X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহ্য ভুলিয়ে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:০৬আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:০৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সম্প্রতি কুমিল্লা প্রেসক্লাবে একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। অনুষ্ঠানটি প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন সংক্রান্ত হলেও এমপি মহোদয় তার পুরো বক্তব্যে আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন কেন উন্নয়নের চেয়ে ঐতিহ্য বড় নয়। তিনি চান শত বছরের কুমিল্লা টাউন হল ভেঙে নতুন টাউন হল হোক। তার কথায় তাদের প্রতি অসন্তোষ, তিরস্কার ভরা ছিল- যারা ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলে এই টাউন হল ভাঙার বিরোধিতা করছেন। দুই একজন বলার চেষ্টা করছিলেন, আপনি নতুন একটা করেন আর পুরনোটা ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হোক। তবে তার চড়া গলার কাছে সেই কণ্ঠস্বর ছিল অতি ক্ষীণ।

ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপনা ভেঙে ফেলতে বা নষ্ট করে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই। এমপি বাহার বলেছেন, পুরনো টাউন হল ভাঙা হবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না। যেন একটা জেদাজেদির ব্যাপার।

এখন আমরা শুনছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসি ভবন ভেঙে সম্পূর্ণ নতুনরূপে তৈরি করা হবে। সেখানে বহুতল কমপ্লেক্স হবে। ষাটের দশকে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি কেন ভাঙতে হবে তার কোনও কারণ স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েছে কিংবা পড়েনি, সবার মন খারাপ হচ্ছে এই খবরে। কেউ ভাবতেও পারছে না, টিএসসি এমন আর থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এত স্তাবকের বাস যে, এরা জোর গলায় এর বিরোধিতাও করতে পারছে না।

আমাদের বহু দিনের পুরনো স্বভাব এটি। উন্নয়নের নামে যতটা নয়, আর্থিক লাভের কাছে আসলে চাপা পড়ে যায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন ধ্বংস করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া একশ্রেণির রাজনীতিক ও আমলার মধ্যে প্রবলভাবে আছে। এরই মধ্যে অনেক ঐতিহ্য মুছে গেছে মানচিত্র থেকে, সাম্প্রতিক সময়ে হুমকির মুখে পড়েছে টিএসসি, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও কুমিল্লা টাউন হল।

ঐতিহ্য বিনাশের আয়োজনে প্রথম যে দর্শনটি কাজ করে তার অন্যতম হলো বড় বাণিজ্যিক ভবন। মার্কেট করা, দোকান করা, কনভেনশন সেন্টার করা আর ভাড়া খাওয়া। স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন, ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহনকারী এবং ১৩৫ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক কুমিল্লা টাউন হলের ব্যাপারেও উদ্দেশ্য এটিই। রেলের মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কমলাপুর স্টেশন ঘিরে মাল্টিমোডাল হাব গড়ে তোলা হবে, যা শাহজাহানপুরসহ আশপাশের রেলের জায়গাজুড়ে বিস্তৃত হবে। শুনতে ভালো লাগলেও গভীরের উদ্দেশ্য হলো প্রকল্প করতে হবে, কারণ প্রকল্প মানেই অর্থের ছড়াছড়ি।


টিএসসি ভেঙে ফেলার আয়োজনেও উদ্দেশ্য এটি। বলা হচ্ছে আয়ের জন্য মার্কেট করতে হবে, এখন যা আছে তার চেয়ে বড় মিলনায়তন করা হবে, বড় আর আধুনিক ক্যাফেটোরিয়া থাকবে। কিন্তু এত প্রশস্ত মাঠ যে আর থাকবে না, উঠান থাকবে না, খোলামেলা পরিবেশটা উধাও হয়ে যাবে না, সেটা বলা হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা সেখানে গেলেই প্রশান্তি লাগে সবার– এই অনুভূতিটা যে হারিয়ে যাবে, সেটা বুঝবার সক্ষমতা নেই ভাঙার উদ্যোক্তাদের। তারা আকাশমুখী দালান চেনেন, কংক্রিট চেনেন কিন্তু ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে বুঝতে চান না।

রাজধানী ঢাকা বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই শহরের হৃদয়। টিএসসি বাংলাদেশের ছোট্ট সাংস্কৃতিক রাজধানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এবং অসংখ্য সংস্কৃতি কর্মীর মিলনকেন্দ্র টিএসসি গ্রিক স্থপতি কন্সতান্তিন এপোস্তলো ডক্সিয়াডিস-এর পরিকল্পনায় করা হয়েছিল। স্থপতি শাকুর মজিদ বলছেন, “এই কমপ্লেক্সের ডিজাইনার একজন মাস্টার আর্কিটেক্ট। ষাটের দশকে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে তিনি গোটা চারেক কাজ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র, কুমিল্লার বার্ড, হোম ইকোনমিক্স কলেজ, নায়েম– এই কমপ্লেক্সগুলো। তিনি বৃষ্টিবাদলের দেশের জন্য দিয়েছিলেন ঢালু ছাদ, দোচালা ঘরের কংক্রিটীয় রূপ। যেখানে ইটের ব্যবহার করেছেন, তা প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে না দিয়ে ইট দেখিয়ে দিয়েছেন। কংক্রিটের বীম, কলাম কংক্রিটের রূপে থেকেছে। টিএসসির মিলনায়তনের বাইয়ের সবুজ চত্বরে ছাত্রছাত্রীরা আড্ডা দেবে, তার জায়গা রাখা। করিডোরটাকে এমন প্রশস্ত করে রাখা যাতে সেটাও একটা আড্ডার জায়গা হতে পারে। আর মাঠ থেকে করিডোরের মেঝটাকে সেই উচ্চতায় রাখা যাতে এর প্রান্তটুকুও বসার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা যায়”।

কিন্তু আমরা জানি বড় বড় স্থপতি, পরিকল্পনাবিদরা যাই বলুন না কেন, শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্য ধ্বংসকারীদেরই জয় হবে। এদের সমর্থনে কিছু বুদ্ধিজীবীও পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, শাহবাগ থেকে টিএসসি ও বাংলা একাডেমি হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত একটা সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলা হবে। হুটহাট করে সরকারি আমলাদের দিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না করে সরকার কি পারে না আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের ডেকে এনে তাদের পরামর্শ নিতে?

একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে ঐতিহাসিক স্থাপনা। যেকোনও উন্নয়ন ভাবনার আগে এ বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা দরকার। এভাবে ভাঙতে থাকলে একদিন হয়তো শুনতে হবে যে লালবাগ কেল্লার জায়গায় হবে আধুনিক হাউজিং এস্টেট বা আহসান মঞ্জিলের স্থলে হবে মাল্টিস্টোরি কমপ্লেক্স।

ঐতিহ্যের প্রতি আধুনিকের বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী উন্নয়ন মানুষের হৃদয়কে ছুঁতে পারে না। সৃজনশীলতার মাধ্যমে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেই এগিয়ে চলে সমাজ, বিশেষ করে শহর। সেই সংযোগ তৈরি না হলে শহরের সৃষ্টিশীলতার যথার্থ স্ফুর্তি ঘটে না। এই সত্য অনুধাবন না করে বড় বড় ভবন বানানোর নামে ক্ষুদ্রের সাধনা আমাদের জন্য নিয়ে আসবে সংস্কৃতির বদ্ধদশা।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ