X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

সময় ও জীবনের সংবেদী রূপকার

মাসউদ আহমাদ
২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:০০

সময় ও জীবনের সংবেদী রূপকার রিজিয়া রহমানের দুটো বিষয় আমার কাছে বড় হয়ে ওঠে—তাঁর লেখালেখির বিষয় ও শিল্পভঙ্গি আর তাঁর ব্যক্তিত্ব। কবিতা দিয়ে লেখা শুরু করলেও ক্রমশ তিনি গল্প ও উপন্যাসের জগতে নিজের সৃজনপ্রয়াস মেলে ধরেন। লেখালেখির একেবারে শুরু থেকেই তিনি বিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপনে নিজস্ব ভঙ্গি ও ভাষা খুঁজে ফিরেছেন, যাতে তাঁকে আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। যে কোনো মৌলিক লেখকের এক জীবনের আরাধ্য—ভাষার স্বকীয়তা ও অভিনব বিষয়ের সৃজনসম্ভার। এক্ষেত্রে তাঁকে গোড়া থেকেই পাঠক স্বতন্ত্র স্বরের কথাশিল্পী হিসেবে শনাক্ত করতে পেরেছেন।

তরুণ কবি ও লেখকদের নানা ধরনের ঘোর থাকে। সেই ঘোরের আরশিতে প্রথমেই সাধারণত উঁকি দেয় প্রেমোখ্যান, রোমান্টিক কোনো কাহিনি বা পারিবারিক টানাপোড়েনের গল্প। রিজিয়া রহমান সচেতনভাবেই সেই ছক এড়িয়ে নিজের শিল্পস্বর খুঁজে ফিরেছেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘লাল টিলার আকাশ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিনে অশ্লীলতার অভিযোগে প্রথমে ছাপা হতে পারেনি। পরে পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী গল্পটির সাহস ও শিল্পমান বিবেচনায় ছাপার জন্য মনোনীত করেন। জীবনের গভীর অন্বেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রথম থেকেই তিনি তাঁর লেখায় প্রতিভাত করে তুলেছেন।

সরল প্রেমের গল্প বা সাধারণ দিনযাপনের কাহিনি নিয়ে তিনি উপন্যাস খুব একটা লেখেননি। গল্প উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের ফেলে আসা সময় ও ইতিহাসের শেকড়ের সন্ধান করে গেছেন। কখনো প্রান্তিক মানুষের লড়াই ও ক্ষয়ে যাওয়া জনপদের দীর্ঘশ্বাস চিত্রিত করেছেন। সচেতন ও কুশলী কথাকার হিসেবে তাঁর ভাবনা ও মগ্নতার আভাস তাঁর লেখা পড়তে গেলে সহজেই তা অনুভব করা যায়। 

সংখ্যার বিচারে রিজিয়া রহমান অনেক উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু কোনো উপন্যাসই তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, হোমওয়ার্ক ও ফিল্ডওয়ার্কের বাইরে লেখেননি। স্বামীর চাকরির সূত্রে দেশের বিভিন্ন শহর ও প্রান্তে তিনি সংসার পেতেছেন। চারপাশের মানুষ ও পরিপার্শ্ব, মানুষের মনোজগত ও মানচিত্র অবলোকন করেছেন শিল্পীর চোখ ও নিষ্ঠা নিয়ে। পরে সেসব তুলে ধরেছেন গল্প উপন্যাসের পটভূমিতে। 

‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোনোর পর, ১৯৭৪ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এতে বস্তির মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-ক্লেদ নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, নিজের চোখে দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা ঘটনা ও জীবনবীক্ষা এতে উঠে এসেছে। আবার নিষিদ্ধ পল্লীর দেহপসারিণীদের মানবেতর দৈনন্দিন জীবনের গল্প ও রক্তমাখা ঘটনা নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘রক্তের অক্ষর’। পত্রিকায় প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে পতিতাপল্লীর মেয়েদের জীবনের গল্প পড়ে তিনি আলোড়িত ও আর্ত হন। পরে নানাভাবে তাদের জীবন, জীবনের সুখ-দুঃখ আর রক্ত-অশ্রু-ঘাম মেশানো দীর্ঘশ্বাস অনুভব করে বিশ্বাসযোগ্য চিত্র এঁকেছেন ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে। 

বহুকাল ধরে এই জনপদে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও বাংলা ভাষার বিবর্তন ঘটে এসেছে। কেমন ছিল সেই সূত্র ও ঘটনাপ্রবাহ? সেই ভাবনা থেকে লিখেছেন ‘বং থেকে বাংলা’। এই উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন—‘বাংলাদেশের জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের সৃষ্টি।’

এভাবে ইতিহাস ও সমাজ বিবর্তনের নানা ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন কুশলী কলমে, শিল্পিত ভাষায়। বস্তির জীবনচিত্র, সাঁওতালদের ভেতরের লড়াই ও বেঁচে থাকা; কখনো নারীমুক্তির ভাবনা ও অভিজ্ঞতা থেকে লিখে গেছেন উপন্যাসের পর উপন্যাস। যেখানে জীবনের ভাষ্য প্রণিধানযোগ্য ও শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে তাঁর অসামান্য সাহিত্যবোধ ও সাধনার নৈপুণ্যে।

জীবনের শেষের দিকে এসে তিনি লিখেছেন আত্মজৈবনিক উপন্যাস ও স্মৃতিকথা। উপস্থাপন আর ভাব ও ভাষার সমন্বয়ে সেসব রচনাও হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য ও সবিশেষ।

রিজিয়া রহমানের উপন্যাসের ভাষা সংবেদী ও লাবণ্যময়। তাঁর ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাস থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি, এতে সেটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে : ‘সকালটা এখানে অকেজো নেশাখোরের মতো ঝিম ধরে পড়ে আছে। পলেস্তারা খসা ইট বের করা দেওয়ালে সরু রোদের রেখা বিনা পয়সার খরিদ্দারের মতো বেহায়াভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে। ময়লা উপচানো ড্রেনের ধারে কয়েকটা শালপাতার ঠোঙা আর ছেঁড়া তেল-চপচপে কাগজ নিয়ে গৃহবিবাদে রত একদল কাক। একটু দূরেই একটা ঘেয়ো কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই।

কুসুম উঠেছে সকালেই। সবার আগে এ পাড়ায় সে ওঠে। তখনো বকুল, জাহানআরা, সখিনা, মর্জিনা সবাই হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রীভাবে ঘুমিয়ে থাকে। গলির ভেতর মান্নানের দোকান ঝাপ খোলে না। শুধু রাস্তার ও-ধারে ডালপুরি আর গোলগোল্লার দোকানের ছোকরাটা সবে চুলোয় আঁচ ধরায়।

বারোয়ারি পায়খানায় একটু পরেই তো রেশনের লাইন লেগে যাবে।’

আর তাঁর ব্যক্তিত্ব। রিজিয়া রহমানের সঙ্গে দেখা হলে, মানুষ যে কত অতিথি-পরায়ন ও আন্তরিক হতে পারেন, তার অনন্য উদাহরণ ছিলেন তিনি। মা, কখনো বড়বোনের মতো স্নেহের একটি হাত বাড়িয়ে দিতেন। কথা, গল্প ও আপ্যায়নে তিনি বিমোহিত করে দিতেন। ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে ইচ্ছে না থাকলেও তিনি হয়ত নিমরাজি হলেন, সায় দিলেন বা কোনো ছেলেমানুষী আবদার মেনে নিলেন; কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে তিনি কোনোভাবেই আপোস করতেন না। কোনো রচনা লিখিত হওয়ার পর, খাপছাড়া ও অসম্পূর্ণ মনে হলে সেটিকে ছাড়পত্র দিতেন না। জীবনের শেষের দিকে তিনি ভালো দেখতেন না, হাঁটতে পারতেন না; পায়ে পানি জমে যেত। এ জন্য বহুদিন তিনি একুশে বইমেলায়ও যেতেন না। তবুও লেখার জন্য তাঁর আন্তরিকতা ছিল চমৎকার। তাঁর একাধিক লেখা ও সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু শেষের দিকে, একটি লেখা দিতে তিনি অপারগ ও অরাজি ছিলেন এই অজুহাতে যে, যত্ন করে সময় দিতে না পারলে লেখাটি ভালো হবে না। এবং তিনি দিলেনও না।

তাঁর এই অনন্য চরিত্র আমাকে কষ্ট দিলেও মুগ্ধ করেছে।

সাক্ষাৎকার ও লেখা নেওয়ার জন্য তাঁর উত্তরার বাসায় গিয়েছি, কয়েকবার। তিনি প্রায়ই বলতেন—‘তোমার বাড়ি তো রাজশাহীতে। পুঠিয়ায়, না? পুঠিয়া রাজবাড়ি নিয়ে তুমি তো উপন্যাস লিখতে পারো।’ দ্বিতীয়বার আবারও যখন তিনি কথাটি তুললেন, আমি নিজের সীমাবদ্ধতার কথা তাঁকে খুলে বলি: এত পুরনো বিষয়, প্রাচীন ভবন ও মন্দিরগুলোই কেবল অবশিষ্ট আছে। সেখানে একসময় যে মানুষ থাকতেন, কেমন ছিল তাঁদের ভাষা ও ভঙ্গি, সেটাও না হয় আয়ত্ব করা গেল। কিন্তু তাঁদের মুখে যে ভাষা দেবো, সেই ভাষা কীভাবে পাবো?

পান খেতে খেতে তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। এরপর একটু বিরতি দিয়ে তিনি নির্ভার ভঙ্গিতে বললেন—‘তুমি যখন বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখতে যাবে, সে বিষয়ে তো তোমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, হেমওয়ার্ক করতে হবে। উপন্যাসের প্লট ও চরিত্র নিয়ে ভাবতে হবে। এভাবে কাজটা নিয়ে যদি তুমি গভীরভাবে লেগে থাকো, দেখবে, একসময় একটা ঘোর তৈরি হবে; উপন্যাসের কাঠামো ও সংলাপ আর দরকারি বিষয়গুলো পরপর এসে যাবে। এবং সেই ঘোরের মধ্যেই তোমার উপন্যাসটি লেখা হয়ে যাবে।’

ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমানের সেই কথাটুকু কেবল তাৎক্ষণিক পরামর্শই মনে হয়নি; মনে হয়েছে, এটা তাঁর সৃজনমানসের শক্তিমত্তারই স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ। যাকে অবলম্বন ও নির্ভর করে তিনি লিখে গেছেন একটির পর একটি উপন্যাস। যে উপন্যাসের কাঠামোতে উঠে এসেছে কখনো দেশপ্রেম, ভাষার ইতিহাস, কখনো কোনো বিশেষ জনপদের মানুষের সুখ-দুঃখ ও যাপিত জীবনের বিশ্বস্ত মানচিত্র। যেখানে আমরা ফিরে ফিরে যাব। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যসুরভির রেখাচিত্র—যেভাবেই তাঁকে বিবেচনা করি না কেন, বহুকাল তিনি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে জাগরুক থাকবেন, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে লড়ছে ভাই-ছেলে, শাজাহান খান বললেন, ‘পরিবারের ঐতিহ্য’
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে লড়ছে ভাই-ছেলে, শাজাহান খান বললেন, ‘পরিবারের ঐতিহ্য’
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান