X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গরিবকে লুট করা টাকাও কিনতে পারে সম্মান-প্রতিপত্তি

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:১২আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:২০

ডা. জাহেদ উর রহমান
আমি যতটা না গরিব আমার চেহারার কোথাও তার চাইতে অনেক বেশি গরিব একটা ভাব আছে– দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় এটা আমি এখন নিশ্চিতভাবেই জানি। কোথাও কোনও কিছু কিনতে গেলে আমাকে সব সময় সস্তা জিনিসটা দেখাবে। একটু দামি কিছু দেখতে চাইলেই আগে সতর্কবাণী শুনি এটার দাম কিন্তু … টাকা। এমনকি ফুটপাত থেকে কিছু কিনতে গেলেও এমন ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে।

এই যখন অবস্থা, তখন আমার ছিনতাই হওয়াটা অদ্ভুত‌ই বলতে হবে। এখন পর্যন্ত আমার চারবার ছিনতাই হয়েছে। কেনাকাটার অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করি, আমাকে দেখলে তো মনেই হওয়ার কথা না ছিনতাই করে আমার কাছ থেকে তেমন কিছু পাওয়া যাবে। আবার এটাও হতে পারে, ছিনতাইকারী হয়তো ভাবে আমি খুব সহজে ছিনতাই হতে দেবো। তারা সঠিক– আমাকে ছিনতাই করতে এলে আমি একেবারে লক্ষ্মী ছেলের মতো সবকিছু সহজে দিয়ে দিই।

নিজের ছিনতাই হওয়ার পর সারা জীবনে যতটুকু খারাপ লেগেছে, তার চাইতে অনেক বেশি খারাপ লেগেছে যখন এক রাতে একজন ক্রন্দনরত রিকশাচালককে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। জানতে পারলাম তার ছিনতাই হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এটা বহুকাল আগের কথা। এরপর অনেক সময় অনেক রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করেছি তাদের কখনও ছিনতাই হয়েছে কিনা। জানতে পেরেছি অনেকের‌ই ছিনতাই হয়েছে। আর গন্তব্যে নেমে টাকা আনছি বলে মার্কেটের ভেতরে কিংবা জনস্রোতে মিশে গিয়ে আর ফিরে না আসার ঘটনা তো আকছার‌ই ঘটে তাদের জীবনে।

আচ্ছা অপরাধীর মনস্তত্ত্বেও কি ‌কিছু মানবিক হিসাব-নিকাশ কাজ করে? কোনও অপরাধী কি একই অপরাধ ঘটানোর ক্ষেত্রেও কার ওপরে ঘটানো হচ্ছে সেটার বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়? নেয় সম্ভবত। সব ছিনতাইকারী নিশ্চয়ই রিকশাচালককে ছিনতাই করতে যায় না।

এই দেশে অভাব ছিল, আছে এখনও। কিন্তু এই করোনা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল সেটা এই দেশের ইতিহাসে প্রথম। বিশেষ করে যখন সাধারণ ছুটির নামে এক ধরনের অঘোষিত লকডাউন দেওয়া ছিল। খেটে খাওয়া মানুষ তখন এক নজিরবিহীন সংকটে পড়েছিল। কতটা সমস্যায় তারা পড়েছিল সেটা বোঝার জন্য করোনার আগে করা একটা সমীক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

শহরের আট শতাংশ দরিদ্র পরিবার না খেয়ে ঘুমাতে যায়। শহরের ১২ শতাংশ দরিদ্র পরিবারে খাবার নেই। শহরের ২১ শতাংশেরও বেশি দরিদ্র পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার নেই। সাত শতাংশ পরিবার কম পরিমাণে খাবার খাচ্ছে। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, সারা দিনে একবেলাও খেতে পায়নি প্রায় তিন শতাংশ শহুরে দরিদ্র পরিবার। এগুলো হচ্ছে শহরের গড় হার। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রামে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ। যেমন, সারা দিনে এক বেলাও খায়নি এমন পরিবারের সংখ্যা এই দুই শহরে ৩.১৭ শতাংশ।

ঢাকা শহরে যদি‌ ২ কোটি মানুষ থাকে তাহলে প্রতিদিন এক বেলা করেও খাবার খেতে পায় না এমন মানুষের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৩৫ হাজার।
দ্য আরবান স্যোসিওইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে (ইউএসএএস) ২০১৯ নামের এই জরিপটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। করোনার আগে, ২০১৯ সালে ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জরিপটি চলে।

ভাগ্যিস এই জরিপ চালিয়েছিল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, না হলে এর ফাইন্ডিংকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হতো। এই তো কয়েকদিন আগেই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংস্থা সানেম বলছে, এই মুহূর্তের বাংলাদেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪২ শতাংশ। যথারীতি সেটাই হলো যা হওয়ার কথা– পরিকল্পনামন্ত্রী এই পরিসংখ্যান একেবারেই নাকচ করে দিলেন।

যাক ফিরে আসা যাক করোনার লকডাউনের প্রসঙ্গে। সেই সময়ে, মে মাসের শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, ৫০ লক্ষ পরিবারকে সরকার এককালীন ২৫০০ টাকা করে দেবে। প্রায় তিন মাস ধরে সবকিছু বন্ধ থাকার পরিস্থিতিতে এটা খুবই অপ্রতুল অঙ্ক। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও এই মানুষগুলোর কাছে এই টাকাটা সামান্যতম হলেও কাজে লাগতো।

আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, এই টাকা যখন প্রথম বিতরণ করতে শুরু করার কথা হয় তখনই দেখা গেলো হাজার হাজার ভুয়া নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে এই টাকা পাওয়ার জন্য। সরকারি দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং নেতারা তাদের নিজেদের লোকজনের নাম ঢুকিয়েছেন এই টাকা পাবার জন্য। বন্ধ হয়ে যায় তখন টাকা বিতরণ। পরে যখন সেই টাকা বিতরণ করা শুরু হয় ততদিনে ঘোষিত লকডাউন উঠে গেছে। সর্বশেষ আগস্ট মাসের একটা খবরে জানা যায়, সেই টাকা বিতরণ করা হয়নি তখন পর্যন্ত অন্তত ১৫ লাখ পরিবারকে।

দেশে ভূমিহীনদের, আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকার সেমিপাকা ঘর দিচ্ছে। প্রথম কিস্তির ৭০ হাজার ঘর এরমধ্যেই হস্তান্তর করা হয়েছে। দ্রুতই আরও এক লক্ষ ঘর হস্তান্তর করা হবে বলে জানা যায়।

এই দেশে এমন কোনও প্রকল্প সত্যিকার দুস্থদের কতটা কাজে লাগে, সেই প্রশ্ন খুব সিরিয়াসলি আছে। ঢাকায় বস্তিবাসী পুনর্বাসনের জন্য নেওয়া ভাসানটেক প্রকল্পের শেষ পরিণতি কী হয়েছে সেটা আমরা জানি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি ভূমিহীন আশ্রয়ণ প্রকল্পে অসংখ্য নাম থাকবে যারা কোনোভাবেই ভূমিহীন নয়। তারপরও সেই সমালোচনা আপাতত সরিয়ে রাখা যাক। কথা বলা যাক ভিন্ন আরেকটা দিক নিয়ে।

এখন যে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কথা হয়েছে তাতে ঘরপ্রতি রাষ্ট্রীয় খরচ এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই দফায়ই বরাদ্দ হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার মতো। বাংলাদেশের তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হবে আর সেটায় লুটপাট হবে না, সেটা তো হতে পারে না। গরিবের কাছে আড়াই হাজার টাকা যেতে দেখেই লোভ যখন সামলানো যায় না, তখন এত টাকার আস্ত একটা ঘর গরিবের কাছে চলে যাবে, সেটা সহ্য না হওয়ারই কথা।

ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের নিম্নমানের খবর মিডিয়ায় এসেছে। ঘরে ওঠার আগেই ফাটল ধরেছে এমন ছবি আমরা পত্রিকায় দেখেছি। এখন এসেছে তার চাইতেও বড় অভিযোগ।

এসব ঘর বিনামূল্যে দেওয়ার কথা থাকলেও এক উপজেলায় ঘটছে ভিন্নতা। জনপ্রতি দিতে হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে। অভিযোগ রয়েছে, টাকা দিয়ে ঘর পাওয়ার পরও ইট-বালুসহ অর্ধেক নির্মাণ সামগ্রী কিনতে হচ্ছে নিজেদের। যাতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। দেশের একটি জাতীয় পত্রিকা বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে এমন কয়েকটি জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে এমন রিপোর্ট করেছে।‌

অসততা, অপরাধের নৈতিকতার মধ্যেও মান আছে। দেশের যেকোনও প্রকল্পে দুর্নীতি, লুটপাটের ঘটনা সার্বিকভাবে সব মানুষকেই প্রভাবিত করে নিঃসন্দেহে। কারণ, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান দেয় জনগণ এবং এগুলোর উপকারভোগীও জনগণই। কিন্তু সড়ক সেতু বানানোর প্রকল্পের লুটপাট আর একেবারে দুস্থ দরিদ্র মানুষের প্রকল্পে লুটপাটের মধ্যে একটা চরিত্রগত পার্থক্য আছে নিশ্চয়ই।

আবহমানকাল থেকে রিলিফের পণ্য চুরি করে বিক্রি করে দেওয়ার গল্প আমরা জানি। গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ ভিজিএফ এবং ওএমএসের চাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার খবর আমরা সব সময় দেখি। যে প্রকল্পের সরাসরি উপকারভোগী একেবারে দরিদ্র মানুষ‌টি, সেই জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের লালসার থাবা। সেই লালসা বন্ধ হয় না অন্য সব সময় তো বটেই, করোনার মতো বীভৎসতম সময়েও।

এটা ‘টাকাওয়ালাদের’ সমাজ। টাকা আসলে, টাকা থাকলে, সেটা যে পথেই হোক না কেন, সমাজের আপনার সম্মান প্রতিপত্তি একেবারেই নিশ্চিত। গরিবকে লুট করে যারা টাকা বানায় তাদের সেই টাকা এই সমাজে পণ্য তো কিনতে পারেই, কিনতে পারে সম্মান-প্রতিপত্তিও।

এই টাকা বানানোর খেলায় এই সমাজ প্রতিদিন হয়ে ওঠে আগের দিনের চাইতে আরও অনেক বেশি অসভ্য, বর্বর।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
‘পাতানো ম্যাচ’ নয়, মাঠে খেলেই এগিয়ে যেতে চায় স্বাধীনতা
‘পাতানো ম্যাচ’ নয়, মাঠে খেলেই এগিয়ে যেতে চায় স্বাধীনতা
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, মোকাবিলায় কী করছে ডিএনসিসি
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, মোকাবিলায় কী করছে ডিএনসিসি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ