X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয় যুক্তরাষ্ট্র: ‘আপনি আচারি ধর্ম পরকে শেখাও’

ফারাবি বিন জহির
১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৪১আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৪১

ফারাবী বিন জহির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র” নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র। শুধু শক্তিশালী রাষ্ট্র বললে ভুল হবে বরং পৃথিবীর অন্যতম মোড়ল রাষ্ট্র। তার শক্তিমত্তার কারণে পৃথিবীজুড়ে তার মোড়লিপনা বহু যুগ ধরে টিকে রয়েছে। পৃথিবীর এই শক্তিশালী রাষ্ট্রের ৪৬তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী রাষ্ট্র তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের  প্রচারনা শুরু থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই ছিল বিশ্ববাসীর কৌতূহল। যে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীকে গণতন্ত্রের ছবক দিয়ে বেড়াতো সেই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণতন্ত্রের এক লজ্জাজনক রূপ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী।

যদিও কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের মাধ্যমে এক কালো দিন প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। এই হামলা কিন্তু হঠাৎ করে সংগঠিত হয়নি। ট্রাম্পের পুরো শাসন জুড়ে পদে পদে গণতন্ত্রকে অবদমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও বর্ণবাদ বৈষম্যকে উসকে দেওয়া হয়েছে, কখনও এফবিআই, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, সিভিল আমলাসহ সব জায়গায় চাপ দিয়েছে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য, কখনও বা বিচার বিভাগে নিজের লোক বসানো হয়েছে পছন্দ মতো রুলিং নেওয়ার জন্য। এমনকি সমালোচনা বন্ধের জন্য মিডিয়াকে জনগণের শত্রু বলা হয়েছে। দিনের পর দিন গণতন্ত্রকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের কফিনে সর্বশেষ পেরেকটি ঠুকা হয়েছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।  

নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই ভোট জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্রের বুলি আওড়াতে থাকেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একাধিকবার তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না বলেও হুমকি দেন। অতঃপর ৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হারার পরেও আইনি লড়াই চালিয়ে যান ট্রাম্প। তার আইনি লড়াইয়ের প্রতিটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ভেস্তে যাবার পরও হোয়াইট হাউস ছাড়তে নারাজ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের পরিকল্পনা ছিল, ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া ও নির্বাচনি ফল পাল্টে দেওয়ার। কংগ্রেসের অধিবেশনে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট প্রত্যাখ্যানের জন্য কংগ্রেস সদস্যের রাজি করানো নিয়েই মহা ব্যস্ত ছিলেন ট্রাম্প। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান থাকায় তার এই পরিকল্পনা নিয়ে যথেষ্ট  আশাবাদীও ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু ভাগ্য দেবী ট্রাম্পের সহায় ছিলেন না। অধিবেশনের মাত্র এক দিন আগেই জর্জিয়ার সিনেট নির্বাচনে দুটি আসন জিতে নেয় ডেমোক্র্যাটরা। যার ফলে  নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ পান। ট্রাম্পের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সহিংসতার দিকে ঝুঁকে পড়েন ট্রাম্প। তিনি ‘সেভ আমেরিকা মার্চ’ নামক র‍্যালির মাধ্যমে আবারও পরাজয় মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং ট্রাম্প তার সমর্থকদের সহিংস হামলার পথে উসকে দেন। ট্রাম্পের সেই উসাকানির সূত্র ধরেই কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের দিনে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে হামলা চালিয়েছে ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা। কয়েক শ’ সমর্থক অস্ত্র-শস্ত্রসহ পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায়। তারপর উগ্র সমর্থকরা দরজায় সজোরে আঘাত করে পার্লামেন্টের ভেতরে ঢোকে। পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ছোড়া হয়। বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদের (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) সদস্যদের পাহারা দিয়ে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে পুলিশ। পরবর্তীতে দেখা যায় ক্যাপিটাল হিলের সংঘর্ষে চার জন নিহত হয়েছেন। শুধু তাই নয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে যে সহিংসতা চালিয়েছে তার জন্য ট্রাম্পকে অভিশংসনের দাবি উঠে। কিন্তু অভিশংসন করা হলে দেশে বিপজ্জনক কিছু ঘটার হুমকি দিতে দ্বিধা করেন নি ট্রাম্প।

এখন স্বভাবত যে প্রশ্নটি উদিত হয় তা হলো নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। দাবি বা ভিন্নমতও থাকতে পারে। তাই বলে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে?

আসুন একটু আলোকপাত করি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কতটা সুসংহত এবং রাষ্ট্র হিসেবে তারা আইনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল সেই দিকে। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ যেসব প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক গণতন্ত্রের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে তাদের মতে ২০১৬ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আর পূর্ণ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই। এটি ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ থেকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নেমে গেছে। কানাডাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশন (গ্লোবাল রিসার্চ) এর গবেষক জেমস এ লুকাস তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭টি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ মিলিয়ন তথা ২ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির মধ্যে মাত্র ৩টি চুক্তি অনুসমর্থন করেছে আর ৬টি এখনও অনুমোদন করেনি। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ৬টি রাষ্ট্র নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন দেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সংবিধিতে তো স্বাক্ষর করেইনি, বরং যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রকে এ মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে বাধ্য করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সেনা সদস্য গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে না। উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রপ্রীতি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার নমুনা।

এর পরে যে উত্তরটি জানা প্রয়োজন তা হলো, নির্বাচন প্রক্রিয়া বা জনরায়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই অশ্রদ্ধাবোধের ইতিহাস কি এই প্রথম? উত্তর একেবারেই না বরং আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের  ১৯৬০ সালের নির্বাচন ১৯৭৬ সালের নির্বাচন, ২০০০ সালের নির্বাচনের দিকে তাকাই তাহলে এই জনরায়ের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধের উদাহরণ দেখতে পাবো। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সেই দেশ যে কিনা তার মনগড়া ও সুবিধাজনক গণতন্ত্রের তত্ত্ব অন্যের উপর চাপিয়ে দেবার জন্য সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দেশে গণতন্ত্র রক্ষা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে পরবর্তীকালে সেসব রাষ্ট্র ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেমন- আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়া।

কিন্তু সব চেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আমলনামা থাকার পরেও এই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালায় এবং অযাচিত মন্তব্য করে। তাদের সাথে যুক্ত হয় তাদের কিছু “পেইড এজেন্ট”। সেই “পেইড এজেন্ট” দের আচরণ  অনেকটা  ‘হীরক রাজার সভাসদ’দের মতো। যাদের কাজ শুধু বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে মোসাহেবি করা।

বর্তমান বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তাদের “পেইড এজেন্ট”রা গণতন্ত্র , মানবাধিকার কিংবা আইনের শাসন নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার সম্পূর্ণ রূপে হারিয়েছে। তাই সময় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এই সব অযাচিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে উপদেশ প্রদান করা যে তারা যেন মোড়লীপনা বন্ধ করে নিজের দেশকে পরিশুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করে।

লেখক: অ্যাকটিভিস্ট

   

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ