X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

একজন মেজর (অব.) হাফিজ এবং বিএনপি রাজনীতির নৈতিক সংকট

ড. শ্যামল দাস
০৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৪২আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৪২

ড. শ্যামল দাস
আমি মেজর (অব.) হাফিজের সংবাদ সম্মেলন দেখছিলাম কয়েকদিন আগে। আমার ছোটবেলায় তিনি ছিলেন আমাদের মতো শিশু ‘ফুটবলারদের’ হিরো। আমার মনে পড়ে, নয়-দশ বছর বয়সে সেই ১৯৭৬ সালে দেখা লিগের সেমিফাইনালে বিজেএমসির (সে সময় বিজেআইসি বলা হতো) বিরুদ্ধে তাঁর করা হ্যাটট্রিক এবং ফাইনালে আবাহনীর বিরুদ্ধে করা দুই গোল– যা দিয়ে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সে বছর। কবেকার কথা! এখনও খেলোয়াড় হাফিজের সেই কোনাকুনি হেড করে হ্যাট্রিক পূর্ণ করা গোলটি চোখে ভাসে। আমার চোখে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন জাদুকর। তখন থেকেই আমি মোহামেডানের সমর্থক হয়ে যাই। আজ বুঝি, আমি তো আসলে মোহামেডানের চেয়েও খেলোয়াড় হাফিজের সমর্থক ছিলাম বেশি।    

সেই জনপ্রিয় ফুটবল তারকা মেজর (অব.) হাফিজ রাজনীতিতে এলেন একসময়। একসময় বিএনপির মন্ত্রীও হলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বীর বিক্রম উপাধি পেয়েছিলেন। এত বড়মাপের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রথিতযশা খেলোয়াড়  রাজনীতিতে হ্যাটট্রিক করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারে থাকা এ মানুষটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও বড়-সড় অভিযোগ কখনও শুনিনি; এটাই ছোটবেলার হিরোর কাছ থেকে পাওয়া বড় প্রাপ্তি।

আমি সেই হ্যাটট্রিক করা তেজোদীপ্ত খেলোয়াড় হাফিজকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে; আমি দেখছিলাম রাজনীতিতে ‘আনকমফোর্টেবল’ একজন নেতা বা কর্মীকে। মোটা দাগে তাঁর এই সংবাদ সম্মেলন অনেকটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের কিছু দৈনতা প্রকাশ করে দিয়েছে। রাজনীতিক হিসেবে এই মেজর (অব.) হাফিজের পারফরম্যান্সই বা  কেমন ছিল সেদিন? মোটা দাগে আমার কাছে তিনি কিছুটা “ইমম্যাচিওর” মনে হয়েছে, যদিও তাঁর পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না।

কিছু বক্তব্য শুধু তাঁর জন্য ক্ষতিকর হয়েছে এমন নয়, তাঁর দলকেও একটি নৈতিকতার সংকটে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করি।

রাজনীতির দোলাচলে হাফিজ খুব ‘সরলভাবেই’এমন কিছু কথা বলে ফেলেছেন, যা দলটির জন্য অস্বস্তিকর তো বটেই, বাংলাদেশে বিএনপি রাজনীতি এবং সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে সেটিকেই আবার প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে মনে হয়েছে আমার। মেজর (অব.) হাফিজ সেনা সমর্থিত সরকারের সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে বেশ গর্বের সাথেই আমাদের কিছু তথ্য জানান। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক যেটি সেটি হলো এই যে, তিনি সে সময় সেনাবাহিনীর বড় বড় কুশীলবদের একটি বিশেষ অনুরোধ করেন। তাঁর ভাষায় সেটি এরকম: ‘বিএনপি দেশের জনপ্রিয় দল; তারা যেন বিএনপিকেই আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় স্থাপন করে দেয়, কিন্তু তারা আমার বক্তব্যে কর্ণপাত করেনি...’।

তাঁর কথা থেকে আমার অন্তত মনে হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়াও জেল থেকে এ কাজটি করার নির্দেশনা দিয়েছেন। মোটামুটি এ বক্তব্যটি সে সময়কার বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারণা দেয় আমাদের। একটি গণতান্ত্রিক দলের জন্য এই তথ্যটি মারাত্মক ‘ব্লো’ বলেই মনে করি। আমি জানি না মেজর (অব.) হাফিজ রাজনীতিতে এতটাই “সরল” কিনা, যিনি দলের ক্ষতির কথা একেবারেই না বুঝে কথাটি বলে ফেলেছেন।  

বিষয়টি নিয়ে আরও একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বিএনপি’র নেতৃত্বের মধ্যে একটি বড় সমস্যা এই যে, ইদানীংকালে এই দলটি মানুষের পালস বুঝতে অক্ষম। মেজর (অব.) হাফিজের ভাষা থেকে আমি এমন ধারণাই করি যে, তিনি তার কাজের জন্য গর্বিত, এবং তিনি মনে করেন, সেনা সমর্থিত সরকারের উচিত ছিল বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো। এ বিষয়টি যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে বিএনপির ফখরুদ্দীন সরকারের প্রতি বৈরীভাব ধরে রাখার কোনও ভাইটাল কারণ থাকে না, কারণ ক্ষমতার ‘অবৈধ’ অংশীদার করার অনুরোধ না রাখায় আর যাই হোক তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সারাক্ষণ গালমন্দ করা যায় না। আমরা কি তাহলে ধরে নেবো, বিএনপির এই যে সেনা সমর্থিত সরকারের প্রতি রাগ এবং বিদ্বেষ তার মূল কারণ হলো তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় ‘স্থাপন’ করে দেয়নি?  

এবার বিএনপির এই শোকজ নাটক নিয়ে দুয়েকটা কথা বলা দরকার। শেষাবধি দেখা গেলো যে মেজর (অব.) হাফিজ শোকজের যে জবাব সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন, বিএনপি তার কোনও প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া দেয়নি। বিষয়টা কী দাঁড়ালো তাহলে? মেজর (অব.) হাফিজ সংবাদ সম্মেলনে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের যে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন সে বিষয়টি কি তাহলে সত্যি? খন্দকার দেলোয়ার যে তাঁকে এ কাজটি করতে বলেছিলেন সে তথ্যটিও তাহলে বিএনপি মেনে নিলো? হাফিজ বারবার এও বলেছেন, তিনি পুরোপুরিই বেগম জিয়ার জেল থেকে পাঠানো নির্দেশাবলি অনুসরণ করেছেন। এর মানে কী? তাহলে কি বেগম জিয়াও তাঁকে এ কাজটি করতে বলেছিলেন? হাফিজের বক্তব্যের এই ডিরাইভেশানটি নিয়েও বিএনপির কোনও মতামত পাওয়া যায়নি।

হাফিজের আরও একটি অভিযোগ হলো এই যে, বিএনপিতে একটি মহল মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে ফেলতে চাইছে। এ বিষয়ে বিএনপির কী অবস্থান? যদি তাঁর মন্তব্যটির প্রতিবাদ করা না হয়ে থাকে তাহলে এ কথাটিও সঠিক হয়ে যায়। যদি হাফিজের এসব মন্তব্যের সঙ্গে বিএনপির কোনও সংযোগ না থেকে থাকে তবে তো তার জবাবকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত এবং দলের জন্য ক্ষতিকারক এসব মন্তব্য বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও হাফিজ আরও কিছু মন্তব্য করেছেন, যেগুলো বিএনপি’র মনোজগতকে তুলে ধরে। দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুধু বক্তৃতা দিয়ে হয় না; যুদ্ধ করতে হয়, এবং অনেক গোলাগুলির মধ্যে থাকতে হয়। আমার ধারণা, তাঁর এই বক্তব্যটি আসলে সে সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শনের নামান্তর, এবং এটি না করলে তাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে শুধুই কামান আর মেশিনগানের গোলাগুলি ছাড়া অন্য কোনও কিছুর সাথে মেলাতে পারেন না। এ অবস্থান থেকে বিএনপি ঘরানার সেনা কর্মকর্তা এবং পদকধারী মুক্তিযোদ্ধারা বেরুতে পারেন না। এর পেছনে রয়েছে ইতিহাসের প্রতি তাঁদের অসচেতনতা, অবজ্ঞা, এবং বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর জায়গায় প্রতিস্থাপনের অবান্তর ইচ্ছা।

হাফিজ কয়েকটি বই লিখেছেন একাত্তরের রণাঙ্গন নিয়ে। ১৯৯৭ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইটিতে তিনি অনেকটাই সুকৌশলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটির কথা এড়িয়ে গেছেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যদিও ২০২০ সালে প্রকাশিত বইয়ে তিনি রাজনৈতিক কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এখানেও আলাদাভাবে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আলোচনায় আসেননি; শুধু এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর আগে পর্যন্ত কোথাও এমনকি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের কথা আলোচনা করেননি হাফিজ। তাঁর একই অবস্থান প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে করা মন্তব্য থেকে। এই মন্তব্য প্রমাণ করে বিএনপি আসলে বঙ্গবন্ধুকে কখনোই তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেবে না। তাঁরা এটি ভুলে যান যে পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু যুদ্ধ দিয়ে কোথাও স্বাধীনতা আসেনি বা মানুষের মুক্তি ঘটেনি; যুদ্ধ এ ধরনের সংগ্রামের শেষ পরিণতি বা কৌশল মাত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপি’র অবস্থানই মূলত আওয়ামী লীগের সাথে তাদের দূরত্বের মূল কারণ এবং এটি না থাকলে বিএনপি’র রাজনৈতিক অবস্থানটির ভিত্তি থাকে না। হাফিজের অবস্থান আমাদের চোখে বিএনপির ইতিহাসবিরোধী অবস্থানটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

মেজর (অব.) হাফিজ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তিনি রাজনীতিতে আসলেই ‘আনকমফোর্টেবল’। আমি আগেই বলেছি, হাফিজ বড় গলায় অনেক কথা বলেছেন যেগুলো শুধু তাঁকে নয়, দল হিসেবে বিএনপিকেও নৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। যদিও এ নিয়ে বিএনপি’র তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিএনপিতে এক এগারো নিয়ে যে অস্বস্তি আছে তার একটি কারণ কিছুটা প্রকাশ হয়েছে মেজর (অব.) হাফিজের বয়ানে। এ ব্যাপারটি বিএনপির জন্য শুধু অস্বস্তিকর নয়, বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে এটি রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার একটি আলেখ্যও বটে।  

লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, এলিজাবেথ সিটি স্টেট ইউনিভার্সিটি (নর্থ ক্যারোলিনা)।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ