X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুরাকামির লেখক হওয়ার গল্প

অনুবাদ : দিলওয়ার হাসান
১২ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৩৩আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৩৩
খ্যাতনামা জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির আত্মজৈবনিক গ্রন্থের নাম ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং’। ক’বছর আগে আগে ‘দ্য নিউইয়র্কার’ পত্রিকায় ‘রানিং নভেলিস্ট’ নামে একটা আত্মজীবনীমূলক লেখাও বের হয়। এই লেখাটি ঐ বইয়ের অংশ কিনা পত্রিকাটিতে তার উল্লেখ নেই। লেখাটাতে দৌড়ের প্রসঙ্গ জোড়ালোভাবে এলেও এটি আসলে মুরাকামির লেখক হয়ে ওঠারই গল্প। মূল জাপানি থেকে লেখাটা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। মুরাকামি জন্মেছেন ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি। আজ জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখাটি প্রকাশ করা হলো।

 

প্রতিদিন দৌড়ানোর কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট করে ১৯৮১ সালের শরতের কথা বলা যায় যখন আমার বয়স ৩৩।

এর বেশিদিন আগের কথা নয় যখন টোকিওর সেন্দাগায়া স্টেশনের কাছে আমার একটা জাজ ক্লাব ছিল। তখন পার্ট-টাইম চাকরি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, গ্রাজুয়েশন লাভের জন্যে প্রয়োজনীয় অনেকগুলো ‘ক্রেডিট’ তখনও বাকি। বস্তুত তখনও আমি একজন ছাত্র। সেই সময় কাকুবুঞ্জি স্টেশনের দক্ষিণের প্রবেশদ্বারের পাশে ক্লাবটি খোলা হয়। ক্লাবটা ওখানে প্রায় তিন বছর ছিল। তারপর যখন ওখানকার ভবনটিতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয় তখন টোকিও শহরের কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাই। নতুন জায়গাটা বেশি বড় ছিল না। আমরা একটা গ্রান্ড-পিয়ানো জোগাড় করেছিলাম তবে পঞ্চ বাদ্যযন্ত্রের উপযোগী যৌথ সঙ্গীত পরিবেশন করবার মতো যথেষ্ট জায়গা ওখানে ছিল না। দিনের বেলায় এটা ছিল কফিখানা আর রাতে বার। আমরা বেশ ভালো খাবার-দাবার পরিশেন করতাম গ্রাহকদের, আর সপ্তাহের শেষে লাইভ পারফরম্যান্স থাকত। তখনও টোকিও শহরে এ-ধরনের ক্লাব দুর্লভ ছিল, ফলে আমরা বেশ ভালো রকমের গ্রাহক ধরতে সক্ষম হয়েছিলাম, আর জায়গাটা আর্থিক দিক থেকেও ছিল ভালো।

আমার অধিকাংশ বন্ধুর ধারণা ছিল ক্লাবটি সফলতা লাভ করতে পারবে না। তারা হিসাব করেছিল এইভাবে শখের বশে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সাফল্যের মুখ দেখতে পারবে না। তারা সন্দেহ করেছিল, আমার মতো সাদাসিধে আর কৌশলবর্জিত মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি সামান্যই আগ্রহ থাকে, ফলে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। বেশ, তাদের অনুমান ছিল অসার। সত্যি কথা বলতে কী, ব্যবসায় আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না একথা ঠিক। আমি শুধু একটা হিসাবই করেছিলাম, তা হচ্ছে ব্যর্থতার কোনো অপশন ছিল না, আমার যথাসর্বস্ব ওখানে ঢেলে দিয়েছিলাম। শক্তির জায়গাটা ছিল আমার পরিশ্রম আর সবকিছু কায়িক পরিশ্রম দিয়ে মোকাবিলা করতে পারি। রেসের-ঘোড়া ছিল না, ছিলাম কর্মপাগল ঘোড়া। নিত্যদিন পরিশ্রমে অভ্যস্ত নয় এমন পরিবারে থেকে এসেছিলাম বলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বেশি ধারণা ছিল না; কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমার স্ত্রীর পরিবার ব্যবসা চালিয়ে অভ্যস্ত ছিল, ফলে তার স্বতলব্ধ জ্ঞান আমাদের খুব কাজে লেগেছিল।

কাজকর্ম সত্যিই খুব কঠিন ছিল। সকাল থেকে রাত অবধি ওখানে থাকতাম আর পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তাম। সব রকমের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা আমার ছিল আর ছিল ভূরি ভূরি হতাশা। তবে কিছুদিন পর লাভের মাত্রা এত বাড়ল যে, লোকজন নিয়োগ করতে সক্ষম হলাম। শেষ পর্যন্ত সাময়িক বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগ এলো। ভালোভাবে শুরু করার জন্য যতদূর সম্ভব ব্যাংক থেকে ঋণ নিলাম আর এতদিনে সেই ঋণ পরিশোধের সক্ষম হলাম। সবকিছুই ঠিকঠাক হয়ে আসছিল। ওই পর্যায়ে এসে সাংঘাতিক রকমের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিল। আর কিছু নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল না। এখন মনে হয় অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে শীর্ষে পৌঁছেছি আর একটা মুক্ত এলাকা খুঁজে পেয়েছি। এখন আমার মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, যেকোনো রকমের নতুন সমস্যা সামলাতে পারব। আমি দীর্ঘ একটা শ্বাস নেই, যে সিঁড়ি এইমাত্র অতিক্রম করেছি তার নিচে তাকাই আর এরপর কী করণীয় তা নিয়ে ভাবতে বসি। তখন বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই। সেই বয়সে এসে উপনীত হচ্ছি যখন কাউকে আর যুবক বলে গণ্য করা যায় না। একদিন আকস্মিকভাবেই আমার ভেতর উপন্যাস রচনার প্রেরণা এল।

সেই মুহূর্তটির কথা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলতে পারব। সেটা ছিল ১৯৭৮ সালের ১লা এপ্রিল বেলা ১টা ৩০ মিনিট। জিংঘু স্টেডিয়ামে বসে বেসবল খেলা দেখছিলাম। সেই সময় স্টেডিয়ামটা ছিল আমার বাসা থেকে হাঁটা-পথ। আমি ছিলাম ইয়াকুল্ট সোয়ালো দলের একজন ঘোরতর সমর্থক। বসন্তের চমৎকার একটা দিন ছিল সেই সেটি, মেঘমুক্ত আকাশ, উষ্ণ বাতাস বইছিল। সে সময় বহির্মাঠের বসবার জায়গায় কোনো বেঞ্চ-টেন্স ছিল না, ঘাসের একটা ঢালু জায়গা ছিল মাত্র। ঘাসের ওপর শুয়েছিলাম, ঠান্ডা বিয়ার খেতে খেতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর খুব করে উপভোগ করছিলাম খেলাটা। অন্যদিনের মতোই স্টেডিয়ামে তেমন একটা ভিড় ছিল না। সিজনের প্রথম খেলা ছিল সেটা। সোয়ালো হিরোশিমা কার্পের মুখোমুখি হয়েছিল। সোয়ালোর পক্ষে বল নিক্ষেপ করেছিল তাকেশি ইয়েসুদা। বেঁটে-খাটো খেলোয়াড়। চাতুর্যপূর্ণ বাঁকা বল করে। প্রথম ইনিংসের শীর্ষ খেলা সে অনায়াসে সম্পন্ন করল। স্বল্প দূরত্ব থেকে ব্যাট করে এমন ব্যাটসম্যান ছিল সেয়ালো দলের ডেভ হিলটন, দলে নতুন এসেছে এমন একজন মার্কিন খেলোয়াড়। হিলটন ব্যাট বলে লাগিয়ে মাঠের বাম প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়। ব্যাট-বলের সংঘর্ষের শব্দ সারা মাঠে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হিলটন খুব সহজেই প্রথমে পৌঁছে গিয়েছিল আর দ্বিতীয় বারের জন্যে অবস্থান আরও উন্নতি ঘটিয়েছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা চিন্তা আমার মাথায় এসে বিদ্ধ হয় : ‘তুকি জান কি’? আমি একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করতে পারি। এখনও স্পষ্ট স্মরণ করতে পারি সেই উদার আকাশ, অনুভব করতে পারি নতুন ঘাস, মন ভোলানো ব্যাটের শব্দ। মনে হয়েছিল আকাশ থেকে কোনো কিছু উড়ে এসেছে, সেটা যা-ই হোক না কেন, আমি গ্রহণ করেছিলাম।

‘ঔপন্যাসিক’ হওয়ার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না। কেবল একটা উপন্যাস লেখার তীব্র ইচ্ছা আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। কী লিখতে চাই তার বাস্তব কোনো ইমেজও আমার সামনে ছিল না, শুধু এইটুকু দৃঢ়তা মনের মধ্যে ছিল, আমি এমন কিছু নিয়ে হাজির হতে চাই যা দৃঢ়-প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। যখন টেবিলে গিয়ে বসে লিখতে শুরু করলাম টের পেলাম আমার কাছে কোনো ভালো কলমও নেই। অতএব, সিঞ্জুকির কিনোকুনিয়া স্টোর থেকে কিছু লেখার কাগজ আর পাঁচ ডলার মূল্যের একটা কলম কিনে নিয়ে এলাম। লেখালেখি বাবদ আমার যৎকিঞ্চিৎ বিনিয়োগ।

ওই বছরের শরতের মধ্যে ২শ’ পৃষ্ঠা হাতে লিখে শেষ করলাম। ওটা দিয়ে কী করব সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না; ক্ষণিকের প্রেরণার বসে লেখাটা সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘গুঞ্জোর’ নতুন লেখকদের প্রতিযোগিতার জন্যে জমা দিয়ে দিলাম। ওটার জন্যে তেমন কোনো যত্ন-আত্মিও নিলাম না, ভাবখানা আমার এমন ছিল—নির্বাচিত হলে হবে, না-হলে না হবে, কিংবা ওটা হাওয়া হয়ে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। লেখাটা আলোর মুখ দেখল কিনা তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না, কোনো মতে বইটা লিখে শেষ করার ব্যাপারে আমার বেশি আগ্রহ ছিল।

সেই বছর নিয়ত লাঞ্ছিত দল ইয়াকাল্ট সোয়ালোজ বিজয়ের পতাকা পেল আর জাপান সিরিজে হানকাইয়ু ব্রেডসকে পরাজিত করতে উদ্যত হলো। এতে আমি সাংঘাতিক রকমের উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম আর কারাকুয়েন স্টেডিয়ামের বেশ কয়েকটা খেলা দেখেছিলাম। (সত্যিকারভাবে, কেউ ভাবতেও পারেনি সেয়ালো জিতবে, তাদের নিজেদের ভেনু, জিংসু স্টেডিয়ামে কলেজ বেস বলে কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিল)। বিশেষভাবে ওই শরৎকালটা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। আকাশ ছিল পরিষ্কার, আর মেইজি মেমোরিয়াল গ্যালারির সামনে গিংকৌ গাছগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সোনালি মনে হয়েছিল, আগে তাদেরকে এত সোনালি রং ধারণ করতে দেখা যায়নি। ওটা ছিল আমার কুড়ির কোঠার যুবক-বয়সের শেষ শরৎ।

পরের বসন্তের মধ্যেই ‘গুঞ্জো’ পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে এই মর্মে একটা ফোন কল পাই যে, আমার উপন্যাসটি পুরস্কারের জন্যে হ্রষ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে; ততদিনে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওই প্রতিযোগিতার জন্য নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর কারণ, অন্যান্য বিষয় নিয়ে খুব ব্যস্ততার ভেতর ছিলাম। তবে উপন্যাসটি বিজয়ের মুখ দেখে ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ নামে প্রকাশ হয়েছিল। লেখাটিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। কী ঘটতে যাচ্ছে তা না জেনেই হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলাম, আমাকে সম্ভাবনাময় নতুন লেখক বলে অভিহিত করা হয়েছে। অবাক হয়েছিলাম। আমার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল আমার পরিচিত লোকজন।

এর পরে জাজ ক্লাব চালাতে-চালাতে আর একটা মাঝারি আকারের উপন্যাস লিখে শেষ করতে পেরেছিলাম যার নাম ছিল ‘পিনবল, ১৯৭৩’। তখন কয়েকটা ছোটগল্প লেখা হয়ে উঠেছিল। আর স্কট ফিটজেরাল্ড থেকে খানিকটা অনুবাদ করেছিলাম। ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ ও ‘পিনবল, ১৯৭৩’ সম্ভ্রান্ত পুরস্কার ‘আকুতাগাওয়া’র জন্যে মনোনীত হয়েছিল; কিন্তু কোনোটিই পুরস্কারটা পায়নি শেষ পর্যন্ত। এ জন্যে অবশ্য আমার কোনো পরোয়া ছিল না। পুরস্কারটা পেয়ে গেলে অনেক সাক্ষাৎকার আর লেখার আমন্ত্রণ পাওয়া যেত। আমার ভয় ছিল তাতে করে আমার জাজ ক্লাবের কাজে অনেক বিঘ্ন ঘটত।

তিন বছর আমি জাজ ক্লাবটি পরিচালনা করি— হিসাবপত্র ঠিকঠাক মতো রাখি, মালামালের হিসাব নিকেশ নেই, কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব পূণর্বণ্টন করি আর কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে ককটেল বানাই, রান্নার কাজ দেখি, ভোরবেলা ক্লাব বন্ধ করি। আর তখনই কেবল বাড়িতে গিয়ে কিচেন টেবিলে বসে লিখবার একটুখানি ফুরসত পাই; ঘুমে ঢুলুঢুলু না হওয়া পর্যন্ত লেখার কাজটা চালাতে পারি। মনে হয় আমার মধ্যে দুজন লোক বসবাস করছে। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করি আরও বিস্তৃত আকারের উপন্যাস লিখতে চাই। প্রথম দুখানি বই লেখার সময় লেখার পদ্ধতিটি উপভোগ করেছি। তবে দুটোরই অংশ বিশেষ লিখবার সময় খুশি হতে পারিনি। তখন শুধু একটুখানি সময় ছিনিয়ে নিয়ে মাথায় নতুন আসা ভাবনা চিন্তাগুলো মাত্র লিপিবদ্ধ করতে পারতাম। এখন আধাঘণ্টা, অন্য সময় আধাঘণ্টা এমনি করে সময় বের করতাম, কারণ সব সময় ক্লান্ত থাকতাম; মনে হতো সারাক্ষণ যেন ঘড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলেছি। কখনোই খুব ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পারিনি। এই ধরনের বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ও তরতাজা জিনিস রচনা করতে সক্ষম হই; কিন্তু তাতে ভালো কোনো ফল আসে না। উপলব্ধি করি ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্যে এই সুযোগ যতটা সম্ভব বেশি গ্রহণের সাধারণ ইচ্ছা আমার আছে। অতএব, অনেক চিন্তা ভাবনার পর ব্যবসা বন্ধ করে আমার সব প্রচেষ্টা লেখালিখিতে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ওই পর্যায়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে আমার আয়ের চেয়ে জাজ ক্লাবের আয় অনেক বেশি ছিল, এটা এমন একটা বাস্তবতা যা থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেই।

আমার অধিকাংশ বন্ধু-বান্ধব আমার এই সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধী ছিল, না হয় তারা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিল। তারা বলেছিল, ‘তোমার ব্যবসা তো বেশ ভালো চলছে, উপন্যাস লেখার কাজে যখন ব্যস্ত থাক তখন অন্য লোকদের ব্যবসা দেখার দায়িত্ব দাও।’ কিন্তু তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারিনি। আমি এমন ধরনের মানুষ যখন যা করি সেবিষয়ে আমার সবটুকু অঙ্গীকার থাকতে হয়। অঙ্গীকার থাকার পরও তা ব্যর্থ হলে তা মেনে নিতে পারি। জানতাম যদি কোনো জিনিস আধাখেচড়াভাবে করি আর তা যদি ঠিকঠাক মতো না হয় তাহলে দুঃখের অবধি থাকবে না।

অতএব, সবার আপত্তি উপেক্ষা করে ক্লাবটা বিক্রি করে দিয়ে খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে নিজেকে ঔপন্যাসিক বলে ঘোষণা করি। আমার স্ত্রীকে বলি, ‘মাত্র দুবছরের জন্যে লেখালিখির জন্যে অবকাশ পেতে চাই। এই প্রক্রিয়া কাজ না করলে অন্য কোনোখানে আর একটা ক্লাব খুলব। এখনও যুবক বয়স আমার, শুরু করার জন্যে নিশ্চয়ই সময় পেরিয়ে যাবে না।’ ওটা ছিল ১৯৮১ সাল, তখনও বেশকিছু ঋণ কাঁধে ছিল। তবে হিসাব করে দেখেছিলাম, ভালোই করতে পারব, দেখাই যাক না কী হয়।

অতপর, উপন্যাস রচনা করতে মনস্থির করি আর সেই শরতেই গবেষণাকর্মে হোক্কাইডো সফরে যাই। পরের এপ্রিলের মধ্যেই ‘অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ রচনা শেষ করি। আগের দুটোর চেয়ে এটি আকারের দিক থেকে বড় ও আরো বেশি গল্পনির্ভর। লেখাটি শেষ হওয়ার পর বেশ ভালো অনুভূতির সৃষ্টি হয় আমার ভেতর—একটা নিজস্ব শৈলী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এখন ঔপন্যাসিক হিসেবে আয় রোজগার করার জন্যে নিজেকে তুলে ধরতে পারব।

গুঞ্জোর সম্পাদক মূলধারার লেখার চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করছিলেন। ‘অ্যা ওয়াল্ড শিপ চেজ’ নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। তবে মনে হয়েছিল পাঠকরা বইটা পছন্দ করেছিল, যা কিনা আমার সুখের কারণ হয়। ঔপন্যাসিক হিসেবে ওটাই ছিল আমার চলার আরম্ভ।

পেশাদার লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর আর এক সমস্যা এসে দেখা দিল। শারীরিকভাবে নিজেকে কী করে ফিট রাখব। ক্লাব চালানোর সময় প্রতিনিয়ত কায়িক শ্রম দিতে হয়েছে। কিন্তু সারা দিন বসে বসে লেখার কারণে আমার ওজনও বেড়ে যাচ্ছিল। ধূমপানও খুব বেশি করছিলাম—রোজ ৬০টি সিগারেট। আঙুলগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছিল, আর ধোঁয়ায় শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করেছিল। এ-অবস্থা আমার জন্য মোটেও সুবিধার ছিল না। ঔপন্যাসিক হিসেবে যদি দীর্ঘজীবন চাই তাহলে শরীর ঠিক রাখার জন্য একটা পথ বের করতে হবে।

শরীরচর্চার অংশ হিসেবে দৌড়ের নানান সুবিধা ছিল। প্রথমত, এ-জন্য কারও সাহায্যের দরকার নেই, দরকার নেই বিশেষ কোনো সরঞ্জামের। বিশেষ কোনো জায়গায় যাবারও আবশ্যকতা নেই। একজোড়া রানিং সু আর ভালো একটা রাস্তা থাকলে প্রাণভরে দৌড়ানো সম্ভব।

ক্লাব বন্ধ করে দেয়ার পর জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে চাইলাম। স্ত্রীকে নিয়ে চীবা এলাকার নারাশিনোতে চলে গেলাম। তখন সেটা একেবারে গ্রামাঞ্চল, আশপাশের লেখাধুলার ভালো কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তবে এই এলাকার সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের একটা ঘাঁটি ছিল, রাস্তাঘাট ভালো রকম রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। নিহোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাশের একটা এলাকায় একটা প্রশিক্ষণ অঞ্চল ছিল। খুব সকালে ওখানে গিয়ে হাজির হলে আশপাশে কেউ না থাকলে রাস্তাটা ব্যবহার করতে পারতাম। কী কার্যক্রম নিতে হবে তা নিয়ে আমাকে খুব একটা ভাবতে হয়নি। কেবল দৌড়ে গেছি।

তার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ধূমপান ত্যাগেও সক্ষম হই। কাজটা সহজ ছিল না আমার জন্যে। তবে দৌড়ের সঙ্গে সঙ্গে ধূমপান চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। আমার দৌড়ানোর ইচ্ছা ধূমপানের উইথড্রয়াল সিমটম কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। যে-জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম তাকে বিদায় জানাতে ধূমপান ত্যাগের বিষয়টি একটি প্রতীকী মহিমা পায়।

স্কুলে জিম ক্লাস বা খেলাধুলার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ, ওসবে যেসমস্ত কাজকর্ম থাকত তা আমার প্রতি ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হতো। তবে যখন পছন্দমতো কোনো কাজ করতে চাইতাম তা মনপ্রাণ ঢেলে করতাম। যেহেতু আমি ক্রীড়াবিদ বা এধরনের কিছু ছিলাম না, কাজেই হঠাৎ করে গৃহীত কোনো কিছুতে ভালো করতে পারতাম না। দূরপাল্লার দৌড় আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বেশি মানানসই হতো, যা হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারে কেন আমি আমার রোজকার জীবনের সঙ্গে একে এত সহজে সংযুক্ত করতে পারি। একই কথা বলতে পারি নিজের সম্পর্কে ও পড়াশোনা সম্পর্কে। প্রাথমিক স্কুল পর্যায় থেকে কলেজ অবধি আমার গোটা শিক্ষাজীবনে এমন কিছু পঠন-পাঠনে আগ্রহী হইনি যা আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে আমার প্রাপ্ত গ্রেড এমন ছিল না যে লোকের কাছ থেকে লুকাতে হবে। এমন স্মৃতি নেই যেখানে কোনো কর্মকাণ্ডের জন্যে আমার প্রশংসা করা হয়েছে, যেমন ধরুন ভালো গ্রেড বা কোনো কিছুতে ভালো ফল প্রদর্শন। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহীত কোনো কিছু ছাড়া আমি পড়াশোনায় আগ্রহী হইনি যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি ‘সমাজের সদস্যতে’ পরিণত হয়েছি। কোনো বিষয়ে আমাকে আগ্রহী করে তুললে আর নিজের জায়গা থেকে পড়াশোনা করতে পারলে আমি জ্ঞান আহরণে যৌক্তিক রকম পারদর্শী হয়ে উঠতাম।

পেশাদার লেখক হয়ে ওঠার সবচেয়ে ভালো দিকটি ছিল—আগেভাগে বিছানায় যেতে পারা আর আগেভাগে উঠে পড়া। যখন ক্লাব চালাতাম তখন প্রায়শই ভোরের আগে শুতে পারতাম না। ক্লাব বন্ধ হতো রাত ১২টা নাগাদ। হলে কী হবে—কাজ থাকত; পরিষ্কার করতে হতো সবকিছু, রশিদ-টশিদ দেখতে হতো, তারপর আলাপ-আলোচনা করবার থাকলে সেরে নিতে হতো, অতঃপর রিলাক্সের জন্যে খানিকটা পান। এসব করতে করতে রাত ৩টা বেজে যেত, আর সূর্য তখন উঠি উঠি করত। প্রায়শই তখন কিচেন টেবিলে বসে লেখালেখি করতাম আর তখন ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠত। দিবসের কর্মকাণ্ড শুরু করার জন্যে উঠে পড়তে হতো, তখন সূর্য আকাশের অনেক উপরে থাকত।

ঔপন্যাসিক হিসেবে জীবন শুরু করার পর আমি ও আমার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেই সকাল-সকাল বিছানায় যাব আর সূর্য ওঠার আগেই শয্যা ত্যাগ করব। আমাদের কাছে ওটা ছিল আরও বেশি স্বাভাবিক ও সম্মানজনক পন্থা। আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, যেসব লোকের সঙ্গে আমরা দেখা-সাক্ষাৎ করতে চাই কেবল তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব আর যাদের সঙ্গে চাই না দেখা-সাক্ষাৎ করব না। আমাদের মনে হয়েছিল অন্তত কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও এই নম্র ইচ্ছে পূরণের ব্যাপারটা হতে দিতে হবে।

আমার এই নতুন সাধারণ আর দৈনন্দিন জীবনে সকাল ৫টায় ঘুম থেকে উঠতাম আর শুতে যেতাম রাত ১০টার আগে। ভিন্নভিন্ন ধরনের লোকের দিবসের ভিন্নভিন্ন সময় চমৎকার সময় থাকে। তবে আমি আদ্যপান্ত হয়ে উঠেছিলাম ভোরবেলাকার মানুষ। সেই সময়টাকে আমি উৎসবিন্দু হিসেবে ধরতে পারি। তারপর কী করব না-করব তা নিয়ে ভাবি আর টুকিটাকি কাজ সেরে ফেলি যার জন্যে খুব বেশি একটা মনোযোগ দেয়ার দরকার হয় না। দিনের শেষে বিশ্রাম নেই, পড়ি অথবা গান শুনি। ওই ছক আমাকে রাতের বেলায় তেমন একটা কিছু করতে দেয় না, কখনো কখনো অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা সমস্যা-সংকুল হয়ে পড়ে। ক্রমাগত নিমন্ত্রণ-টিমন্ত্রণ উপেক্ষা করলে লোকজন তো রাগ করতেই পারে। তবে ওই অবধি এসে আমার মনে হয়, অপরিহার্য সম্পর্ক তাদের সঙ্গেই গড়ে তোলা উচিত যারা নির্দিষ্ট কোনো মানুষ নয় বরং অনির্দিষ্টসংখ্যক পাঠক। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাজ একটা থেকে আর একটায় যেতে উন্নতি সাধন করবে ততক্ষণ আমার পাঠকবর্গ যে-জীবনই আমি বেছে নেই না কেন, তাকে স্বাগত জানাবে। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে সেটাই কি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়? পাঠকের চেহারা তো আমি দেখতে পাই না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে পাঠকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধারণাগত। কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ওটা আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অন্য কথায় বলতে গেলে, সবাইকে খুশি করা সম্ভব নয়।

যখন ক্লাব চালাতাম তখনও কথাটা অনুধাবন করতাম। অনেক খদ্দের আসত ক্লাবে। তাদের মধ্যে ১০ জনের ১ জনও যদি ওখানে এসে আনন্দ পেত তাহলেই তা যথেষ্ট হতো। ১০ জনের একজন যদি বারবার আসা খদ্দের হয় তাহলে ব্যবসা টিকে যাবে। কথাটা ঘুরিয়ে বললে এটা দাঁড়ায় যে, ১০ জনের ৯ জনও যদি ক্লাবটি অপছন্দ করে তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। এটা উপলব্ধি করার পর আমার কাঁধ থেকে একটা ভারী বোঝা নেমে যায়। এখনও আমাকে নিশ্চিত হতে হয় ওই একজন খদ্দের জায়গাটা সত্যিই পছন্দ করেছিল কিনা। আর তা করতে গিয়ে আমার দর্শন স্পষ্ট করে তুলতে চাই আর ধৈর্যের সঙ্গে মেনে চলতে চাই তা যা-ই হোক না কেন। ব্যবসা চালাতে গিয়ে এই শিক্ষাই আমি গ্রহণ করেছি।

‘অ্যা ওয়াল্ড শিপ চেজ’ লেখার পর আমি ব্যবসায়ী হিসেবে যা শিখেছিলাম সেই ধারাতেই লিখতে শুরু করি। আর প্রতিটি কাজেই ১০-এ ১ হারে আমার পাঠক সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই পাঠক, যাদের অধিকাংশই তরুণ, আমার পরবর্তী বই প্রকাশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে তারপর বইয়ের দোকানগুলোতে বিক্রিবাট্টা বেড়ে গেলে তা কিনে ফেলবে। এটাই হচ্ছে আমার জন্যে আদর্শ অবস্থা। নিদেনপক্ষে একটা স্বস্তিকর আবহ। যা লিখতে চাই তা-ই হুবহু লিখতে পারি। এ অবস্থায় যদি জীবনধারণ সম্ভব হয় তাহলে আমার আর কোনো চাওয়ার নেই। অন্য উপন্যাস ‘নরওয়েজিয়ান উড’ প্রকাশ হয়ে ২০ লাখ কপি বিক্রি হলে পরিবর্তন সামান্যই হয়, তবে এর পরে ১৯৮৭ সালে ওই পরিবর্তনকে বড়ই বলা যায়।

প্রথম যখন দৌড় শুরু করি বেশি দূর পর্যন্ত বা দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করতে পারতাম না। বিশ-ত্রিশ মিনিটের বেশি দৌড়ানোও সম্ভব হতো না। ওইটুকুতেই হাঁফিয়ে উঠতাম, বুক ধড়ফর করত আর পা ধরে আসত, কাঁপত। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যয়াম করাও সম্ভব হতো না। অন্যরা আমাকে দৌড়াতে দেখছে এটা ভেবেও প্রথম প্রথম অস্বস্তিতে ভুগতাম। কিন্তু যখন ভালো করে দৌড়াতে শুরু করলাম, আমার শরীর এটা মেনে নিচ্ছিল যে এটা ধাবিত হচ্ছে, আর আমি ধীরে ধীরে আমার সহিষ্ণুতা বাড়াতে পারছিলাম। সত্যিকার দৌড়বিদের গঠন লাভ করেছিলাম, নিশ্বাস-প্রশ্বাস আরও স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল, হৃদস্পন্দনও শান্ত হয়ে আসছিল। প্রতিদিনকার দৌড়ে গতি কিংবা দূরত্ব কোনো ব্যাপার ছিল না। যা ছিল তা হচ্ছে বাদ না দিয়ে প্রতিদিন দৌড়ানো।

অতএব, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, গৃহকর্ম আর লেখার মতো দৌড়ানোও আমার নিত্যদিনের রুটিনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ওটা যেহেতু সাধারণ অভ্যাসের পর্যায়ভুক্ত তা নিয়ে আমার কোনো অস্বস্তি ছিল না। একটা স্পোর্টস শপে গিয়ে খানকতক রানিং গিয়ার ও সুদৃশ্য কয়েক জোড়া জুতা কিনে ফেললাম। একটা স্টপওয়াচও কেনা গেল আর দৌড়ানোর ওপর একটা বই পড়তে লাগলাম।

এখন পেছন পানে তাকিয়ে দেখি, ভাগ্য আমার ছিল প্রসন্ন কেননা শক্তিশালী, স্বাস্থ্যসম্মত শরীরের অধিকারী ছিলাম। ফলে বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে আমার পক্ষে প্রতিদিন দৌড়ানো সম্ভব হচ্ছে। এর মধ্যে আবার বেশকিছু প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছিলাম। কোনো দিনই দৌড়াতে গিয়ে চোট পাইনি কিংবা আহত হইনি। আমি বড় কোনো দৌড়বিদ ছিলাম না, তবে নিঃসন্দেহে বলবান দৌড়বিদ ছিলাম। ওইসব প্রাপ্তিতে আমি গর্ব অনুভব করি।

১৯৮৩ সালে প্রথম আমি রোড রেসে অংশগ্রহণ করি। খুব বেশি পাল্লার দৌড় প্রতিযোগিতা সেটা ছিল না—মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। তবে সে-ই প্রথমবারের মতো আমার শার্টের পকেটে পিন দিয়ে নম্বর লাগিয়ে দেওয়া হয় আর আমাকে অধীর আগ্রহে অন্যান্য দৌড়বিদের সঙ্গে এই কথা শুনবার জন্যে প্রতীক্ষা করতে হয় ‘অন ইওর মার্কস, গেট সেট, গো’। পরে আমার মনে হয়েছে, ও হে, ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। ওই মে মাসেই লেক ইয়ামানাকার পাশে ১৫ কিলোমিটারের এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। জুন মাসে পরীক্ষা করার সাধ জাগে কতদূর দৌড়াতে পারি। তা আমি টোকিওর ইম্পেরিয়াল প্যালেস অবধি দৌড়ে গিয়েছিলাম। মোটামুটি সুন্দর পদক্ষেপে ২২.৪ মাইলের মধ্যে সাতবার দৌড়ে ছিলাম, পায়ে একটুও চোট লাগেনি। শেষে আমার ধারণা হয়েছিল ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেয়াও সম্ভব আমার পক্ষে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম ম্যারাথনের কষ্টকর অংশটুকু শুরু হয় ২১ মাইলের পর থেকে। (২৬-এর ম্যারাথন ইতোমধ্যেই শেষ করেছি আমি)।

আশির দশকের মাঝামাঝিতে তোলা আমার একটা ছবির দিকে তাকালে দেখা যাবে দৌড়বিদসুলভ শরীর-স্বাস্থ্য আমার ছিল না। বিস্তর দৌড়াইনি, প্রয়োজনীয় মাসল ছিল না; হাত দুটো ছিল ক্ষীণ আর পা বিশীর্ণ। এ কথা ভেবে মুগ্ধ যে, এ ধরনের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছি। (এখন অনেক দৌড়াদৌড়ির পর আমার মাসলের অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।) তদুপরি প্রতিদিনই আমার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হতো তা অনুভব করতাম, যা আমাকে সত্যিই সুখী করেছিল। অনুভব করেছিলাম আমার বয়স তিরিশের ওপরে হলেও শরীরের কিছু সম্ভাবনা তখনও ছিল। যতই দৌড়ানো গেছে ততই প্রাণশক্তি লাভ করা সম্ভব হয়েছে।

এসবের সঙ্গে আমার খাবার-দাবারও পরিবর্তন হয়ে গেছে। সবজির সঙ্গে মাছ খাওয়া শুরু করি যা ছিল আমিষের প্রধান উৎসব। মাংস কখনোই আমার পছন্দের খাদ্য ছিল না। ভাত ও মদ খাওয়া কমিয়ে দেই আর প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বেশি খাদ্য সংগ্রহ করি। মিষ্টি কোনো সমস্যা ছিল না, কেননা মিষ্টির প্রতি অনুরাগ কখনো ছিল না আমার।

যখন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি মনে হয় সহজে ওজন করা যায় এমন একটা শরীর আমার জন্যে লুকানো এক আশীর্বাদ। শরীরের মেদ যদি বাড়াতে না চাই তাহলে আমাকে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, কী খাই না-খাই তা খেয়াল রাখতে হবে আর রক্ষা করতে হবে সংযম। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে তাদের ব্যায়াম করার দরকার নেই, দরকার নেই কী খাচ্ছেদাচ্ছে সেদিকে তাকানোর। এ কারণে বয়স বাড়লে তাদের শারীরিক শক্তি হ্রাস পায়। ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা যাদের ভেতর আছে নিজেদের তাদের ভাগ্যবান বলে মনে করা উচিত, কেননা লালবাতি তারা স্পষ্ট দেখতে পায়। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, সবসময় সবকিছুকে এভাবে দেখা যায় না।

আমার ধারণা এই কথাটা উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও খাটে।যেসব লেখক মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন তারা অনায়াসে লিখতে পারেন, তারা যা-ই করুক আর না-করুক। প্রাকৃতিক ঝরনা থেকে নেমে আসা জলের ধারার মতো তাদের কলম থেকে বাক্যরা নেমে আসে। সামান্য চেষ্টা বা চেষ্টা না করেই তারা তাদের লেখার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেন। দুর্ভাগ্যবশত আমি ওই দলে পড়ি না। নিজের সৃজনশীলতা খুঁজে বের না করা পর্যন্ত আমাকে ক্রমাগত একটা ছেনি দিয়ে পাথরের গায়ে আঘাত করতে হয়েছে। যতবারই নতুন উপন্যাস শুরু করেছি ততবারই আমাকে অন্য একটা গর্ত খুঁড়তে হয়েছে। বহুবছর আমি এই জীবন সহ্য করে নিয়েছি। অতএব, পাহাড়ের গায়ে গর্ত তুলে ফেলা আর পাথরের স্তর দিয়ে বয়ে চলা পানি খুঁজে বের করবার ক্ষেত্রে আঙ্গিকগত ও শারীরিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠেছি। যখনই লক্ষ করেছি একটা উৎস মরে গেছে, আমি অন্যটায় চলে গেছি। মানুষ যদি মেধার প্রাকৃতিক উৎসে আস্থা রাখে, হঠাৎ সে আবিষ্কার করবে তার সূত্র বা উৎস ফুরিয়ে গেছে তখন সে অসুবিধায় পড়বে।

অন্যকথায় বলতে গেলে—ওটার মুখোমুখি হওয়া : জীবন মূলত অন্যায্য। তবে অন্যায্য অবস্থার মধ্যেও আবার ন্যায্যতা সম্ভব।

লোকজনকে যখন বলি, প্রতিদিন দৌড়াই তারা বেশ অভিভূত হয়। তারা বলে, ‘আপনার মনের জোর অনেক বেশি নিশ্চয়ই।’ নিশ্চয়ই, এ রকমের প্রশংসা পাওয়া মন্দ ব্যাপার নয়। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলার চেয়ে অন্তত ভালো। কিন্তু আমার মনে হয় না, শুধু মনের জোরের বলে কেউ এটা করতে পারে। দুনিয়াটা এত সহজ নয়। সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হয়, প্রতিদিন আমার দৌড়ানোর সঙ্গে মনের জোরের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার ধারণা, একটা কারণে ২৫ বছরে দৌড়াতে সক্ষম হব—কারণ এটা আমার ধাঁত সওয়া। অথবা, নিদেনপক্ষে ওসবে আমি কোনো ব্যথা-ট্যথা পাই না। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ যেটা করতে পছন্দ করে তা-ই করে যায়, অপছন্দের জিনিস সে করতে চায় না।

সেই কারণে অন্যদের দৌড়ানোর ব্যাপারে কোনো সুপারিশ কখনো করি না। কারও আগ্রহ থাকলে সে দূরপাল্লার দৌড় শুরু করবে। কারও আগ্রহ না থাকলে শত বোঝানোর পরও সে ও কাজে এগুবে না। ম্যারাথন দৌড় সবার ক্রীড়া নয়, আর সেই রকম উপন্যাস রচনাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্যে কেউ আমাকে সুপারিশ করেনি অথবা পরামর্শও দেয়নি। বরং অনেকে আমাকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করেছে। ইচ্ছে হওয়ার পর আমি তা করেছি। লোকজন যারা দৌড়বিদ হয় তারা ওর জন্যেই জন্ম নিয়েছে।

দূরপাল্লার দৌড় আমার জন্যে যতই জুতসই হোক না কেন, আমার মধ্যে স্থবিরতা এসেছে আর তা করার ব্যাপারে এসেছে অনীহা। না দৌড়ানোর জন্যে সম্ভাব্য সব ধরনের অজুহাত দাঁড় করিয়েছি। দৌড় থেকে অবসর গ্রহণের পর অলিম্পিক দৌড়বিদ তোশিহিকো সেকো’র সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম এবার। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার পর্যায়ের একজন দৌড়বিদের পক্ষে কী বলা সম্ভব— থাক আজ দৌড়াবো না? তিনি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে যে কণ্ঠস্বরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তা থেকে বেশ স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল আমার প্রশ্নের মূর্খতার বিষয়টি। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নিশ্চয়ই, সব সময়।’

যখন সেইসব ঘটনার কথা স্মরণ করি, মনে হয় কী বিষাদাক্রান্ত প্রশ্নই না করেছিলাম। জানতাম প্রশ্নটা বিষাদে ভরা, সেকোর পর্যায়ের ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের কাছ থেকে সরাসরি উত্তর প্রত্যাশা করেছিলাম। আমার জানার আগ্রহ ছিল, শক্তি প্রেরণার বিবেচনায় বিশ্বের চাইতে আমরা পৃথক হলেও যখন দৌড়াবার জন্যে আমরা জুতোর ফিতা-টিতা বেঁধে প্রস্তুতি নেই তখন আমরা একই মনোভাব পোষণ করি কি না। সেকোর উত্তরে বড় ধরনের প্রশান্তি নেমে এসেছিল। ভেবেছিলাম, চূড়ান্ত বিশ্লেষণের পর আমরা সবাই এক।

যখনই মনে হয় আমি দৌড়াতে চাচ্ছি না, নিজেকে একই প্রশ্ন করি : তুমি তো একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে পার, ঘরে বসে কাজ করতে পার আর নির্ধারণ করতে পার নিজের কাজের সময়। ভিড় ঠাসা ট্রেনে করে ভ্রমণ করতে হয় না তোমাকে, কিংবা বিরক্তিকর সব অফিস-সভায় যোগদান করতে হয় না। তুমি অনুধাবণ করতে পার না কতটা সৌভাগ্যবান তুমি। ওসবের সঙ্গে তুলনা করলে আশপাশের এলাকায় গিয়ে ঘণ্টাখানেক দৌড়াদৌড়ি কিছুই নয়। ঠিক না? তখনই আমি দৌড়াবার জুতার ফিতা ঠিকঠাক মতো বাঁধি আর নির্দ্বিধায় দৌড়াতে চলে যাই। (আমি একথা বলছি এটা পুরোপুরি জেনে যে, এমন লোকজনের সংখ্যা প্রচুর যাদেরকে ভিড়ভাট্টা অতিক্রম করে রেলভ্রমণ করতে হয় আর দৌড়ের ওপর থেকে সভায় উপস্থিত থাকতে হয়।)

ওটাই হচ্ছে আমার দৌড়ানোর ইতিহাস। তখন আমার বয়স ছিল তেত্রিশ। অনুভবে এখনও আমি তরুণ যদিও বয়সের দিক থেকে আর তরুণ বা যুবক নই। এটা সেই বয়স যে-বয়সে যীশুখ্রিষ্ট দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ও যে-বয়সে স্কট ফিটজিলাল্ড পর্বতের উৎরাই অবধি গিয়েছিলেন। এটা জীবনের চৌমাথার মতো। এটা সেই বয়স যে বয়সে আমি দৌড়বিদ হিসেবে জীবন শুরু করি। আর এটাই ঔপন্যাসিক হিসেবে আমার বিলম্বিত, কিন্তু সত্যিকার পথ চলার সূচনালগ্ন। পুনর্মুদ্রণ

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ