X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৌরবাতি প্রকল্পে মাটির নিচেই নষ্ট হলো কোটি টাকার যন্ত্র

শাহেদ শফিক
২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ২২:৫৯আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ২৩:০৫

জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনওটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরূপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক ও এ খাতের অনিয়ম নিয়ে শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে নবম পর্ব। ঢাকা দক্ষিণে স্থাপিত সৌরবাতি প্রকল্প

২০১৩ সালের শুরুর দিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে রাজধানীর সড়কগুলোতে সৌরবাতির ব্যবস্থা করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু চাহিদামতো আলো না পাওয়ায় প্রকল্পটিতে সুফল আসেনি। এরপর প্রকল্পটিকে ‘ব্যর্থ’ চিহ্নিত করে সেখানে নতুন করে এলইডি বাতি লাগানো হয়। তবে খুলে নেওয়া হয়নি আগের প্রকল্পের মূল্যবান যন্ত্রপাতি। পড়ে থেকেই নষ্ট হচ্ছে সেগুলো।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্প থেকে শুধু আগের সৌরবাতিগুলো খুলে নেওয়া হলেও প্যানেলগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া কোটি টাকা মূল্যের ব্যাটারি, কন্ট্রোলারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ মাটির নিচেই পড়ে রয়েছে। এর অনেক যন্ত্রাংশই এখন আর সচল নেই। ফলে এগুলো উত্তোলন করতে গেলে যেমন সড়কে জনদুর্ভোগ বাড়বে, অপচয় হবে টাকারও। ফলে যন্ত্রগুলোর সমাধি দশা থেকে মুক্তি মিলছে না।

জানা গেছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির রূপরেখা অনুসারে বাংলাদেশ এনডিসিতে জাতীয় প্রশমন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রার আলোকে দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং উপকূলীয় বনের সীমা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সমন্বয়ে জলবায়ু প্রশমন সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নবায়নযোগ্য শক্তি, বনায়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণমূলক প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করে আসছে। কার্যক্রমের ধরনভেদে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) হতে প্রদত্ত তহবিলের প্রায় ৫২ শতাংশ তহবিল (৩১৬ কোটি টাকা) বনায়ন ও বন ব্যবস্থাপনায়, ৩২ শতাংশ তহবিল (১৯৫ কোটি টাকা) নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে এবং ১৬ শতাংশ তহবিল (৯৮ কোটি টাকা) প্রশমন সংক্রান্ত অন্যান্য কাজে বাস্তবায় করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।

ঢাকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার সড়কগুলোয় রাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালের শুরুতে সৌরবাতি স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় ডিএসসিসি। বিশ্ব ব্যাংকের জলবায়ু তহবিল ঋণে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোড, মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ, মালিবাগ থেকে যাত্রাবাড়ী জনপথ রোড এবং ধলপুর রোডে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে সৌরবাতি জ্বালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরইমধ্যে সড়কে সৌরবাতি স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের জন্য মোট ২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের অধীন প্রকল্পটি অনুমোদন করে বিশ্বব্যাংক। ২০১৩ সালের শেষের দিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ থেকে নটরডেম কলেজ পর্যন্ত সড়কে বাস্তবায়িত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে সোয়া ২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি সফল হলে পরবর্তীতে আরামবাগ, বাংলামোটর, গুলশান, হাতিরঝিল, নাবিস্কো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থাপনের কথা ছিল।

সৌরবাতি প্রকল্পে মাটির নিচেই নষ্ট হলো কোটি টাকার যন্ত্র সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক বাস্তবায়িত কাকরাইল-নটরডেম কলেজ প্রকল্পে ৬১টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়। প্রতিটি পোস্টের ওপর বসানো সাড়ে ৫ ফুট আয়তনের এক জোড়া সোলার প্যানেল। ৬১ পোলে মোট ১২২টি বাতির এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তবে দরপত্রে সর্বনিম্ন ২ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ টাকার দরদাতা পাওয়ায় পুরো টাকার আর প্রয়োজন হয়নি। প্রকল্পের কাজ নিতে ২১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। তবে কাজ পায় এলাইক সোলার এনার্জি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চার কোটি টাকার কাজ সোয়া দুই কোটি টাকায় সম্পন্ন করতে হিমশিম খায় এ প্রতিষ্ঠান। ফলে নিম্নমানের সৌরযন্ত্র দেওয়ায় অভিযোগ উঠে।

অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রকল্পে বরাদ্দের অর্ধেক টাকায় দরপত্র পাওয়ায় নিম্নমানের জিনিসপত্র দিয়ে কাজ শেষ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্যানেলের বাতিগুলো ছিল মাত্র ৬০ ওয়াটের। অথচ এই সড়কে আগের সোডিয়াম বাতিগুলো ছিল ১৫০ ওয়াটের।

প্রকল্পে বলা হয়, সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সূর্যের আলো সংরক্ষণ করে রাজধানীর সড়কে বাতিগুলো জ্বলবে। এতে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না। পরিবেশবান্ধব এ প্রকল্পটি নগরীর সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি করপোরেশনের খরচও কমাবে। কিন্তু প্রকল্পটি স্থাপনের পর থেকেই বাতিগুলোতে স্বল্প আলো, বারবার নষ্ট হওয়া, সামান্য ঝড়ে পোলগুলো ভেঙে পড়া, সৌর প্যানেলে ময়লা জমে থাকাসহ নানা ত্রুটি ধরা পড়ে।

সূত্র জানায়, সড়কে সৌর বাতি লাগানোর পর থেকেই প্রয়োজনীয় আলো দেওয়া বন্ধ করে দেয় সৌরবাতি। বেড়ে যায় ছিনতাই চাঁদাবাজি ও দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ড। পরে ডিএসসিসি তার পুরো এলাকায় এলইডি বাতি লাগানোর প্রকল্প হাতে নিলে সেখান থেকে প্রকল্প এলাকায় নতুন করে এলইডি লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবে আগের সৌরবাতির বাতিগুলো খুলে নেওয়া হলেও সেখানে পৌর প্যানেল ও মাটির নিচে থাকা মূল্যবান ব্যাটারি এবং কন্ট্রোলারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সরিয়ে নেওয়া হয়নি। এজন্য সংস্থার বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে অনুমোদনের জন্য একটি ফাইল মেয়র দফতরে পাঠানো হয়। কিন্তু তা আজও অনুমোদন পায়নি। তবে প্রকল্পের মাধ্যমে সৌর প্যানেলগুলো সড়কে স্থাপন করায় সেখান থেকে খুলে নিয়ে তা অন্যকাজে ব্যবহারে জটিলতা দেখছে সংস্থাটির শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তারা। এজন্য ফাইলটি অনুমোদন করা হচ্ছে না বলে ডিএসসিসি সূত্র জানিয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, কাকরাইল মোড থেকে পল্টন হয়ে নটরডেম পর্যন্ত সড়কে পোলগুলোর ওপরে এখনও রয়েছে সৌর প্যানেল। তবে প্যানেলগুলোর মধ্যে পুরানো বাতিগুলো খুলে নিয়ে নতুন করে এলইডি বাতি লাগিয়ে দেওয়া হবে। কোথাও কোথাও প্যানেলগুলো হেলে পড়তেও দেখা গেছে।

ফরিকরাপুল এলাকার দোকানদার হাজী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৬-৭ বছর আগে এই রাস্তায় সৌরবাতিগুলো লাগানো হয়। তখন আমরা আশাবাদী ছিলাম সড়কের অন্ধকার দূর করতে একটা কিছু হচ্ছে। কিন্তু বাতি লাগানোর পর পরই দেখি যে আলো পাওয়া যায় সেই আলো রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে না। তখন অপরাধ বেড়ে যায়। পরে হঠাৎ করে দেখি নতুন করে এলইডি বাতি লাগানো হয়। কিন্তু আগের প্যানেলগুলো আগের জায়গাই রয়ে গেছে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) জাফর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাতিগুলো ভালো আলো না দেওয়ায় পুরনো বাতিগুলো খুলে সেখানে নতুন এলইডি বাতি লাগানো হয়েছে। তবে সৌর প্যানেল, মাটির নিচে থাকা ব্যাটারি, কন্ট্রোলারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র এখনও রয়ে গেছে। আমাদের ধারণ সেগুলো বিকল হয়ে গেছে। এগুলে যদি এখন তুলে আনতে হয় তাহলে সড়ক কাটতে হবে। দুর্ভোগ আরও বাড়বে। সুতরাং আমি মনে করি এটা যে অবস্থায় পড়ে আছে সে অবস্থায় পড়ে থাকুক। এগুলো উঠিয়ে আনলেও ব্যবহার করা যাবে না। ’

সিটি কপোরেশনের অন্যান্য কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটির মূল্যবাদ যন্ত্রগুলোর বিষয়ে করপোরেশনের কর্মকর্তারা যথাযথ নজর রাখেনি। প্যানেল থেকে যখন পর্যপ্ত আলো পাওয়া যাচ্ছে না তখনই মূল্যবান যন্ত্রগুলো অপসারণ করে নিয়ে আসা যেত। এগুলো করপোরেশনের অন্যান্য জোন অফিস বা দফতরে ব্যবহার করা যেত। তাদের অবহেলার কারণে কোটি টাকা দামের যন্ত্রগুলোর সমাধি হয়েছে।

 

 

/এফএ/
সম্পর্কিত
হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার শঙ্কা এজেন্সি মালিকদের
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে
সর্বশেষ খবর
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি