X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘নাপিতকে বিয়ে করেছেন নারী চিকিৎসক’: সত্যিই লজ্জিত আমি

ডা. জাহেদ উর রহমান
০৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৫৬আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৫৬

চুলে ‘বখাটে কাটিং’ দেওয়া যাবে না– এই মর্মে সেলুন মালিক ও নরসুন্দরদের লিখিত নির্দেশনা দিয়েছিল মাগুরা জেলা পুলিশ বছর খানেক আগে। ‘বখাটে কাটিং’ কাকে বলে তার একটা সংজ্ঞাও তারা দিয়েছিলেন সেই সময়– একশ্রেণির যুবক চুল এমনভাবে কাটেন যে তাদের দুই কানের ওপরের অংশে চুল থাকেই না। কিন্তু মাথার ওপরের অংশে ঘন চুল থাকে। এই চুল বেশ দীর্ঘ হয়। হাঁটার সময় কিংবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় এই চুল বাতাসে দুলতে থাকে।

সেই সময় অন্য একটি দৈনিকে এটা নিয়ে কলাম লিখে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে ক্রমাগত ঢুকে পড়তে থাকলে এতটাই ঢুকে পড়তে পারে, যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এজন্যই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে কতটুকু প্রবেশ করতে পারবে সেটার একটা শক্ত চৌহদ্দি ঠিক করে দেওয়া জরুরি। গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিহাসে এই চৌহদ্দি কতটুকু সেটা মোটামুটি ঠিক করাই আছে।

মাগুরার ঘটনাটি এবং এ প্রসঙ্গে আমার কলামটির কথা মনে পড়লো সাম্প্রতিক একই ধরনের আরেকটি অতি আলোচিত ঘটনা দেখে। এ ঘটনার সঙ্গেও জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুলিশ। চিকিৎসক হয়েও একজন নারীর একজন নাপিতকে বিয়ে করার ‘অপরাধে’ স্বামী সন্তানসহ সেই চিকিৎসককে ধরে এনে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করেছেন রংপুরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাস।

সেই সংবাদ সম্মেলনে মিলু মিয়া বিশ্বাস যা বলেছেন তাতে বোঝা যায় তিনি বিশ্বাস করেন, একজন নাপিতকে বিয়ে করায় নারী চিকিৎসক অন্যায় করেছেন। স্বাধীনতা আছে বলেই তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন না। তিনি শুধু পরিবার নয়, চিকিৎসক সমাজকে লজ্জায় ফেলেছেন।

সংবাদ সম্মেলনের তিনদিন পর এবং এত আলোচনা-সমালোচনার পরও মিলু মিয়া বিশ্বাস দাবি করেছেন, পুলিশ যা করেছে ঠিক করেছে। তিনি ২৬ ডিসেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকাকে বলেন, উনি ভালো চিকিৎসক। তিনি ঢাকায় তিন জায়গায় রোগী দেখতেন। যাকে তিনি বিয়ে করেছেন, তিনি লেখাপড়া জানেন না। চিকিৎসকের বাবার ফুটফরমাশ খাটতেন।
এ বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে হলো কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাজের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য দরকার ছিল। চিকিৎসকের বাবার কথা ভাবতে হবে। তিনি এত কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছেন, চিকিৎসক বানিয়েছেন, তার কথাও তো ভাবতে হবে।

এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সামাজিক মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার পরও তিনি তার অবস্থানে অটল আছেন। এটাও আমরা স্মরণ রাখবো তিনি কোনও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা নন, রীতিমতো একজন পুলিশ সুপার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস‌ পাস করার পর চিকিৎসক হিসেবে পেশা আর কন্টিনিউ করিনি আমি, কিন্তু তারপরও নিজে একজন চিকিৎসক তো বটেই। এই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গটি আনলাম এ কারণ যে মিলু মিয়া বিশ্বাস মনে করেন নাপিতকে বিয়ে করে আলোচ্য নারী নাকি চিকিৎসক সমাজকেই লজ্জায় ফেলেছেন। মানে আমারও লজ্জিত হওয়া উচিত এই ‘বীভৎস কাণ্ডে’। লজ্জিত আমি বটেই, তবে সেটা মোটেও সেই কারণে না, যেটা ওই পুলিশ অফিসার বলেছেন।

এমন একটা সমাজে আমাদের বসবাস, যেখানে আজও কাজকে সম্মান করি না আমরা। কোনও দক্ষতা, কিংবা স্রেফ শ্রম বিক্রি করে সৎ উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করা মানুষ আমাদের কাছে সম্মানিত না আজও। এই সমাজে বহু ‘উঁচু’ পদে চাকরি করা বা বড় ব্যবসা করা ‘শিক্ষিত’ মানুষ বেশি সম্মানের ভাগীদার হন। না, এতেই শেষ হয়নি, আমাদের পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি বীভৎস- ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা,‌ অসৎ ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপিদেরও শুধু টাকা থাকার কারণে আমাদের বর্তমান সমাজে মর্যাদার আসনে বসানো হয়, ঘৃণা করা দূরেই থাকুক।

৩৪ বছর বয়স্ক একজন যথেষ্ট পরিণত আত্মনির্ভরশীল নারী, যিনি একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, তিনিও এই পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী সমাজ থেকে মুক্ত হননি। তার স্বেচ্ছায় বিয়ের ঘটনায় তার বাবা অপহরণের মামলা করেছিলেন। এই সমাজে এই একবিংশ শতাব্দীতেও একজন উচ্চশিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী স্বাধীন হন না।

একজন প্রতিষ্ঠিত পুরুষ ডাক্তার যদি এই সমাজের চোখে তার সঙ্গে মেলে না এমন কাউকে (গৃহকর্মী কিংবা গার্মেন্টকর্মী) বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে কিন্তু সমাজের এত বেশি আসে যায় না। তেমন ঘটনার পর ডাক্তারের বাবাও পুলিশকে অভিযোগ করতেন না, আবার সেই পরিবারকে ধরে এনে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ নিশ্চয়ই সমাজের ‘চোখ খুলে দেওয়ার’ চেষ্টা করতো না।

সংবিধান মতে, এই দেশে কোনও সরকারি কর্মকর্তা নেই, যা আছে তা হচ্ছে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’। জনগণের করের টাকায় (বহু ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে ঘুষ যুক্ত হয়) প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা এখন এমন পর্যায়ে গেছেন যে তারা এখন মানুষকে বীভৎস রকম হয়রানি করে।

যথেষ্ট দায়িত্বশীল পদে কাজ করা এই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী জানেন না তিনি আসলে যা করছেন সেটা আদতে সমাজের চোখ খুলে দেওয়া না, চোখ তুলে নেওয়া। আর যদি জেনে বুঝে করে থাকেন এসব সেটা আরও বীভৎস।

আমি আসলেই লজ্জিত। এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে লজ্জিত। আমার এই লজ্জা এ কারণে যে স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দিলেও আমাদের দেশে এখনও এমন একটা সরকার ব্যবস্থা এবং সমাজ আছে, যেখানে আজও আমাদের সমাজে এই আলোচনা হয়, সমাজের চোখে একজন শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মানুষ সমাজের চোখে নিচু কোনও পেশার মানুষকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি এজন্য লজ্জিত যে শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও একজন নারীকে এই সমাজ এখনও ‘মেয়েমানুষ’ বানিয়ে রাখতে চায়। আমি এ কারণেও লজ্জিত যে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর এই শিক্ষা এখনও নেই যে কোন কথাটা একটা গণতান্ত্রিক দেশে বলা যায়, আর কোনটা যায় না।

প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের এই অবস্থা দেখে আমি লজ্জিত কেন? আমি লজ্জিত এ কারণে যে এই সমাজ এই রাষ্ট্র কাঠামো এ জায়গায় থেকে যাওয়া এবং ক্রমাগত আরও পিছিয়ে যাওয়ায় দায় আছে এই সমাজে বসবাস করা প্রতিটি মানুষের। কেউ হাতে ধরে এই সমাজকে পিছিয়ে নিয়ে গেছেন, আবার কেউ বা প্রতিবাদহীন থেকে এই পিছিয়ে যাওয়াকে মেনে নিয়েছেন। আমি এই দায় স্বীকার করি এবং লজ্জিত হই প্রতিনিয়ত।

একজন নাপিতকে বিয়ে করায় ওই নারী চিকিৎসক সমাজকেই লজ্জায় ফেলেছেন বলে যে কথা এসপি মহোদয় বলেছেন, সে প্রসঙ্গে বলি, একজন চিকিৎসক হিসেবে এ ঘটনায় লজ্জিত তো নই, আমি গর্বিত। এই নারী সমাজের প্রচলিত অসভ্য কতগুলো ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সাহস করে সমাজের মুখোমুখি হয়েছেন। তাকে স্যালুট।

পাদটিকা: অপহরণ মামলায় ওই নাপিত ভদ্রলোক এখনও কারাগারে আছেন। সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রের চোখেও এরা ‘নিচুজাত’ তো বটেই।

এমওএফ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ