X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণঘাতী টিউমারের চেয়েও ভয়ংকর আওয়ামী লীগ?

রুমিন ফারহানা
০৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৯:৫৯আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ২০:০২

রুমিন ফারহানা ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবে না পালানোর জন্য। এটাই হলো সত্য কথা।’ এই সত্য কথা বলে সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছেন জনাব আবদুল কাদের মির্জা, যিনি একাধারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের ভাই এবং নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান। এ ধরনের সত্য কথা অবশ্য বেশ কয়েক বছর যাবৎ ক্ষমতাসীন দল আর তার সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ছাড়া দেশ-বিদেশের সবাই বলে আসছিলেন। তবে তা কানে তোলেনি সরকার। মুশকিল বাধলো যখন কথাটি বললেন খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাই।

সত্য বলার ব্যাকুলতায় তিনি নির্বাচন নিয়ে আরও যুক্ত করেন বলেছেন– প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, কিন্তু ভোটের অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি বন্ধ হয়নি। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোট অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি অবস্থান কর্মসূচিতে অনড় থাকবেন। কেউ পাশে না থাকলে প্রয়োজনে তিনি একা লড়ে যাবেন।

কথা মন্দ নয়, কিন্তু কেমন কেমন জানি লাগে। টানা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা দিলো কে? নির্বাচন কমিশন? প্রশাসন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? দলীয় ক্যাডার? নাকি ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ স্টাইলের যুগপৎ কর্মযজ্ঞ?

তার এই বক্তব্য যে হঠাৎ উত্তেজনাপ্রসূত রাগের মাথায় দেওয়া নয় তার প্রমাণ পরবর্তীতেও বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। শুধু তা-ই না, তিনি আরও কিছু কথা যুক্ত করেন, যা আওয়ামী লীগের জন্য আরও বিব্রতকর।

তিনি বিবিসিকে আরও বলেন, ‘আমার বক্তব্য হচ্ছে, যে গণতন্ত্র থেকে আজ মানুষ বঞ্চিত, যে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত, এটা পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি মনে-প্রাণে, জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবেন, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারবেন।’

‘সেজন্য আমরা এই পৌরসভা থেকে শুরু করতে চাই যে আমার ভোট আমি দেবো, যাকে ইচ্ছা তাকে দেবো, এটা নিশ্চিত করার জন্য সকল প্রস্তুতি নিয়েছি।’

‘আসলে আমাদের দেশে এখন যে নির্বাচনগুলো হচ্ছে, তার বেশিরভাগই অনিয়ম অতি উৎসাহীরা করছে। যেখানে যার অবস্থান আছে, দৈহিক বল আছে, যাদের সমর্থন আছে, তারাও জিতছে, কিন্তু দৈহিক বলটা অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’

‘আমার টার্গেট হচ্ছে একটাই। সেটা হচ্ছে তিন বছর পরে আমরা আবার নির্বাচনে অবতীর্ণ হবো। এখনও তিন বছর সময় আছে। যদি আমাদের লোকজন, যারা এই অনিয়মগুলো করতেছে, তাদের এটা থেকে সরানো না যায়, যদি বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন না হয়, তাহলে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো না। এটা আমার ব্যক্তিগত কথা।’

তাহলে এখন যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, যে এমপিরা নির্বাচিত হয়েছেন, সেগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি বলেই আপনার ধারণা -বিবিসির এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশই হয়নি। গতবারের নির্বাচনটা অতি উৎসাহীদের হাতে ছিল। শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাকে গাছটা দাও, তারা পাতা-টাতাসহ দিয়েছে।’

দেশে ২০১৪ সালের পর থেকে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, নির্বাচন নিয়ে দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি ছাড়াও সুজন, টিআইবি, মহাজোটের শরিক দল, বাম মোর্চা, বিদেশি গণমাধ্যম, বিদেশি পর্যবেক্ষক, এরপর এবার খোদ আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই আওয়াজ এলো। তিনি অবশ্য আশাবাদী। নির্বাচন ব্যবস্থার ‘কবর রচনা’র পর পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু করার মধ্য দিয়ে আবারও একটি নবযাত্রার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

তার আরেক সত্য ভাষণ আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রমাণ দেয় আমাদের কাছে। তিনি বলেন, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমদের ছোট ভাই জাবেদ (মিনহাজ আহমেদ জাবেদ)। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনও কোনও নেতা তখন (এক-এগারোর সময়কালে) নিজেদের রক্ষা করেছেন। এখন সেই জাবেদ এবং হাওয়া ভবনের মানিক (আতাউর রহমান ভূঁইয়া ওরফে মানিক) আজ জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি। অথচ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিনের মতো ত্যাগী ও নির্যাতিত ব্যক্তিকে করা হয়েছে উপদেষ্টা। এটা হলো আমাদের কমিটি।’

আওয়ামী লীগে হাইব্রিড বা ‘কাউয়া’ ঢোকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলটির সর্বোচ্চ নেতারা কথা বলছেন। তাদের কথার ঢং এমন যে, মনে হয় তারা এটা কখন, কীভাবে ঘটে তার ব্যাপারে কিছু জানেন না, বোঝেন না। জনাব কাদের মির্জা চোখে আঙুল দিয়ে সেটা তো দেখিয়েছেনই; সাথে প্রমাণ করেছেন আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হাইপোথিসিস- এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল’ বলা আওয়ামী লীগ আসলে সেই সরকারের একটি ‘এক্সটেনশন’। দেশের রাজনীতিতে জেনারেল মাসুদ উদ্দিনের পর জেনারেল ম‌ঈন ইউ আহমেদের ভাই এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা সেটা আবার প্রমাণ করলো।

জনাব কাদের মির্জা যা যা বলেছেন সেগুলো যে আওয়ামী লীগের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার মনের কথা সেটাও প্রমাণ হলো এবার। জেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনাম চৌধুরী দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় দৈনিক‌কে বলেন, আবদুল কাদের মির্জা যেসব কথা বলছেন, অভিযোগ করেছেন, তার কোনোটিই মিথ্যা নয়।

অনেকের কাছে অবাক লেগেছে, মনে প্রশ্ন জেগেছে, হঠাৎ এত সত্যকথন কেন জনাব কাদের মির্জার? এর জবাব‌ও তিনি দিয়েছেন। কিছু দিন আগে দুটি টিউমার শনাক্তের পর আমেরিকা থেকে চিকিৎসা করিয়ে জীবন নিয়ে ফেরার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সব সময় সত্যি কথা বলবেন।

তবে আওয়ামী লীগের মতো দলের ভেতরে থেকে অতি সত্যকথনের অবশ্যম্ভাবী ফল যা হওয়ার কথা ছিল তা-ই হয়েছে। তার বয়ান মতে, ‘মূলত নোয়াখালী, ফেনী ও সন্দ্বীপ থেকে আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ফেক আইডি, মোবাইলের মাধ্যমে, বিভিন্ন মানুষের কাছে এসব হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। আমি যাদের বিরুদ্ধে বলছি তারাই মূলত এগুলো করছে। বিশেষত বৈঠক করে আমাকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। গতকাল আমার অনেক লোক এ নিয়ে কান্নাকাটি করেছেন। আমার আত্মীয়-স্বজনও কান্নাকাটি করছেন। যাদের ফেনীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তারা শুনেছেন যে আমার বিরুদ্ধে বৈঠক করা হচ্ছে। সেখানে আমাকে মারার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে ।”

হুমকি যে বেশ শক্ত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, এর পরপরই দেখলাম নিজের বক্তব্য থেকে পুরোপুরি সরে গিয়ে তিনি বলছেন, তার কথা নিয়ে একটি ‘কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে’। আর তিনি যা বলেছিলেন, তা শুধু স্থানীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট নিয়ে, তা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নয়। তার ভাষায়, ‘কোনও কোনও গণমাধ্যমে সেগুলো বিস্তারিত উল্লেখ না করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্যের খণ্ড অংশবিশেষ প্রকাশ করেছে। আমি শুধু বৃহত্তর নোয়াখালীর আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ে নানা অনিয়মের কথা বলেছিলাম। জাতীয় ইস্যুতে আমি কোনও বক্তব্য রাখিনি।’

এখন নোয়াখালীর ‘আঞ্চলিক রাজনীতি’তে এমপি নির্বাচন কী করে আসে সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য যে হুমকিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাইয়ের পরিবারে কান্নার রোল পড়ে, সেই হুমকিতে জাতীয় নির্বাচন আঞ্চলিক হয়ে যাবে এ আর তেমন বেশি কথা কী?

দীর্ঘদিন সত্য কথা বলেননি কিংবা সত্য গোপন করে রেখেছিলেন জনাব কাদের মির্জা। প্রাণঘাতী টিউমার থেকে জীবন নিয়ে ফেরা তাকে সত্য বলিয়েছে। কিন্তু তার দলটি আওয়ামী লীগ, তাই তার পক্ষে ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’ হয়ে থাকা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি; তিনি ফিরে যাচ্ছেন তার আগের অবস্থানেই। অচিরেই হয়তো তিনি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যবস্থা না বললেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করবেন। অবাক হইনি, কারণ এটাই হওয়ার কথা ছিল। এই জাতি জানে, প্রাণঘাতী টিউমারের চাইতেও ভয়ংকর আওয়ামী লীগ।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ