X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই

ফজলুল বারী
২৪ এপ্রিল ২০১৬, ১৫:৫১আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৬, ১৮:২৭

ফজলুল বারীআজ আমার-আমাদের অনেকের সাংবাদিকতার গুরু, বাংলাদেশের চলমান সাংবাদিকতার অন্যতম জীবিত কিংবদন্তী তোয়াব খানের ৮২ তম জন্মদিন। জন্মদিনের সেঞ্চুরির পথে ধাবমান আমাদের সবার প্রিয় তোয়াব ভাই। আরেক জীবিত কিংবদন্তীর সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাকে এ উপলক্ষে লিখেছেন ‘শেষ পরানের পাড়ি!’ কারণ তার সমসাময়িক সক্রিয় জীবিত সাংবাদিক আর কেউ বেঁচে নেই, সক্রিয় নেই। ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল সাতক্ষীরার রসুলপুর গ্রামে তার জন্ম। সাংবাদিকতার ছোঁয়া পেয়েছেন জন্মসূত্রে! কিংবদন্তীর সাংবাদিক মাওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন তার মামা। এ পরিবারের আবেদ খান বা আজকের সেলিম খানকে কে না জানে চেনে? সংবাদসহ নানা পত্রিকায় কাজ করেছেন তোয়াব খান। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে কাজ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। লিখতেন ‘পিন্ডির প্রলাপ’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এরশাদ এবং বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। দৈনিক জনকণ্ঠের জন্মলগ্ন থেকে তিনি পত্রিকাটির প্রাণভোমরা। বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্রের আজকের অনেক রূপান্তর ঘটেছে তার হাতে। আজ দেশের যতো প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া- এর অনেকগুলোর প্রধান ব্যক্তিরা তার হাতে তৈরি অথবা বিকশিত। গত একুশে পদকে তাকে প্রথমবারের মতো সম্মানিত করেছে রাষ্ট্র। একুশে পদকের পর এটিই তার প্রথম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই।
তার জন্মদিন নিয়ে শনিবার রাতে বিশেষ একটি অনুষ্ঠান করেছে এটিএন নিউজ। মুন্নি সাহার উপস্থাপনায় ওই অনুষ্ঠানে তোয়াব খানকে ঘিরে আফসান চৌধুরী, মাসুদ কামালের আলোচনায় আজকের যুগের মিডিয়া বাস্তবতার অনেক সত্য উঠে এসেছে। এর একটি প্রশ্ন হচ্ছে আজকের যুগের মিডিয়া মানুষের পক্ষে না, মালিকের পক্ষে কাজ করছে। তোয়াব খান এর জবাব দেন কোনও ভণিতা ছাড়াই। তিনি বলেন- মিডিয়া কখনোই মানুষের পক্ষে ছিল না। আগে যদি একটি পত্রিকা বের করতে তিন লাখ টাকা লাগতো, এখন লাগে তিনশো কোটি টাকা। তখন ওই তিন লাখ টাকাও একজন মালিক দিতেন, এখন এই তিনশো কোটি টাকাও দেন একজন মালিক। তখনও মিডিয়াকর্মীদের মালিকের স্বার্থের কথা মাথায় রাখতে হতো। এখনও হয়। এটা শুধু বাংলাদেশে না, সারাবিশ্বের বাস্তবতা।

নিউইয়র্ক টাইমসেও এমন কিছু ছাপা হবে না, যা ওই পত্রিকার মালিকপক্ষের স্বার্থের বিরোধী। আসল সত্য হচ্ছে আগেও এসব জেনেশুনেই সাংবাদিকরা এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মানুষের পক্ষে কাজ করতেন, এখনও করেন। মনে পড়ে একবার কলকাতা বইমেলায় তোয়াব খানকে অতিথি করে নেওয়া হয়েছিল। সেখানকার বক্তব্যেও তোয়াব খান এমন পুঁজির সঙ্গে মেধার চিরায়ত দ্বন্দ্ব, এরমধ্যেও মিডিয়াকর্মীদের করণীয় তুলে ধরেছিলেন চমৎকার সাবলীল ভাষায়। এর সবকিছুর সঙ্গে আশাবাদী মানুষ তোয়াব খান বলেছেন, আজকের মিডিয়ায় অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েরা আসছে কাজ করছে। এর মাধ্যমে মিডিয়ার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটছে আগামীতে আরও ঘটবে। টিকে থাকবে পরিশ্রমী, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা।

 

আরও পড়তে পারেন: পুলিশের কাছে তথ্য: বাড়িওয়ালাদের পরিবার নেই!

তোয়াব খানের এ বক্তব্য ক্যাচ করে এখানে লেখার কারণ আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে এসব নিয়ে একতরফা ঢালাও বক্তব্য দেন। একজন কলেজে শিক্ষকতা করেন বলে বেতন পান, একজন ডাক্তার ফির বিনিময়ে রোগী দেখেন, একজন উকিল মক্কেলের পক্ষে থাকেন, কিন্তু অনেকে সাংবাদিক মানে বুঝেন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কর্মী! পত্রিকা মিডিয়ায় তার নামে ছাপা রিপোর্টই যে শেষ না, এসব কয়েকজনের হাত ঘুরে পাঠকের হাতে যায়। ওই কয়েক টেবিলে মালিকের বা পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী দায়িত্বপ্রাপ্তরা থাকেন। এমনটি শুধু আজকের যুগে না, সব সময়ই চলে আসছে। সব পেশার মতো ভালোমন্দ সাংবাদিকতা পেশায় আছেন। এরপরও একটা দেশ যে অনেক ভালো থাকে এর কারণ চোখকান খোলা ভালো সাংবাদিকতা। এর জন্যে পাঠক-দর্শকরা অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু পক্ষে গেলে নিরপেক্ষ, বিপক্ষে গেলে দলীয়, এমন একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না বলে অনেক ক্ষেত্রে ঢালাও মন্তব্য করে বসেন!

সাংবাদিকতায় তোয়াব খান অবশ্য এক ধরনের একপক্ষীয় সাংবাদিকতাও আমাদের শিখিয়েছেন! তা হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা, নারী-শিশু-সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ-সহিংসতা-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাসহ সব অন্ধকার কূপমণ্ডুক শক্তির বিপক্ষে থাকা, এসব বিষয় তোয়াব খান সর্বক্ষণিক তার মাঝে লালন করেন। তার ছাত্র হিসাবে আমরাও করি। যে কোনও একটি দেশ-জাতির সবচেয়ে বড় একটি রাজনৈতিক ঘটনা থাকে। বাংলাদেশের যেটি মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ আমাদের একটি দেশ-মানচিত্র-পতাকা-স্বাধীন জাতিস্বত্ত্বা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ছিল। বিপক্ষ শক্তিকে পরাজিত করেই আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু আজ যারা এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার কথা বলেন তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধের সেই পরাজিতের পক্ষের। আমরা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সেটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট দাবি। এ বিষয়ে আমরা মোটেই নিরপেক্ষ না। নারী-শিশু-সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ-সহিংসতা-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাসহ সব অন্ধকার কূপমণ্ডুক শক্তির বিপক্ষে থাকা, এসব বিষয়ে মোটেও নিরপেক্ষ না। এসবই আমাদের পাওয়া তোয়াব খানের শিক্ষা।

আরও পড়তে পারেন: রাজপথ দখল করতে আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করছেন বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি

মুন্নি সাহার উপস্থাপনায় আরেকটি মজার তথ্য ছিল! ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তোয়াব খান একসঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন! তার এই তথ্যে নড়েচড়ে বসেন মাসুদ কামাল! কারণ আমরা যারা জনকণ্ঠের লোকজন, তারা জানি তোয়াব খান কখনও গ্রেফতার হননি! এমনকি একবার বিএনপি আমলে একই মামলায় তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমদ গ্রেফতার হলেও এর সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান গ্রেফতার এড়িয়ে সুপ্রিমকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন। তার গ্রেফতার নিয়ে মুন্নি সাহার বক্তব্যের আসল তথ্য হচ্ছে, ওই দিন বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন তোয়াব খান। তার বিয়ের অনুষ্ঠানে তার কাছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের খবর আসে। অফিস থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছিল এই গ্রেফতারের নিউজ নিয়ে তাদের করণীয়। তোয়াব খান ওই অবস্থায় নিউজটি কীভাবে যাবে না যাবে তার নির্দেশনা দিচ্ছিলেন! একজনের বিয়ে আরেকজনের গ্রেফতার! এই হচ্ছে তোয়াব খানের জীবন! আমাদের মিডিয়া কর্মীদের জীবন! দিন নেই রাত নেই ব্যক্তিজীবনের সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গিয়ে আমাদের এভাবে সর্বক্ষণিক নিউজের সঙ্গে থাকতে হয়।

জনকণ্ঠে যারা আছেন-ছিলেন তারা এই পত্রিকাটির সঙ্গে তোয়াব খানের সর্বক্ষণিক যোগসূত্র জানেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে মিটিং করেন। মিটিং মানে সাংবাদিকদের আদালত! এরপর অনেক কপি দেখেন। বিকেলে আবার এসে কপি দেখা, মেকাপ আঁকা, পেস্টিং পর্যন্ত থাকেন। তার বাসায় যাওয়ার পর আবার ফ্যাক্স করে পাঠাতে হয় পত্রিকা কপি। ভুলশুদ্ধ হলে সংশোধন করে দেন। তোয়াব খান বিদেশে থাকলেও তার হোটেলে বা বাসায় এভাবে ফ্যাক্সে সবকিছু পাঠাতে হয়। এমনভাবে সর্বক্ষণিক তিনি পত্রিকাটির সঙ্গে থাকেন। এসবের পাশাপাশি সারাক্ষণ এতো বেশি পড়াশুনায় থাকেন যে আজকের যুগে তার মতো এমন আর কে পড়েন, তা খুঁজে বের করতে বাটি চালান দেওয়া লাগবে!

আরও পড়তে পারেন: থামো মতিহার

তার আরেকটি গুণ হলো অসন্তুষ্টি। সারাসময় সবকিছুতে তিনি অসন্তুষ্ট! নিজের ওপর তিনি অসন্তুষ্ট! কিছুই হচ্ছে না! এই অসন্তুষ্টিই তার চালিকাশক্তি। এই অসন্তুষ্টির কারণেই তিনি সদা সক্রিয়! এজন্যেই তিনি এখনও তোয়াব খান। ৮২ বছর বয়সেও সক্রিয় তার কাজে। আমি আমার অনুজদের সব সময় এমন নিজের কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকতে বলি। তাহলেই একজন আরও ভালো কাজ করতে পারবে। সন্তুষ্ট হলেন শেষ! ফিনিশ! সে সেখানেই থেমে যাবে। এই শিক্ষাটি আমি আমার গুরু তোয়াব খানের কাছে পেয়েছি। অনেক কৃতজ্ঞতা তার কাছে। অনেক ভালো থাকুন প্রিয় তোয়াব ভাই। আরও অনেকদিন বাঁচুন। আমরা অন্তত আপনার জন্মদিনের সেঞ্চুরিটা করতে চাই। জয় বাংলা।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ