X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যের ভূত যেন ভ্যাকসিনে চেপে না বসে

সালেক উদ্দিন
সালেক উদ্দিন
০৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৪১আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:০২
সালেক উদ্দিন গেলো বছরের প্রায় পুরো সময়টাই পৃথিবীর অগ্রযাত্রাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল কোভিড ১৯। করোনাভাইরাসের এই প্রকোপে প্রকম্পিত পৃথিবীতে আশার আলো দেখাচ্ছে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন। করোনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে এরইমধ্যে বিশ্বজুড়ে করোনা প্রতিরোধের ২৩৩টি ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ চলছে, যার মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে ৬১টি। ফাইজার বায়োএনটেক এবং অতি সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রোজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন মাত্র ১১ মাসের চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম করেই তার প্রয়োগ চলছে। এটা একটা বিরাট সাফল্য। কারণ, ইবোলার ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়েছে ৪৩ বছরের গবেষণায়। স্প্যানিশ ফ্লুর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে লেগেছিল ২৫ বছর। ৩৯ বছরের গবেষণায় এইচআইভি বা এইডসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি এবং সার্সের ভ্যাকসিন আবিষ্কার সম্ভব হয়নি ১৭ বছরেও।

এরইমধ্যে জরুরি ব্যবহারের জন্য ফাইজার বায়োএনটেকের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনকে তালিকাভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, কাতার, বাহরাইন, সৌদি আরব ও মেক্সিকোতে এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। পৃথিবীর এই ধনী দেশগুলো ফাইজার ভ্যাকসিনের ৯৬ শতাংশ কিনে নিয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশে তা পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার অনেক সংগঠন। ঠিক এমন একটি সময়ে ২০২০-এর শেষলগ্নে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ‘কোভিশিল্ড’ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও ভারত। আশার আলো জ্বলেছে বাংলাদেশের ঘরে। কারণ, ভ্যাকসিনটির অন্যতম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে বাংলাদেশ আগাম ৩ কোটি ডোজ  কিনে রেখেছে, যা পর্যায়ক্রমে দেড় কোটি মানুষের দেহে প্রয়োগ করা যাবে।

এই ভ্যাকসিন নিয়ে ৪ ও ৫ জানুয়ারির দুদিন পত্রপত্রিকায় যে খবরগুলো প্রকাশ হচ্ছে তাতে  সৃষ্টি হয়েছে এক গুমোট পরিস্থিতি। পত্রিকায় দেখছি, ডাক্তার জাফরুল্লাহ সাহেব বলেছেন, ‘ভারত টিকা পাচ্ছে ৩ ডলারে, আমরা সোয়া ৫ ডলারে কেন?’ আবার পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে ‘করোনার ভ্যাকসিন রফতানি না করার সিদ্ধান্ত ভারতের’। সঙ্গে সঙ্গেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বের হচ্ছে আরেক শিরোনামের খবর- ‘ভারতের সঙ্গেই ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ’। এই খবরে স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকেনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, 'টিকা কবে আসবে বলতে পারছি না'। আবার অনিশ্চয়তা। এমতাবস্থায় বেক্সিমকোর এমডি কিছুটা ‘ক্ষেপে’ গিয়েই বললেন, ‘সেরামের সঙ্গে চুক্তি জি টু জি নয়, বাণিজ্যিক’। এরকম একটি পরিস্থিতিতে স্বস্তির বার্তা নিয়ে এলো ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হলো ‘বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভ্যাকসিন পাবে’।

সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী জানালেন, ‘ভারত থেকে সব দেশেই করোনা ভ্যাকসিন রফতানির অনুমতি দেওয়া আছে’।

সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, ‘সরকার এবং অনেক প্রতিষ্ঠান এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকায় ভ্যাকসিন আসতে হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে। এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। অন্য কোনও পণ্যের মতো নয়।’

যাহোক, এত কিছুর পরও ধরে নিচ্ছি যথাসময়েই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আসবে।

এই ভ্যাকসিন যথার্থ কারণেই করোনাযুদ্ধের সম্মুখ সারির যোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবেন। এ নিয়ে কারও কোনও  দ্বিমত নেই। প্রশ্ন হলো জনসাধারণ কীভাবে এই ভ্যাকসিন পাবে? আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতিতে যে বহুল সমালোচিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাস্থ্যের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। কোনও সরকারের আমলেই এই খাতে দুর্নীতি কম ছিল না। এমনকি করোনাকালে যখন মানুষ মৃত্যু ভয়কে সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষ করেছে তখনও স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির এক্সপ্রেস ট্রেন চলেছে দ্রুতগতিতে। বছরজুড়েই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। করোনার মতো একটি মৃত্যু ব্যাধির মাস্ক ও পিপিই কেনাকাটায় দুর্নীতিতে স্বাস্থ্য কর্মীদের মৃত্যু ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল, করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বেরিয়েছিল অনেকের।

আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই অস্বাস্থ্যকর দিকটা এ দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। সম্ভবত এ কারণেই ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে যেন নতুন কোনও অনিয়ম না হয় তার জন্য সতর্ক থাকতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এজন্য সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে জেলা সরকারি হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

সরকারি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে করোনার ভ্যাকসিনের বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে যে কথাটি বলতে হয় তা হলো, দেশের সরকারি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য সরকার বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করে থাকে। চিকিৎসা গ্রহণকারীরা ক’জনে এই ওষুধ পায় তার হিসাব করে দেখেছেন কি?  অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায় না। তবে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী যায় কোথায়?  দুর্নীতির সে আরেক আখড়া! জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যেতে হবে না, রাজধানী ঢাকায় একটি সরকারি হাসপাতালের কথা বলবো।  হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কায় প্রথমেই যে সরকারি হাসপাতালের কথা মনে পড়ে আমি সেটির কথাই বলছি। আমার বুকে ব্যথা। ত্বরিত চলে গেলাম সেখানে। ইসিজি হলো। এরপর রক্ত পরীক্ষার পালা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর অনেকটা অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি শেষে আমার ব্লাড সংগ্রহ করলেন তারা। রক্ত বন্ধের জন্য আমার হাতে এক টুকরো তুলো দিয়ে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। একটি ব্যান্ডেজও ছিল না তাদের কাছে। ছিল না ঠিক নয়, কখনোই থাকে না। এসব যায় কোথায়?  উত্তর সহজ- ‘দুর্নীতির বাঘে খায়’। সরকারি ওষুধপত্রের সঙ্গে সবই বিক্রি হয়ে যায় বাইরের দোকানে! এটা শুধু নির্দিষ্ট একটি হাসপাতালের নয়, সারা দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মানচিত্র বলা যেতে পারে।

ভয় হচ্ছে, করোনার ভ্যাকসিনের যেন সে দশা না হয়। যে দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধও নকল হয়, সরকারের ছত্রছায়ায় করোনার মতো মরণব্যাধির মাস্ক ও পিপিই ‘দুই নম্বরি’ হয়, আরিফুল হক, ডাক্তার সাবরিনা, শাহেদ করিমরা করোনা পরীক্ষায় নয় ছয় করে অর্থশালী হওয়ার সাহস পায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালকও অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকা কামাতে বাধাপ্রাপ্ত হয় না, সেখানে সবই সম্ভব।

সরিষায় যদি ভূত থাকে তবে সেই সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না। এর জন্য প্রয়োজন ভূতমুক্ত সরিষা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়গুলো নিয়ে আরও ভাববেন এবং করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে যেন বাণিজ্যের সুযোগ কেউ না পায় সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন– সেটাই জাতির প্রত্যাশা। খেয়াল রাখতে হবে- স্বাস্থ্যের সেই পুরনো ভূত যেন করোনা ভ্যাকসিনের ঘাড়ে চেপে না বসে। করোনাকালীন লকডাউনের সময়ে হতদরিদ্রদের সাহায্য প্রদান ছিল সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। এই কর্মসূচি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রভাবশালী একটি শ্রেণি কীভাবে তা আত্মসাৎ করেছে সেটা পত্রপত্রিকার বদৌলতে আমরা অবগত আছি এবং ভয় পাচ্ছি এই ভেবে যে, ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি না হয়। যদি হয় তবে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন ভ্যাকসিন ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত উভয়ের ক্ষেত্রেই এমন শাস্তির বিধান থাকবে, যা দেখে আর কোনোদিন এর পুনরাবৃত্তি করার সাহস কেউ না পায়। প্রয়োজনে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও প্রয়োগ ব্যবস্থাপনায় দেশের সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করা হোক।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক
এমওএফ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ