনিসিয়ার তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি।

দুঃখজনক হলো মিসরে বসন্তের ফল ভোগ করে মৌলবাদী মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। যদিও তার ক্ষমতায় থাকাটা স্থায়ী হয়নি। পরে জেলেই মারা গেছে এই জঙ্গি নেতা। হোসনি মুবারকও মারা গেছে, কিন্তু মিসরে গণতন্ত্র আসেনি। গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়েছে, কিন্তু লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল আজ শাসন করছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ। দেশজুড়ে চলছে কেবলই  হানাহানি।  

দশ বছর পরে এসে উপলব্ধি একটাই। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়ার কুখ্যাত শাসকরা নেই।  কিন্তু তারা তাদের সুবিধার্থে নিজ নিজ দেশে যে প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছিল এবং তা চালু রাখতে যে সামন্ত ও সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্ম দিয়েছিল, তাকে বাদ দেওয়া যায়নি বলে বসন্তের ফল ঘরে আসেনি।  

আরব বসন্ত নামের বিপ্লব ছিল রাজনৈতিক দর্শন বিহীন। তাই জায়গা করে নিলো বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ইসলামি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। যে আরব বসন্ত আশা জাগিয়েছিল তা আজ লাপাত্তা। সেখানকার অনেক দেশই আজ গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত। যেখানে গৃহযুদ্ধ নেই যেমন সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইন বা ওমান সেখানে আছে পারিবারিক এবং অভিজাত শ্রেণির শাসন। আরব বসন্তের সূর্য কবে যেন উঠেই নাই হয়ে গেলো।

লেখক: সাংবাদিক 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ