X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘সড়ক দুর্ঘটনা নয়, সড়ক দুর্যোগের পথে বাংলাদেশ’

মো. শাহ জালাল মিশুক
২২ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৪১আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৪৩

মো. শাহ জালাল মিশুক মৃত্যু অনিবার্য। কেউ তা থামাতে পারবে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। রাত পোহালেই নতুন জীবন— বিয়ে, কিন্তু এর আগেই সড়কে প্রাণ গেলো যুবকের। ছেলেকে মাইক্রোবাসে তুলে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। মাকে দেখতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে পারলেও বাড়িতে পৌঁছানোর রাস্তায় হয়ে গেলো নিথর মৃতদেহ। বাংলাদেশের সড়কে এমন সব করুণ কঠিন ট্র্যাজেডির জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নামক গণমৃত্যুর এই ফাঁদ কি কিছুতেই দূর করা যায় না?

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ’র হিসাব মতে, প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় ৩০ জন। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮শ’ জন। আবার বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। অন্যদিকে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ১২ হাজার মানুষ নিহত হন। বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা কিছু তারতম্য থাকলেও বছরে ১০-১২ হাজার মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার তথ্য আমাদের পিলে চমকে দেওয়ার মতো। সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হলেও যেখানে প্রশাসন বা চালকদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এটা ঠিক যে, পৃথিবীর সব দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব দেশে যথাযথভাবে বিচারের মুখোমুখি হন চালকরা। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে ব্যতিক্রম।

গত বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় চার হাজার ৯৯৬ মানুষের মৃত্যু এবং পাঁচ হাজার ৮৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন, টেলিভিশন ও অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। নিসচার হিসাবে, গত এক বছরে চার হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রেলপথ ও নৌপথে দুর্ঘটনায় মোট ৩৪১ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে রেলপথে ১২৯ জন নিহত ও ৩১ জন আহত এবং নৌপথে ২১২ জনের মৃত্যু ও ১০০ জন আহত হন। পাশাপাশি গত বছরের জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি ‍দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই এক মাসে ৪৪৭টি দুর্ঘটনায় ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হয়েছেন। এরপর গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে তুলনামূলক কম দুর্ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিলে ১৩২ ও মে মাসে ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশে সাধারণ ছুটি ও লকডাউন থাকায় এই দুই মাসে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৮৬ জন। আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬০০ জন। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ বেপরোয়া গতি। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা। এছাড়া রেলপথে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩১৮ জন ও নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন, অর্থাৎ সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩১৭ জন। সংগঠনটি বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেলে সড়ক দুর্ঘটনা ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ: লিডারশিপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ: লিডারশিপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যান ১০২ জন। পাশের দেশ ভুটানে এ সংখ্যা ১৬ দশমিক ৭০, ভারতে ১৩, নেপালে ৪০ ও শ্রীলঙ্কায় সাত জন। যদিও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ভারতে এ সংখ্যা ১৫৯, নেপালে ৮১, ভুটানে ১০৯ ও শ্রীলঙ্কায় ৩২৭। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে দু’জন সাইকেলচালকের মৃত্যু হয়। দুই বা তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১১ দশমিক ২০। আর গাড়ি ও হালকা যানের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ হাজার যানের দুর্ঘটনায় ১৩ দশমিক ৩০ জন গাড়িচালক ও ২৮ দশমিক ৬০ জন যাত্রী প্রাণ হারান। ট্রাক চালকদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ছয় দশমিক ১০, বাস চালকের ক্ষেত্রে আট দশমিক ২০ ও বাসযাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০ জন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।

অর্থাৎ, সব গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, প্রতিনিয়ত সড়কে বিশৃঙ্খলার দরুন প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এমনকি বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রাণহানি থেকে মানুষদের রক্ষা করা যায়নি। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো টেকসই ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করা, দক্ষ চালক নিশ্চিত করা, চালকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা, শহরগুলোয় নিরাপদ গতি ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করা ইত্যাদি। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ করা এবং ফুটপাত বেদখলমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক ও মানসম্মত ট্রেনিং অ্যাকাডেমি গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রসমূহে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

মোদ্দাকথা হলো, সড়ক দুর্ঘটনা এখন শুধু নিছক কোনও দুর্ঘটনা নয়। বরং অনেকাংশেই এটা দুর্যোগের পর্যায়ে চলে গেছে। সড়কে এমন বিশৃঙ্খলা চলতে থাকলে ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যেতে পারে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা যেন সড়ক দুর্যোগে রূপ না নিতে পারে সেদিকে কঠোর নজর দিতে হবে।

 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চুয়েট ও কলাম লেখক।

 

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ