সাম্প্রতিক অতীতে নুসরাত হত্যা, রিফাত হত্যা, এমসি কলেজের গণধর্ষণ আর কয়েক বছর আগের নারায়ণগঞ্জের সাত খুন হত্যার একটা জায়গায় মিল আছে। শুরুতে এই মামলার অভিযুক্তরা বিচারিক আদালতে আইনজীবী পায়নি। আমরা যারা আইনের শাসনের পক্ষে কথা বলি, তারা কীভাবে এটার ব্যাখ্যা করবো? আইনজীবীরা যারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা, তারা এটার ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে? জঘন্যতম অপরাধীরও কি আইনি সুরক্ষা পাবার অধিকার নেই?
এক ভীষণ অবিশ্বাস্য সময়ে আমাদের বাস। সমাজে, রাষ্ট্রে যার যা বলার কথা আর যা করার কথা তা এখন আর করে না প্রায় সবাই। এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা যখন প্রায় সবাই ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার চেষ্টা করতে দেখা যায়। আমজনতা থেকে শুরু করে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও এখন প্রতিটি কথা বলার আগে ভেবে দেখেন সেটা ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ হলো কিনা। এই বিষয়টা এখন আর শুধু পলিটিশিয়ানের সম্পত্তি নয় এ দেশে।
কলাবাগানের ঘটনাটির আলোচনা একটু থিতিয়ে এসেছে, কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি এখনও। সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছেলেটি দিহানের প্রতি রাগ-ক্ষোভ প্রতিশোধ পরায়ণতা সব কাজ করতে পারে। হতেই পারে অর্থশালী পরিবারের সন্তান দিহানের পরিবার এই মামলার তদন্ত এবং আর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। এটা বাংলাদেশ, হতেই পারে সেটা।
কলাবাগানের ঘটনায় আনুশকা কি ধর্ষিত হয়েছে? নাকি শিকার হয়েছে গণধর্ষণের? কেউ কেউ বলতে পারেন এর ফয়সালা অনেকটা হয়ে গেছে। ঘটনার প্রায় পরপরই মিডিয়ায় এসেছে– আনুশকার মৃত্যু ধর্ষণের কারণেই হয়েছে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন ইফতেখার ফারদিন দিহান।
পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেওয়াটাই কোনও একজন মানুষকে সেই অপরাধে অপরাধী বলে নিশ্চিত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। সেটা হলে রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থা শুধু স্বীকারোক্তি না দেওয়া মানুষের জন্যই হতো। এই দেশে বসবাস করে এটাও আমরা খুব ভালোভাবে জানি, এখানে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন খুব সাধারণ একটি ঘটনা। নির্যাতনের মাধ্যমে অভিযুক্ত’র স্বীকারোক্তি আদায়ের চর্চাও এই দেশে অনেক পুরনো।
এই ঘটনায় তো তবু অভিযুক্ত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে আরও অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। কোনও একটি অভিযানের পর পুলিশ কিছু মানুষকে গ্রেফতার করে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, ডাকাত বা সন্ত্রাসী এরকম নানা কিছু লিখে গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে। এসব মানুষের চেহারা টিভিতে দেখা যায়, পত্রিকায় ছবি আসে। শুধু কোনও অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করে এরকম আচরণ অবিশ্বাস্য। এটা মানবাধিকারের ভয়ংকর লঙ্ঘন। আচ্ছা, এই দেশের পুলিশ কি আদৌ জানে, ‘মানবিক মর্যাদা’ কী, যেটা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণায় স্বাধীন দেশ গঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার কথা।
২০১২ সালে একজন বিচারককে ফেনসিডিল বহনের অভিযোগে আটকের পর পুলিশ তাকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করলে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন যে গ্রেফতার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোনও ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়। সেই সময় হাইকোর্টের সই করা নির্দেশনার পরও আরও অনেক মামলার পর্যবেক্ষণে হাইকোর্টে একই রকম নির্দেশনা দিয়েছেন।
আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ছাড়া অভিযুক্তের ছবি অথবা মিডিয়ার সামনে অভিযুক্তকে উপস্থাপন করা নিয়ে সরাসরি কোনও আইন নেই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আমাদের সংবিধান এবং সর্বজনীন মানবাধিকারের স্পিরিট অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে, সেটা প্রশাসন এবং মিডিয়ার দিক থেকে অবশ্য পালনীয়।
বিভিন্ন সময়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট খুব কঠোরভাবে অভিযুক্তের ছবি প্রকাশ করা এবং অভিযুক্তকে মিডিয়ার সামনে আনার বিরুদ্ধে বলেছিলেন। ভারতের আদালতে ব্যাপারটা আরও অনেক বেশি দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে বিখ্যাত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর মুম্বাই হাইকোর্ট এ বিষয়টিও তলিয়ে দেখেছেন যে, কোনও চাঞ্চল্যকর অপরাধের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংবাদ প্রকাশ করাও ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয় কিনা। কারণ, অনেক বেশি স্পেকুলেটিভ খবর কোনও ব্যাপারে ভুল হোক বা শুদ্ধ, জনমত তৈরি করে। এটা বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।
বলা বাহুল্য, আমাদের প্রশাসন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোটেও আমলে নেয়নি। একটা রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অঙ্গ যখন এমন আচরণ করে, তখন মিডিয়াও এর অংশে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক না। ঠিক সেটাই ঘটেছে।
কলাবাগানের ঘটনার পর দিহানের ছবি যেমন পত্রিকায় এসেছে তেমনি এসেছে তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডও। পত্রিকার মাধ্যমে সবাই জেনে গেছেন দিহানের ভাইও স্ত্রী হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। মানুষ জেনে গেছে একটা দামি গাড়ি দিয়ে নাকি দিহান মেয়ে পটাতো, বাড়ির সবাই বাইরে গেলে দিহান মাঝে মাঝে মেয়েদের তার বাসায় নিয়ে আসতো। এমনকি জাতীয় দৈনিকে এই খবরও এসেছে, দিহান যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ খেয়েছে কিনা সেটাও নাকি দেখা হচ্ছে। এসব যাবতীয় তথ্য, আমি জানি না, একজন মানুষকে ধর্ষক এবং খুনি হিসেবে প্রমাণ কীভাবে করে। তবে হ্যাঁ, এটা আমাদের ‘স্ক্যান্ডাল-ক্ষুধা’ মেটায়, নতুন করে এই ক্ষুধা তৈরিও করে। এ এক ভয়ংকর চর্চা।
আমাদের সমাজে যখন এরকম চাঞ্চল্যকর অপরাধের ঘটনা ঘটে, তখন দেশের প্রশাসন এবং মিডিয়া এমনভাবে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে তাতে সাধারণ মানুষ অভিযুক্তকে প্রকৃত অপরাধী মনে করে তীব্র ক্রোধ ঘৃণা বোধ করে। তাই সেই ভুক্তভোগী পরিবার একেবারে অলক্ষে চলে যায়। যাকে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সে আদতে কতটা অপরাধী বা তার অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও কিছু বলার আছে কিনা অভিযুক্তের পরিবারের সেসব ভাবার আর কোনও পরিস্থিতি থাকে না।
সমাজে প্রবলভাবে প্রচলিত এই মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন কলাবাগানের ঘটনায় অভিযুক্ত দিহানের মা। গণমাধ্যমে এক চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। সেই চিঠিতে নিজ সন্তানকে নিরপরাধ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তিনি; সে অংশটি আমরা ইগনোর করতেই পারি। কিন্তু সেই চিঠির শেষ প্যারাগ্রাফ এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেটি আমি এখানে উল্লেখ করছি–
‘মেয়েটির ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা এবং একমাত্র শারীরিক সম্পর্কের কারণেই রক্তক্ষরণ ও মৃত্যু হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ প্রশাসনের ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে চাই এবং বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখতে চাই। বিচারের আগে আমার ছেলেকে ধর্ষক বা হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত না করার জন্য সমাজের সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এই দেশে প্রবাদ আছে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। এই দেশে যিনি অপরাধী বলে প্রমাণিত হয়েছেন সত্যি সত্যি, কিংবা অভিযুক্ত হয়েছেন, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের কিছু বলার অধিকার থাকে না। বিচারিকভাবে যিনি এখনও অপরাধী প্রমাণিত হননি তাকে অপরাধী বলা নিয়ে আপত্তি করতে পারে যে কেউ। এমনকি বিচারিকভাবে কেউ অপরাধী প্রমাণিত হলে তারও কিছু মানবাধিকার আছে, সেটা নিশ্চিত করার পক্ষে কথা বলতে পারেন যে কেউ।
দিহানের মা সাহস নিয়ে তার ছেলের পক্ষে কিছু কথা বলেছেন। এই কলামে তার বক্তব্যের যে কথাটুকু উল্লেখ করা হয়েছে সেই কথা এই রাষ্ট্রকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার অতি গুরুত্বপূর্ণ এক পূর্বশর্ত।
সমাজে প্রচলিত এই প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে আমাদেরই তো খুব উচ্চকিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুরুর দিকের যে বলেছিলাম পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের কথা, সেটাই আমাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছিল, রাখে সবসময়। যেখানেই কোনও মানুষের, এমনকি ভয়ংকরতম অপরাধীরও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় সেখানেই তার পরিবার শুধু নয়, সমাজের সবাইর তার বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত। আমি জানি অজনপ্রিয় মতের বিরুদ্ধে কথা বলার ঝুঁকি থাকে, কিন্তু এটাও সত্য, প্রায় সব ক্ষেত্রে কথাগুলো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং মানবিক সমাজ গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সমাজে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ‘বুদ্ধিজীবী’সহ প্রায় প্রতিটি মানুষ পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার চেষ্টা করা এক বিপর্যয়ের নাম।
‘বড় গলা’ করে অভিযুক্তদের প্রতি আমাদের মানবাধিকারবিরোধী আচরণের প্রতিবাদ করা এবং করণীয় স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য দিহানের মাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
পাদটীকা: ২০১৪ সালে ভারতীয় হাইকোর্টের যে রায় অভিযুক্তকে মিডিয়ার সামনে আনা নিয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেই রায়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছিল। ১৬৪ ধারায় দেওয়া অভিযুক্তের জবানবন্দি এবং কোনও মামলার সাক্ষীরা কী সাক্ষ্য দিচ্ছেন সেটাও মিডিয়ায় প্রকাশের বিরুদ্ধে বলেছিল সেই রায়। তারা দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, এগুলো ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। আমাদের দেশে এগুলোও চলছে।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট