X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং একজন কূটনীতিক

রঞ্জন বসু, দিল্লি
৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:০৬আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:৫৩
image

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তখন সুদূর ক্যালিফোর্নিয়াতে নিশ্চিন্ত সময় কাটাচ্ছেন। পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে অবসর নিয়ে বহুদিন ধরেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মার্কিন মুলুকেই দিন কাটছিল তার। এমন সময়ই এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধটা। অবসর ভেঙে তাকে দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, বর্ষীয়ান ওই কূটনীতিক যা ফেরাতে পারেননি।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

২০১৪ সালের মাঝামাঝি। সদ্যই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার দিল্লির ক্ষমতায় এসেছে, এবং তিন দশক পর সেই প্রথম ভারতে কোনও দল নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা পেয়েছে। বিজেপির রাজনৈতিক ইতিহাস যেভাবে হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং কথিত বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশ’কে তারা যেভাবে বারবার ভারতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাতে দিল্লিতে ক্ষমতার সেই পালাবদল ঢাকায় শুরুতে অন্তত কোনও ইতিবাচক সংকেত পাঠায়নি বলাই বাহুল্য। বরং বিজেপির ক্ষমতায় আসাকে বাংলাদেশের জন্য বড় একটি ‘কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। 

উপরন্তু ভারতের বহু বছরের ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’ নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের শেখ পরিবারের ঐতিহাসিক হৃদ্যতাও ছিল সুবিদিত, সে জায়গায় ভারতের নতুন নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কী ধরনের কেমিস্ট্রি গড়ে ওঠে সেদিকেও পর্যবেক্ষকদের সতর্ক নজর ছিল।

অথচ সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে পরবর্তী অর্ধযুগকে যে দুদেশের পক্ষ থেকেই সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে এসেছে–সেটা কীভাবে সম্ভব হলো তা অবশ্যই আজও একটা কূটনৈতিক রহস্য। আর এই অর্জনেই একটা অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম অভিজ্ঞ কূটনীতিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। সেই গোটা কাজটাই তিনি করতেন অতি নীরবে ও মসৃণভাবে, একেবারে নিজের সিগনেচার স্টাইলে!

জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি সোয়া পাঁচ বছরেরও বেশি সময় দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এই পুরো সময়টা তাকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বলেই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে অমন একজন খাঁটি দেশপ্রেমী ও মুক্তিযোদ্ধাকে তারা রাষ্ট্রদূতের ভূমিকায় পেয়েছিল। 

ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতা ছিল ঈর্ষণীয়, তবে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্নে তিনি ছিলেন পুরোপুরি আপসহীন ও ভীষণরকম জেদি। ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী (আগে পররাষ্ট্র সচিব) এস জয়শঙ্করকে যখন তখন ফোন ঘুরিয়ে কথা বলার পূর্ণ অধিকার ছিল জনাব আলীর–এবং জয়শঙ্কর তার পরম গুণগ্রাহী হলেও সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী কিন্তু তাকে উচিত কথাটা বলতে কখনও দ্বিধা করতেন না। দুটো উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোধহয় আরও পরিষ্কার হবে। 

২০১৭ সালের আগস্টে যখন মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার ঢলে বাংলাদেশ নতুন করে নাস্তানাবুদ, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক বিবৃতিতে কিন্তু এই ট্র্যাজেডির জন্য প্রকারান্তরে দোষারোপ করা হয়েছিল সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী আরসা-কেই। ক্ষুব্ধ বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির সাউথ ব্লকে গিয়ে জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘এটা আপনারা কী করছেন!’ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর সঙ্গে সেই বৈঠকের পরই ভারত তড়িঘড়ি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরানোর দায়িত্ব যে প্রধানত মিয়ানমারের, তা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়। 

এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বারবার ভারতকে বলেছেন, ‘এটাকে যদি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা হিসেবে দেখেন তাহলে আপনাদেরই ভুগতে হবে। রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি পুরো অঞ্চলের সমস্যা এবং ভারত সেটাকে এখন পাশ কাটাতে চাইলে পরে তাদেরও এর বিরাট মূল্য দিতে হবে।’ দিল্লির নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেছেন, ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবের সভাতেও প্রকাশ্যে বলেছেন।

দিল্লিতে জনাব আলীর কার্যকালে তাকে এই প্রশ্নটাও বারবার শুনতে হয়েছে, স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পাদন হয়ে গেলো, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ পর্যন্ত মিটে গেলো–কিন্তু কেন এখনও তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না?

বস্তুত ২০১৪-১৫ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুক্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে নতুন অজুহাত দিতে শুরু করেন, তিস্তাতে নাকি ভাগাভাগি করার মতো জলই নেই–তিস্তা পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এমনকি, তিস্তার বদলে ওই অঞ্চলের অন্য সব নদী, তোর্সা-ধরলা-জলঢাকার পানি ভাগ করার প্রস্তাবও তিনি ভাসিয়ে দেন ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময়, যেটাকে অনেকেই কালক্ষেপণের কৌশল হিসেবে দেখেছিলেন।

এই তিস্তার ক্ষেত্রেও কিন্তু সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন। দিল্লিতে তিনি তখন বারবার বলেছেন, ‘বেশ বুঝলাম, তিস্তায় আর আগের মতো জল নেই। এখন তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ষোলোআনা পানি আর নেই– কিন্তু আটআনা তো অন্তত আছে, কিংবা ছ-আনা?'

'তাহলে আটআনা থাকলে চার আনা-চার আনা কিংবা ছআনা থাকলে তিন আনা-তিন আনা ভাগ করতে অসুবিধা কোথায় সেটাই তো আমার মাথায় ঢোকে না!’

তার সেই অকাট্য যুক্তি কার্যত একটা ‘টেমপ্লেটে’র চেহারা পেয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলোতে যে কথা এখনও বারবার বলা হয়।

ভারতের কোনও বিজেপি সরকারের সঙ্গে সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর ‘শান্তি-আলোচনা’ চালানোর ইতিহাসও কিন্তু অনেক পুরনো। 

২০০১ সালের এপ্রিলে পদুয়া-তামাবিল সীমান্তের সংঘর্ষে যখন বিএসএফের ১৬ জওয়ান নিহত হন, তখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে রীতিমতো উত্তেজনার আঁচ দেখা দিয়েছিল। ঢাকায় তখন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে সেই উত্তেজনা প্রশমনের ভারও পেয়েছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। দিল্লিতে তখন ক্ষমতায় অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি সরকার। 

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নির্দেশে কীভাবে তখন ভারতে তার কাউন্টারপার্ট চোকিলা আয়ার আর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিংয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত করা গিয়েছিল, জনাব আলী খুব গর্বের সঙ্গে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতেন। স্থানীয় প্ররোচনায় ১৬ ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার পরও সংঘাত যে বড় কোনও তিক্ততায় গড়ায়নি, বাংলাদেশের জন্য সেটা অবশ্যই বড় কূটনৈতিক সাফল্য ছিল–আর তার অন্যতম রূপকারও ছিলেন আলী।

ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার বেশ কিছু ভাবনাচিন্তা ছিল রীতিমতো অবিস্মরণীয়। যেমন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে তিনি বলতেন, ‘বেড়া ভারত বসিয়েছে, আমরা নই। আর যে কারণ দেখিয়ে বসিয়েছিল সেগুলোও আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে বলেই মনে করি। কাজেই আমায় যদি জিজ্ঞেস করেন আমি বলবো বেড়ার কোনও দরকার নেই, বাংলাদেশ কখনও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া চায় না।’

ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার প্রসঙ্গে তার মন্তব্য ছিল, ‘আমি তো বলবো এই যে ভারত গরু পাচার বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে আমাদের শাপে বর হয়েছে। এই সুযোগে বাংলাদেশের খামারিরা নিজস্ব উৎপাদন অনেক বাড়িয়ে ফেলেছেন, আমরা প্রায় স্বনির্ভর হয়ে উঠেছি।’

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার দেশের নাগরিকদের ভারতে আসার প্রয়োজনও যে মিটে গেছে, সে কথাও বারবার উল্লেখ করতেন গর্বের সঙ্গে। 

দিল্লি থেকে বিদায় বেলায় ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের এক সভায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশিরা আজকাল কোন দুঃখে ভারতে আসতে যাবে বলুন তো? আমার দেশের লোক বরং ভূমধ্যসাগর সাঁতরে ইউরোপ যাবে, ভারতে কেন আসবে?’ সেই মন্তব্য প্রায় ফোকলোরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।     

আসলে কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পাশাপাশি অসাধারণ প্রজ্ঞা, অগাধ পাণ্ডিত্য আর অনন্য রসবোধই সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীকে একটা আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। কথাসাহিত্যিক চাচা সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়েও অসম্ভব গর্ব ছিল তার, কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ওই বরেণ্য লেখককে নিয়ে তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা ‘চাচাকাহিনী’ও অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছিল। 

বাংলাদেশের স্বার্থে নিরলস এই মানুষটিকে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দেও যে সবাই আলাদা চোখে দেখতেন, অত্যন্ত সমীহ করতেন তাতে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার জন্য দুই দেশ যে 'রক্তঋণে' বাঁধা পড়ে আছে সে কথাও যেমন তিনি বারবার বলতেন, তেমনি এখন দুটো সার্বভৌম দেশের সম্পর্কও যে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত, সেই বিশ্বাসেও তিনি ছিলেন অটল।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর প্রয়াণের দিন কয়েকের মধ্যেই ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ খেতাব দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে, দিল্লিতে কাজ করে যাওয়া কোনও বিদেশি কূটনীতিবিদের জন্য যা এক বিরলতম গৌরব!

শতবর্ষ পরেও যদি কখনও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে কোনও আকরগ্রন্থ লেখা হয়, এই প্রতিবেদকের দৃঢ় বিশ্বাস, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর অবদানকে অস্বীকার করে কিছুতেই সে বই লেখা যাবে না।

/এফইউ/বিএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন কলকাতায় উদযাপিত হলো ‘জাতীয় সংবিধান দিবস’
২০২৪ সালের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির তালিকায় বাংলাদেশ ১৬তম
বিএনপির প্রবাসী নেতাদের গ্রেফতারের অপেক্ষায় অ্যাসাইলাম শিকারিরা
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা