X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে, তুফানের জামিন ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

আমীন আল রশীদ
২৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:১৬আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:১৬

আমীন আল রশীদ সাম্প্রতিক কয়েকটি সংবাদ শিরোনামের দিকে নজর দেওয়া যাক–

১. রাজধানীতে বন্ধুদের দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ।

২. জজের উপস্থিতিতে ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে।

৩. ধর্ষণ মামলার পর আদালতে চিকিৎসক-আইনজীবীর বিয়ে।

৪. বগুড়ার সেই তুফান সরকারের জামিন।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর উত্তর গোরানে। পারিবারিক বিরোধের জেরে স্ত্রীকে বন্ধুদের দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা। পুলিশের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবর বলছে, পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য গত ১২ জানুয়ারি আইয়ুব আলী তার স্ত্রীকে উত্তর গোরানের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তার পাঁচ বন্ধু তাকে ধর্ষণ করে। পরে ভিকটিম নারীকে ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়।

দ্বিতীয় ঘটনা ঝালকাঠিতে। ধর্ষণের শিকার তরুণীকে বিয়ের শর্তে ধর্ষকের জামিন মঞ্জুর করেন ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত। জামিন শুনানির নির্ধারিত দিনে আদালতে বাদী ও আসামি উপস্থিত হলে বিচারক বর পক্ষের অনুরোধে উভয় পক্ষকে বিয়ের শর্তে স্থায়ী জামিনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজি হলে দুপক্ষের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ান স্থানীয় কাজী।

তৃতীয় ঘটনাটিও মোটামুটি একই রকম। ঘটনাস্থল রাজশাহী। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ধর্ষণ মামলায় জেল থেকে বাঁচতে আদালতে বিয়ে করেছেন এক চিকিৎসক। বিচারকের উপস্থিতিতে। আসামি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করেন। তিনি বিয়ে করেছেন একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে।

আর চতুর্থ ঘটনার সূত্রপাত চার বছর আগের। বগুড়ায় এক ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং মা-মেয়েকে নির্যাতনের পর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রধান আসামি ও শহর শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়ক তুফান সরকার। সম্প্রতি তিনি জামিন পেয়েছেন। তবে তার জামিন পাওয়া যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে জামিনের প্রক্রিয়া নিয়ে। কারণ, গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভিকটিম ও তার মা (বাদী) আদালতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন। তুফানের বিরুদ্ধে তাদের কোনও অভিযোগ নেই বলেও আদালতকে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তাদের কাছ থেকে জোর করে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। ভুল বোঝাবুঝি থেকে মামলাটি হয়েছিল বলেও তারা আদালতকে জানিয়েছেন। ফলে আদালত মূল আসামি তুফানের জামিন মঞ্জুর করেন।

ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন নেটিজেনরা। কোন পরিস্থিতিতে বাদী আদালতে দাঁড়িয়ে আসামির পক্ষে এরকম বক্তব্য দিয়েছেন বা দিতে বাধ্য হয়েছেন, সেটি খতিয়ে দেখার দাবি জানান তারা। কারণ, যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি হয়েছিল, সেটি সবার জানা। ভিকটিম নারীদের ছবিও ওই সময়ে গণমাধ্যমে এসেছিল। সুতরাং, এতদিন পরে এসে ঘটনাকে ভুল বোঝাবুঝি বলার পেছনে যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ রয়েছে, তা বুঝতে কোনও গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং যদি ক্ষমতার জোরে ভিকটিমদের এ কথা বলতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তারও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। যদি তা নয় হয়, তাহলে ধর্ষণের সব মামলাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ভবিষ্যতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষের সংখ্যা কমে যাবে।

এ প্রসঙ্গে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভিকটিমকে যে সুরক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল, রাষ্ট্র কি তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? তাছাড়া চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি ঘটেছে চার বছর আগে। এতদিন ধরে মামলাটি কেন ঝুলে আছে? কেন বিচার শেষ হচ্ছে না? গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ আলোচিত এ ধর্ষণ মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের এই নির্দেশও মানা হয়নি।

প্রসঙ্গত, ধর্ষণের শিকার কলেজে ভর্তিচ্ছু ওই ছাত্রীর মা ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ভালো কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার নামে তুফান সরকার তার মেয়েকে শহরের চকসূত্রাপুরের বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে তুফানের স্ত্রী, বোন, মা ও অন্যরা ভিকটিম এবং তার মাকে নির্যাতন করেন। পরে নাপিত ডেকে এনে তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন তারা যে আদালতে বললেন তুফানের বিরুদ্ধে তাদের কোনও অভিযোগ নেই, তার মানে মামলায় উল্লিখিত অভিযোগ মিথ্যা? যদি তা-ই হয়, তাহলে চার বছর ধরে তিনি যে জেলে আছেন, সেটি তো অন্যায়। এখন হয়রানির করার অপরাধে উল্টো বাদীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।

আসলে কী ঘটেছে তা আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়। স্থানীয়ভাবে তুফান সরকার যেরকম ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে যেরকম তার বিচরণ ছিল, তাতে সম্ভবত ভিকটিম নারী ও তার পরিবারকে একটি আপসরফায় যেতে বাধ্য করা হয়েছে। সে কারণেই তারা আদালতকে বলেছেন এটা ভুল বোঝাবুঝি। এখানে যত সহজে ভুল বোঝাবুঝি শব্দটা বলে দেওয়া যায়, বাস্তবতা তত সহজ নয়। এখানে বাদী পক্ষ সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলে তাদের ভয় দেখিয়ে সমঝোতায় রাজি করানো সম্ভব হতো না। তবে আসলেই তাদের ভয় দেখিয়ে সমঝোতায় রাজি করানো হয়েছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের যে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্ষণের বিচার না হয়ে ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, তার সঙ্গে বগুড়ার তুফান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই বলে বাদীর বক্তব্য দেওয়ার মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই।

রাজশাহীর ঘটনাটি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, যা পরে শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। কিন্তু পুরুষটি ওই নারীকে বিয়ে করতে রাজি না হলে এবং নারীকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করলে ধর্ষণ মামলা করেন ওই নারী। এরপর জেল খাটার ভয়ে তিনি বিয়ে করতে রাজি হন। তার মানে এখানে বিয়েটা ভালোবাসা বা পারিবারিক বন্ধনের বিষয় নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে ভীতি। এভাবে একটি সংসার হয় কিনা বা হলেও সেটি টিকিয়ে রাখা খুব সহজ কিনা— সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

অতীতেও এ রকম ঘটনা শোনা গেছে যে স্বেচ্ছায় বা উভয়ের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর পরে কোনও বিষয় নিয়ে মতবিরোধের কারণে পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হয়েছে। যে কারণে অনেক সময় প্রকৃত ধর্ষণ মামলা নিয়েও জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে। আবার এমন অভিযোগও আছে যে নারী নির্যাতন মামলার একটি বড় অংশের পেছনেই প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো বা ঘায়েল করার উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং কারও সঙ্গে স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর পরে পরে ওই পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা কিংবা যদি ধর্ষণ মামলা হওয়ার পরে সেই অভিযুক্ত পুরুষকে বিয়ে করা অথবা মামলার চার বছর পরে আদালতে গিয়ে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই বলে বক্তব্য দেওয়ার ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ভাবার সুযোগ নেই। বরং এর প্রতিটি ঘটনার পেছনেই অন্য কোনও কারণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি বড় কারণ হচ্ছে ক্ষমতা।

বন্ধুদের দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করানোর যে লোমহর্ষক ঘটনার খবর বেরিয়েছে, সেখানেও এই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, তথা সমাজে নারীর অবস্থান এবং নারীকে দেখার যে ভঙ্গি, তারই প্রতিফলন। কারণ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও বিষয় নিয়ে পারিবারিক বিরোধ থাকলে তা সুরাহার অনেক পথ রয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণের জন্য বন্ধুদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। আসলেই ঘটনাটি এরকম ঘটেছে নাকি অভিযোগটি মিথ্যা, সেটি আদালতেই প্রমাণিত হবে। প্রশ্ন হলো, আদৌ প্রমাণিত হবে কিনা? নাকি ঘটনা ঘটলেও নানাবিধ চাপে শেষ পর্যন্ত আপসরফা হবে এবং আদালতে দাঁড়িয়ে ওই ভুক্তভোগী নারী গিয়ে বলবেন স্বামীর বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই এবং তিনি স্বামীর সঙ্গেই থাকতে চান। এ বিষয়ে হয়তো ওই নারীর ওপর তার নিজের পরিবার থেকেও চাপ আসবে।

অর্থাৎ, আমরা যে সমাজ বাস্তবতা গড়ে তুলেছি, সেখানে নারীরা ভিকটিম হতে থাকবে এবং এই সমাজ ও পরিবারই তাকে চুপ করে যেতে বা মেনে নিতে বাধ্য করবে। কারণ, সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতার মাধ্যমে। সেই ক্ষমতা কখনও রাজনীতির, কখনও অর্থের, কখনও সামাজিক প্রতিপত্তির। আবার এই মেনে নেওয়া বা সমঝোতার পেছনে ভীতি ও অনিশ্চয়তা এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কাও বড় কারণ। সুতরাং, বগুড়ায় তুফান সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই বা ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি বলে আদালতে দেওয়া ভিকটিমের বক্তব্যের পেছনে আসলে কী রয়েছে, সেটি শুধু এই একটি ঘটনার বিশ্লেষণের জন্যই জরুরি নয়, বরং অন্যান্য ধর্ষণ মামলার বিচারেও এটি একটি বড় কেসস্টাডি হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ