X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্ভরতার ছাদগুলো সরে যাচ্ছে!

রেজানুর রহমান
০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৩৪আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৩৪

রেজানুর রহমান আমাদের মাথার ওপর থেকে নির্ভরতার ছাদগুলো যেন এক এক করে সরে যাচ্ছে। অভিভাবকশূন্য হয়ে যাচ্ছি আমরা। জন্ম-মৃত্যু সবই সৃষ্টিকর্তার হাতে। কাজেই একদিন না একদিন পরপারের ডাক পড়বেই। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে এত এত গুণী মানুষের চলে যাওয়ায় বড্ড অসহায় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দেশের এক-একজন বিশিষ্ট মানুষ অর্থাৎ কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীর চলে যাওয়া মানেই মাথার ওপর থেকে নির্ভরতার একেকটি ছাদ সরে যাওয়া। যে ছাদগুলো আমাদের নানান সংকটে ছায়া দেয়, প্রেরণা জোগায়। ভালো কাজের প্রেরণা, সৎ-সুন্দর থাকার প্রেরণা। সৃষ্টিশীল কাজে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। সর্বোপরি দেশমাতৃকার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জন্মায় গুণী মানুষদের আদর্শ ও বিশ্বাসের দ্যুতি থেকেই। হতে চাই তাঁর মতো। ভালো মানুষদের আদর্শের টানেই এই স্বপ্ন শুরু হয়। আর তাই দেশের গুণী, ত্যাগী, সৎ মানুষেরা একেকজন একেকটি নির্ভরতার ছাদ হয়ে ওঠেন। যেমন দুরন্ত সাহস ও নির্ভরতার ছাদ হয়ে উঠেছিলেন দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের দ্যুতি ও সংগ্রামী জীবন দেশের অসংখ্য সাহিত্যকর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে অনগ্রসর নারীরা সৃষ্টিশীল নানা কাজের উৎস খুঁজে পেয়েছিল রাবেয়া খাতুনের সাহিত্যকর্ম থেকে। রাবেয়া খাতুন ছিলেন তাঁর অসংখ্য ভক্ত-পাঠকের কাছে নির্ভরতার ছাদ। সেই ছাদটিও সরে গেলো।

ঢাকার বিক্রমপুরে মামার বাড়িতে জন্ম মহীয়সী নারী বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগরের ষোলঘর গ্রামে। তাঁর বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ ও মা হামিদা খাতুন। রাবেয়া খাতুন প্রবেশিকা (মাধ্যমিক) পাস করেন ১৯৪৮ সালে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই বলে তিনি থেমে থাকেননি। অচলায়তন ভেঙেছেন। সাহিত্যের সকল শাখা যেমন উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথার মাধ্যমে তিনি পাঠকের মনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও সাহসের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছেন। ‘এলাম আর জয় করলাম’-এর মতো সাফল্য পাননি রাবেয়া খাতুন। কঠিন জীবন সংগ্রাম ছিল তাঁর। চরম বিপদেও ভেঙে পড়েননি। সংসার সামলেও চালিয়ে গেছেন সাহিত্যকর্ম। বুকে বিশ্বাস আর সাহস ছিল বলেই সাহিত্যকর্মসহ কঠিন জীবন সংগ্রামেও জয়ী হয়েছেন। রাবেয়া খাতুন একটি ইতিহাসের নাম। এই ইতিহাসটাই আমাদের নির্ভরতার ছাদ। এই ছাদটাও সরে গেলো।

লেখাটি যখন লিখছি তখন অজান্তে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা মনে পড়ে গেলো। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সবার প্রিয় শিক্ষক। সামনে দাঁড়ালেই বিনয়ে মাথা নত হয়ে আসতো সবার। এখনও বিশ্বাস হয় না বাঙালির চেতনার বাতিঘর সবার প্রিয় মানুষ আনিসুজ্জামান এখন আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি এখন না ফেরার দেশের বাসিন্দা। আমাদের নির্ভরতার এই ছাদটাও সরে গেছে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, কী যে এক মায়ার মানুষ ছিলেন। তিনিও আমাদের মাঝে নেই! আরও কত নাম– ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ, বিজ্ঞানী আলী আসগর, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দাত হুসাইন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, আজাদ রহমান, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বাবুল, রাজনীতিবিদ শাজাহান সিরাজ, ড. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, ভাষা সংগ্রামী ড. সাইদ হায়দার, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ, সাংবাদিক রশীদুন্নবী বাবু, শিক্ষাবিদ সুফিয়া আহমেদ, শিশুসাহিত্যিক আলম তালুকদার, অনুবাদক জাফর আলম, কথাসাহিত্যিক মকবুলা মনজুর, রাহাত খান, নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, নাট্যকার মান্না হীরা, রাজনীতিবিদ বদর উদ্দিন কামরানসহ আরও অনেক বিশিষ্টজন এখন আর আমাদের মাঝে নেই। সবাই এখন না ফেরার দেশের বাসিন্দা। আর আমরা হয়েছি অভিভাবকশূন্য। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত এত গুণী মানুষের চলে যাওয়ায় সীমাহীন শূন্যতা দেখা দিয়েছে। অভিভাবক না থাকলে একটা পরিবার দারুণ সংকটে পড়ে যায়। তেমনি দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের চলে যাওয়াও জাতীয় পর্যায়ে একটি বড় সংকট। এই সংকট নিরসনে সময় থাকতেই প্রস্তুতি শুরু করা জরুরি। এ কথা সত্য, জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো দ্বিতীয় কোনও গুণী ব্যক্তির আবির্ভাব সহসাই হয়তো আমাদের দেশে হবে না। সহসাই আরেকজন রাবেয়া খাতুন, রাহাত খানকে হয়তো আমরা পাবো না। কিন্তু তাদের আদর্শের শক্তিটাকে তো আমরা কাজে লাগাতে পারি। তরুণদের মাঝে দেশের গুণী ব্যক্তিদের সাফল্যগাথা আরও বেশি করে তুলে ধরা দরকার। যাতে তাদের মাঝে এই প্রতিযোগিতাটাই শুরু হয় যে, ‘হতে চাই তার মতো, তাদের মতো...।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্প্রতি তাঁর একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘জীবনের যে মূল্য কতখানি, আমরা এবার অনেকখানি বুঝেছি। নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের দুঃখ বুঝেছি। একটা বড় ধরনের আত্ম-আবিষ্কার অনেকেরই ঘটেছে। সেই জীবনকে যেন আমরা আরও উন্নতভাবে, উচ্চতরভাবে ব্যবহার করতে পারি, এটা হোক আগামী দিনের স্বপ্ন।’

যারা গেছেন না ফেরার দেশে, সেই দেশে আমাদেরও একদিন না একদিন যেতে হবে। কাজেই তাদের যেন আমরা ভুলে না যাই।

নতুন বছরে সবার জন্য অনেক শুভ কামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ